ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

সুমন্ত গুপ্ত

বিশ্বের বিস্ময় বাংলাদেশের ডেনিম

প্রকাশিত: ০৭:৩২, ৮ জুলাই ২০১৮

বিশ্বের বিস্ময় বাংলাদেশের ডেনিম

বিশ্ববাজারে ডেনিম কাপড়ে তৈরি পোশাকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন ব্র্যান্ড। কেবল তৈরিই নয়; ইউরোপের বাজারে রফতানির ক্ষেত্রেও টানা তিন বছর ধরে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। দিন দিন শক্ত হচ্ছে বিদেশী মুদ্রা আয়ের অবস্থান। বিশ শতকের মাঝামাঝি মার্কিন মুলুকে এর ব্যবহার শুরু হলেও বাংলাদেশ এখন এর অন্যতম উৎপাদনকারী দেশ। মাত্র তিন দশকের মধ্যে গড়ে উঠেছে ২৭টি বড় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। আরও কিছু কারখানা প্রক্রিয়াধীন। ডেনিম খাতে ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ বাড়ানোর কারণে বিদেশী ক্রেতারা আগ্রহী হচ্ছেন বাংলাদেশের ডেনিমের প্রতি। প্রধানত সাশ্রয়ী দাম আর গুণগত মানে সেরা হওয়ায় বাংলাদেশের ডেনিম পোশাকের জনপ্রিয়তা বিশ্বব্যাপী তুঙ্গে। তবে এ দুটি কারণের পাশাপাশি রয়েছে ডেনিম তৈরিতে ‘বাংলাদেশি নৈপুণ্য। তুলা এবং বুননের বিশেষত্বের কারণে বিশ্বব্যাপী কাপড়টি ‘ডেনিম’ নামে পরিচিত। তবে জনপ্রিয়তার বিচারে এখন জিন্স নামেই বেশি চেনেন ব্যবহারকারীরা। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান দফতর ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী গত তিন বছর ধরে ইউরোপের বাজারে ডেনিম পোশাক রফতানিতে শীর্ষে বাংলাদেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের অফিসিয়াল ওয়েবসাইট ইউরো স্টেটের তথ্যমতে, ২০১৫ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৪ হাজার ৬৫১ মিলিয়ন ইউরোর ডেনিম পণ্য আমদানি করে ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ১৭৬ মিলিয়ন ইউরোর ডেনিম পণ্য রফতানি হয়েছে। তথ্যমতে, ইউরোপের বাজারে ২০১০ সালে ৪৪৪ মিলিয়ন, ২০১১ সালে ৫৯১ মিলিয়ন, ২০১২ সালে ৭২৫ মিলিয়ন, ২০১৩ সালে ৮০৮ মিলিয়ন, ২০১৪ সালে ৯৩৯ মিলিয়ন, ২০১৫ সালে ১ হাজার ৩৫ মিলিয়ন, ২০১৬ সালে ১ হাজার ২২৭ মিলিয়ন এবং ২০১৭ সালে ১ হাজার ৩২০ মিলিয়ন ইউরোর ডেনিম পণ্য রফতানি হয়েছে ইউরোপে। বাংলাদেশে ডেনিমের বাজার সম্পর্কিত বিভিন্ন সমীক্ষা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ১৯৮৯ সালে প্রথম হংকং ও ফিলিপিন্সের দুটি প্রতিষ্ঠান যৌথ উদ্যোগে বাংলাদেশে ডেনিম পোশাক তৈরির দুটি কারখানা স্থাপন করে। ১৯৯২ সালের নবেম্বরে বিশ্বের ১১তম ডেনিম সরবরাহকারী দেশ হিসেবে স্বীকৃতি মেলে বাংলাদেশের। এর আগের বছরের তুলনায় সরবরাহ ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাওয়াই মেলে এ স্বীকৃতি। পরে ১৯৯৬ সাল থেকে তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশীয় ডেনিম কাপড়ের ওপর নির্ভর করতে শুরু“করে। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ইউরোপের বাজারে ১৭ কোটি পিসের বেশি ডেনিম পোশাক বিক্রি করে আয় করেছে প্রায় ৯৪ কোটি ডলার। অথচ একই সময়ে চীন একই বাজারে বিক্রি করে মাত্র সাড়ে ১১ কোটি পিস। ডেনিমের বিশাল বিশ্ববাজারে বাংলাদেশ সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। ইউরোপের বাজারে এখন যত ডেনিম রফতানি হয়, তার শতকরা ২৭ ভাগ যায় বাংলাদেশ থেকে। আগে চীন এই বাজারে শীর্ষ অবস্থানে থাকলেও ২০১৭ সালে বাংলাদেশ তাকে পেছনে ফেলে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ডেনিমে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। মোট রফতানিতে বাংলাদেশের অংশ শতকরা ১৪ দশমিক ২ ভাগ। বাংলাদেশের আগে রয়েছে চীন এবং মেক্সিকো। ইউরোপীয় কমিশনের পরিসংখ্যান ডিরেক্টরেট ইউরোস্ট্যাট-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে ১ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ইউরোর ডেনিম জিনস রফতানি করেছে। এরপর ২০১৭ সালে তা বেড়ে হয়েছে ১ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ইউরো। এ ছাড়া রফতানি বেড়েছে ০ দশমিক ৫৮ ভাগ। তবে বাংলদেশের নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী তুরস্কেরর রফতানি প্রবৃদ্ধি বেশি, ৪ দশমিক ৩৬ ভাগ। দেশে ডেনিম পণ্য তৈরি করে এমন কারখানার সংখ্যা সোয়া ৫শ’। এসব কারখানার বেশিরভাগই আমদানিকৃত কাঁচমালের (ফেব্রিক) ওপর নির্ভরশীল। ডেনিমের ফেব্রিক্স তৈরি করে এমন কারখানার সংখ্যা ২৭টি। আরও ১৭টি কারখানা তৈরি হচ্ছে। এই খাতে উদ্যোক্তারা বিনিয়োগ করেছেন ৮৩৪ মিলিয়ন ডলার। প্রতিবছর ডেনিম কাপড় উৎপাদনে দেশের সক্ষমতা রয়েছে ৩৬ কোটি গজ। চাহিদা রয়েছে প্রায় ৬০-৬৫ কোটি গজ। ২০২১ সালের মধ্যে এই চাহিদা ১২০ কোটি গজে দাঁড়ালে রফতানি আয়ের আশা করা হচ্ছে ৭০০ কোটি ডলার। অথচ একটা সময়ে জিন্স মানেই ছিল অনেক মোটা কাপড় আর শীতের সময়ে আরামদায়ক এমন পোশাক। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে জিন্স। এখন জিন্সের প্যান্ট অনেক পাতলা ও নরম কাপড়ের হওয়ায় এর জনপ্রিয়তা বেড়েছে বহুগুণ। রং ও সুতার ব্যবহারে এখন মাথায় রাখা হয় ঋতু। তাই শীত-গ্রীষ্ম সব সময়ই জিন্স আরামদায়ক পোশাক। অনুসন্ধানে জানা গেছে, মূলত শ্রমিকদের জন্য নির্মিত এই প্যান্ট ১৯৫০-এর দশক থেকে কিশোরদের মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করে। পরে জিন্স সবার কাছেই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তিন কারণে বাংলাদেশের ডেনিম পণ্য এখন বিশ্বসেরা। এর প্রথম কারণ হচ্ছে ডেনিম ফেব্রিক্সের কাঁচামাল বাংলাদেশে উৎপাদন হয়। ফলে দাম কম। দ্বিতীয় কারণ হলো অভিনব ডিজাইন এবং সৃজনশীল ডেনিম পোশাক প্রস্তুত করতে বাংলাদেশের নৈপুণ্য। এবং তৃতীয় কারণ হচ্ছে বাংলাদেশের ডেনিমের কারখানাগুলো অত্যাধুনিক এবং ওয়াশিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উৎকৃষ্ট। ফলে উৎপাদিত পণ্যের ফিনিশিং হয় আকর্ষণীয়। মূলত এ তিন কারণেই বাংলাদেশে ডেনিম এখন বিশ্বের বিস্ময়।
×