ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

রেজা সেলিম

জেআরসি স্যার!

প্রকাশিত: ০৬:২১, ৮ জুলাই ২০১৮

জেআরসি স্যার!

সরকার সম্প্রতি তিনজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদকে ‘জাতীয় অধ্যাপক’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে সম্মানিত করেছে। তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরী (জন্মঃ ১৫ নবেম্বর ১৯৪৩) যিনি জেআরসি স্যার নামে আমাদের কাছে পরিচিত। এই খবরে আমি নিজে খুব সম্মানিতবোধ করেছি কারণ স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। অপর দু’জন আমার সরাসরি শিক্ষক- ড. আনিসুজ্জামান আমার ছাত্র জীবনের সময়টা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলেন, যদিও আশির দশকের প্রথম দিকে আমার বন্ধু মিনার মনসুরের সঙ্গে দেখা বা আড্ডা দিতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলে আনিস স্যারের অনুমতি নিয়ে আমি সেখানে তাঁর ক্লাস করেছি বা জ্ঞান আহরণ করেছি। বঙ্কিমের শেষ জীবনের সাহিত্য চিন্তা নিয়ে আনিস স্যারের বিশ্লেষণ এখনও আমার মনে গেঁথে আছে। বিশ্বাস করি এমন দীক্ষা আমি তাঁর কাছ থেকে না পেলে সাহিত্যে অসাম্প্রদায়িকতা ও দেশপ্রেমের সম্পর্ক বুঝতে আরও সময় লাগত। রফিক স্যার আমার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের অন্যতম পথিকৃৎ। ভর্তি পরীক্ষার ফরম দেবার আগে একটা মৌখিক পরীক্ষা নিতেন। স্যার আমাকে একটা প্রশ্নই করেছিলেন, সাহিত্য পড়তে হবে কেন? বড় লেখক হতে চাই শুনে স্যার সঙ্গে সঙ্গে ফরম দিয়ে বললেন ‘এটা কখনই হতে পারবে না’! হতাশ মনে খুশির ভর্তি ফরম হাতে নিয়ে বের হয়ে পরের জীবনে দেখলাম সাহিত্যই পড়া হলো, বড় লেখক না হবার রফিক স্যারের ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলেছে। যদিও এই নিয়ে মনে কোন আক্ষেপ নেই কিন্তু এমন সব মানুষ আমাকে ক্লাসরুমের শিক্ষা দিয়েছেন যা বাইরের জীবনে দীক্ষা হয়েছে। আজ তারা যখন দেশের জাতীয় অধ্যাপক মর্যাদা পেলেন আমার নিজের সম্মানবোধ হচ্ছে এই ভেবে যে, এই তিনজনকেই আমি চিনি ও জানি। জীবদ্দশায় এটা দেখে যেতে পারাও গৌরবের। জেআরসি স্যার ছাত্র জীবনের বাইরের যে বিশ্ববিদ্যালয় সেখানে তিনি আমার শিক্ষক। আমি তাঁর অনুগত ছাত্র। আমি যখন পথে-ঘাটের আর গ্রাম সেবা উন্নয়নের ছাত্র, ২০০০ সালের প্রথম দিকে গ্রামে গ্রামে কেমন করে কম্পিউটার শিক্ষা দিয়ে তার সেবা মানুষের কাজে লাগানো যায় এমন সব কাজে হাত দিয়েছি সত্যি কথা বলতে কি সে সময়ে জেআরসি স্যারের একটি ই-মেইল আমাকে অবাক করে দেয়, যেখানে তিনি লিখেছেন পত্রিকায় ‘আমাদের গ্রাম’ প্রকল্পের খবর তিনি পড়েন ও আমাদের খোঁজ খবর রাখেন! আমি খুবই বিস্মিত হলাম এই কারণে যে, আমি তার নাম ও কাজকর্ম সম্পর্কে মোটামুটি জানি। তিনি বুয়েটের একজন নামকরা শিক্ষক ও কর্মবাদী মানুষ হিসেবে সর্বমহলে সুপরিচিত। একটা গল্প জানতাম তাঁর সম্পর্কে, পড়াশোনা শেষ করেই সিনিয়র শিক্ষকদের অনুপ্রেরণায় তিনি বুয়েটে ক্লাস নিতে শুরু করেন। শিক্ষক হিসেবে কাজ করার পরে তিনি নিয়োগপত্র পান। গল্প শুনেছি তাঁর বাড়ি সিলেটে, আর বাড়ির অনেক সদস্যই নাকি প্রকৌশলী। পরে জেনেছি জেআরসি স্যারের বাবাও একজন নামকরা প্রকৌশলী ছিলেন। তিনি আমার মতো একজন নগণ্য কর্মীর কাজের খবর রাখেন এর চেয়ে আর কি পাওয়ার থাকতে পারে! আমি যখন রামপালে ক্যান্সার নিরূপণে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে কাজ শুরু করলাম স্যার একদিন আমাকে উৎসাহ দিয়ে বললেন ‘এ কাজের যেন একটা প্রসেস ডক্যুমেন্টেশন থাকে যাতে অন্যেরা পরবর্তীতে জানতে ও শিখতে পারে।’ ভেবে দেখলাম তিনি শিক্ষকই বটে কিন্তু অনুপ্রেরকও। সারাজীবন এই একটা কাজই করতে হবে মনে গেঁথে নিলাম আর সেই মতে কাজও করে চলেছি। বিদেশে উচ্চশিক্ষা শেষ করে নানারকম পেশাগত হাতছানি ফেলে জেআরসি স্যার বুয়েটে ফিরে আসেন ১৯৬৮ সালে। বুয়েটে প্রথম কম্পিউটার আনার কারিগরদেরও তিনি একজন। ১৯৮১ সাল থেকে স্যার বুয়েট কম্পিউটার কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন পরবর্তী দশ বছর। সে সময়ে প্রকৌশল শিক্ষায় কম্পিউটার ব্যবহারের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি, যে কারণে দেশে কম্পিউটার ব্যবহারের সর্বজনীন সম্পৃক্তির অন্যতম অনুপ্রেরক হয়ে উঠেন। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশের আইটি সার্ভিস ও সফটওয়্যারের রফতানি উন্নয়নের সুপারিশ প্রণেতাদের যে কমিটি হয়েছিল তিনি ছিলেন তার প্রধান। এখনও কথায় কথায় উঠে আসে সেই জেআরসি কমিটির কথা, যার সূত্র ধরে আজকের ডিজিটাল বাংলাদেশের কর্মযজ্ঞ চলছে। জামিলুর রেজা চৌধুরী আমাদের দেশের প্রযুক্তি উন্নয়ন জগতের একজন নিভৃতচারী প্রাণপুরুষ। নেতৃত্ব দিয়েছেন পরিবেশ আন্দোলনে, প্রকৌশলীদের পেশা উন্নয়নের সংগঠন বিকাশে, বাংলাদেশ গণিত অলিম্পিয়াড আয়োজনে, আইসিটি টাস্ক ফোর্সসহ সরকারের নানা কমিটির সদস্য হিসেবে পরামর্শ ও নির্দেশনা দিয়েছেনও দিয়ে যাচ্ছেন। সর্বোপরি একজন সক্রিয় প্রযুক্তিমনষ্ক মানুষ যিনি দেশের প্রায় সকল বড় বড় অবকাঠামো নির্মাণে ভূমিকা রেখেছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণে তাঁর বিশেষজ্ঞ মতামত ও নির্দেশনা এই সরকারের সবচেয়ে বড় পাওয়া যার কারণে বিদেশের দ্বারস্থ না হয়ে বাংলাদেশ সরকার এতবড় কাজ করার দুঃসাহসিক প্রচেষ্টা হাতে নিয়েছে যা আর মাত্র এক বছর পরেই বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ কাঠামো-উদ্যোগ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত হতে যাচ্ছে। বিভিন্ন সূত্রে আমরা জানি জামিলুর রেজা চৌধুরী কেমন করে প্রকৃতি-প্রবাহ অক্ষুণœ রেখে পদ্মা নদীকে শাসন করে এই সেতু নির্মাণ করা যায় তার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ ও পরামর্শ দিয়ে চলেছেন। একবার একটি সাক্ষাতকারে পড়েছিলাম জেআরসি স্যারের অনবদ্য এক চিন্তার কথা, ‘পদ্মা বাংলাদেশের মাছের বড় উৎস। ইলিশ আমাদের বড় সম্পদ। এ পথে তাদের বঙ্গোপসাগরে যাতায়াত। সেতু নির্মাণের সময় ভারি যন্ত্রপাতি ব্যবহার, হ্যামারিংয়ের শব্দ এবং কম্পনের কারণে মাছ যদি এ এলাকা ছেড়ে চলে যায়? এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ঠিকাদারকে শর্ত দেয়া হয়েছে- তিন মাস ইলিশ চলাচলের পথে কোন কাজ করা যাবে না। চুক্তিতে এ বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে’ (সমকাল, ১০ ডিসেম্বর ২০১৫)। কঠিন কাজেও এমন প্রকৃতি প্রেমিক মানুষের জন্যে আমাদের দেশ নিশ্চয়ই গর্বিত। ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তিনি উপদেষ্টা হয়েছিলেন, পানি সম্পদ, প্রযুক্তি ও জ্বালানি খাত নিয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। ভূমিকম্প মোকাবেলায় দালান কোঠার কাঠামো প্রযুক্তি নিয়ে এই বিশেষজ্ঞ যেসব গবেষণা করেছেন তা পৃথিবীর নানা দেশে অবশ্য পাঠ্য হয়েছে। এছাড়াও রয়েছে তার অসংখ্য গবেষণা নিবন্ধ যা দেশে বিদেশে সমাদৃত হয়েছে। বুয়েট থেকে অবসর নিয়ে তিনি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটানা দশ বছর উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেছেন। দেশে বিদেশে দিয়েছেন নানা বিষয়ে বক্তৃতা যা বিভিন্ন ক্ষেত্রে পথ নির্দেশের ভূমিকা রেখেছে। জেআরসি স্যারের জীবদ্দশায় এই দেশ যতদূর পেরেছে তাঁকে চিনতে চেষ্টা করেছে। একুশে পদকসহ দেশের সর্বোচ্চ সম্মান পুরস্কারগুলো তিনি পেয়েছেন। আমরা তো বেঁচে থাকতে গুণী মানুষের কদর করি না। স্যারের বয়স এখন ৭৫ চলছে। যে ক’দিন তিনি আমাদের মাঝে আছেন আমরা যেন এই গুণী মানুষটিকে ভাল করে বুঝে নেই। যারা জানেন, তারা একমত হবেন স্যারের বাচনভঙ্গি ও কঠিন বিষয়কে সহজ করে বলার যে ক্ষমতা তা আমাদের জন্যে শিক্ষণীয় ও অনুকরণীয়। তাই যতদূর সম্ভব স্যারের স্বাস্থ্য বিবেচনায় রেখে তার কাছ থেকে সকলেরই শিখে নেবার অনেক সুযোগ আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই সমাদৃত মানুষকে আরও দুজন প্রথিতযশা শিক্ষাবিদের সঙ্গে দেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষক হিসেবে ‘জাতীয় অধ্যাপক’ পদে ভূষিত করেছেন, আমরা দেশের সকল মানুষ এতে অনুপ্রাণিত ও কৃতজ্ঞ। লেখক : পরিচালক, আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্যে তথ্য প্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×