স্টাফ রিপোর্টার, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে সাংবাদিক কন্যা রাইফা খানমের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হচ্ছে। রাইফার বাবা দৈনিক সমকালের চট্টগ্রাম ব্যুরো সিনিয়র স্টাফ রিপোর্টার রুবেল খান নিজে বাদী হয়ে মামলা করছেন বলে জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন। মামলায় অভিযুক্ত ৩ ডাক্তারসহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ব্যবস্থাপনায় জড়িতদের আসামি করা হচ্ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, তদন্ত রিপোর্টের পর ম্যাক্স হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাইফার চিকিৎসার সঙ্গে জড়িত ২ চিকিৎসককে বহিষ্কার করেছে এবং সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ শিশু চিকিৎসককে ওই হাসপাতালে নিষিদ্ধ করেছে। নিষিদ্ধ চিকিৎসক হচ্ছেন ডাঃ বিধান রায় চৌধুরী ও বহিষ্কৃত দুই চিকিৎসক হলেন ডাঃ দেবাশীষ সেনগুপ্ত ও ডাঃ শুভ্র দেব। এদের মধ্যে প্রথমোক্ত ডাক্তার অনকলে এই হাসপাতালে চিকিৎসা করেন। শেষোক্ত দুজন ওই হাসপাতালের নিয়োগকৃত।
উল্লেখ্য, রাইফা খান গলা ব্যথা ও জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার পর তাকে গত ২৮ জুন নগরীর ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরদিন রাতে তার অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু ঘটে। এ ঘটনা নিয়ে ডাক্তারদের ভুল চিকিৎসা ও দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ নিয়ে উত্তপ্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সিভিল সার্জনের নেতৃত্বে একটি তদন্ত কমিটি হয়। তদন্ত কমিটি গত শুক্রবার তাদের রিপোর্ট পেশ করে। এতে চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় কোন ত্রুটির কথা বলা না হলেও অবহেলা থাকা ও আন্তরিকতা ছিল না বলে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে সংশ্লিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ এই শিশু রোগীকে সময় ও মনোযোগ সহকারে পরীক্ষা করে দেখেননি। এছাড়া হসপিটালের অপর দুই ডাক্তার দেবাশীষ সেনগুপ্ত ও শুভ্র দেব রোগ জটিলতার বিপদকালে আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা দেননি বলে শিশুর বাবা-মায়ের যে অভিযোগ ছিল তা তদন্ত রিপোর্টে উদঘাটিত হয়েছে। তদন্ত কমিটি যে চারটি সুপারিশ পেশ করেছে এসবের ভিত্তিতে রাইফার বাবা রুবেল খান শনিবার মামলার সিদ্ধান্ত নিয়ে তা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন। অপরদিকে বিএমএ চট্টগ্রাম শাখার পক্ষে দাবি করা হয়েছে, বিশেষজ্ঞ প্যানেল কর্তৃক আইনানুগ প্রক্রিয়ায় কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে সংগঠনের পক্ষ থেকে এতে হস্তক্ষেপ করা হবে না, বরং স্বাগত জানানো হবে।
উল্লেখ্য, সাংবাদিক কন্যা রাইফা খানের মৃত্যুর ঘটনার পর ঘটনাটি চট্টগ্রামসহ গোটা দেশকে এক ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছে। দেশজুড়ে বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসকদের অবহেলা ও ভুলজনিত চিকিৎসার কারণে অহরহ মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কার্যকর বিষয়টি অনুপস্থিতই থেকে যায়। অনেকে মামলা করেও সুফল না পাওয়ার বহু ঘটনা রয়েছে।
রাইফার বয়স হয়েছিল মাত্র ২ বছর ৪ মাস। সে বা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল। চিকিৎসকদের অবহেলার জের হিসেবে সে অকালে ঝরে গেছে। এ ঘটনাটি দেশের বিবেকবান কোন সমাজ মেনে নিতে পারছে না। ফলে বিষয়টি সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও অন লাইন মিডিয়া এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচার হয়েছে এবং হচ্ছে। এ ঘটনা নিয়ে স্বাস্থ্য মহাপরিচালকের অধিদফতর থেকেও একটি তদন্ত শুরু হয়েছে। যেখানে প্রাথমিকভাবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে অব্যবস্থাপনার ১১টি বিষয় উঠে এসেছে। এসব বিষয়ে উত্তর দেয়ার জন্য তাদের পনেরো দিন সময়ও দেয়া হয়েছে।
এদিকে রাইফার মৃত্যুর পর বিএমএ নেতা ডাঃ ফয়সল ইকবাল ও বিএনপি-জামায়াতপন্থী বিএমএ নেতা ডাঃ খুরশিদ জামিল চৌধুরীর সাংবাদিকদের নিয়ে অশোভন আচরণ ও পরিস্থিতিতে উস্কে দেয়ার ঘটনার পর বিষয়টি আরও তিক্ততা ছড়িয়ে দিয়েছে। একটি শিশু কন্যার এহেন অকাল মৃত্যু হয়েছে এবং এতে চিকিৎসকদের অবহেলার বিষয়টি যেখানে তদন্ত কমিটি সুনির্দিষ্টভাবে উত্থাপন করেছে সেক্ষেত্রে উক্ত বিএমএ ও ড্যাব নেতাদের বিরুদ্ধেও আইনগত ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিও উঠেছে। উল্লেখ্য, ডাঃ ফয়সল ইকবাল চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদকও বটে।
রাইফার বাবা রুবেল খান জানিয়েছেন, তিনি সংশ্লিষ্ট শিশু বিশেষজ্ঞ ডাঃ বিধান রায় চৌধুরী, হাসপাতালের চিকিৎসক ডাঃ দেবাশীষ সেনগুপ্ত ও ডাঃ শুভ্র দেব, ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডাঃ লিয়াকত আলী খান ও পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের আসামি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং তাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করে বিচারের জন্য আদালতে সোপর্দ করার জন্য এজাহার করতে যাচ্ছেন। তিনি তার আইনজীবীর সঙ্গে ইতোমধ্যে পরামর্শ নিয়েছেন। আজকের মধ্যে এ এজাহার হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
অপরদিকে চট্টগ্রামের মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনও অবহেলাজনিত কারণে রাইফা খানের মৃত্যুর বিষয়ে যে ব্যবস্থা গৃহীত হবে তাকে স্বাগত জানাবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। রাইফা খানের মৃত্যু ও তৎপরবর্তী বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের চিকিৎসা ব্যবস্থা বিষয়টি ক্ষোভ রীতিমতো জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরিতে পরিণত হয়েছে। তবে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে সকলকে সংযত আচরণের জন্য বারবার আহ্বান জানালেও চিকিৎসক সমাজের পক্ষ থেকে কুচক্রীরা বিষয়টি ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিএমএর সঙ্গে জড়িত থাকা বিএনপি ও জামায়াতপন্থী নেতৃস্থানীয় কিছু চিকিৎসকদের অপভূমিকার কারণে চিকিৎসক ও সাংবাদিক সমাজ বর্তমানে যে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে তা সুস্পষ্টভাবে প্রতিবাদ হচ্ছে। বিষয়টি ইতোমধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমকেও অবহিত করা হয়েছে। বিএমএ শীর্ষ নেতা মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিনও অবহিত হয়েছেন। তারা ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন নেতাদের সঙ্গেও কথা বলেছেন বলে জানা গেছে। ধারণা করা হচ্ছে, মন্ত্রী সব নেতা বিষয়টি একটি যৌক্তিক পরিণতির দিকে নেয়ার লক্ষ্যে চট্টগ্রামে আসারও সম্ভাবনা রয়েছে। তবে ঘটনা যাই হোক, রাইফার বাবা রুবেল খান জানিয়েছেন, তার কন্যা ভুল চিকিৎসা ও চরম অবহেলার শিকার। তাই তিনি ব্যক্তিগতভাবে মামলার বাদী হচ্ছেন। ভুল বা অপচিকিৎসার জন্য আইনে যাই থাকুক না কেন তিনি তার হারানো কন্যার মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে আইনী লড়াই চালিয়ে শাস্তি নিশ্চিত করে গোটা দেশের স্বাস্থ্যসেবার বেহাল দশায় কিছুটা হলেও উন্নতি আনার জন্য সচেষ্ট থাকবেন।
সাংবাদিক কন্যার মৃত্যু
অভিযুক্ত ৩ ডাক্তারসহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: