ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়

ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় আত্মপ্রকাশ করল ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৮ জুলাই ২০১৮

ধর্মনিরপেক্ষ চেতনায় আত্মপ্রকাশ করল ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘গাহি সাম্যের গান’ স্লোগান নিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার জাগরণের মাধ্যমে বিভাজন দূর করার প্রত্যয় নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে নতুন সংগঠন ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’। শনিবার সকালে জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে নানা শ্রেণী-পেশার মানুষের উপস্থিতিতে সংগঠনের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। বেশ কিছু দিনের কাজের ধারাবাহিকতায় উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিসহ সমাজের নানা পেশার শীর্ষস্থানীয়দের এক মঞ্চে আনে নতুন এই সংগঠন। প্রথমত কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি দিয়ে পরিচালিত হলেও পরবর্তীতে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে আহ্বায়ক কমিটি গঠনের কাজ করা হবে বলে জানান পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। এই নাগরিক ফোরামের উদ্দেশ্য তুলে ধরে অনুষ্ঠানে এর আহ্বায়ক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, মুক্তিযুদ্ধের যেই প্রধান চেতনা ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, সেটার দিকে আমরা ফিরে যেতে চাই। তাহলে আমরা ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ, শোষণহীন বাংলাদেশ ও সাম্যের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারব। মানুষের মধ্যে যে ধর্মনিরপেক্ষ চেতনা সেটার মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক আমরা তৈরি করতে চাই। আজকে আত্মপ্রকাশ হল। এরপর ডিসেম্বর পর্যন্ত সুধী সমাবেশসহ বিভিন্ন কর্মসূচী আমরা হাতে নেব। এছাড়া সাম্প্রদায়িক শক্তির কোন আঘাত এলে সেটা প্রতিহত করতে নতুন এই সংগঠন প্রস্তুত থাকবে বলে মন্তব্য করেন তিনি। অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে জাতীয় অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ইমেরিটাস অধ্যাপক এ কে আজাদ চৌধুরী, ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবদুল মান্নান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক মুহম্মদ জাফর ইকবাল, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী, সাংবাদিক আবেদ খান, ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহফুজা খানম, প্রেসক্লাবের সভাপতি শফিকুর রহমান, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক শামীম মোঃ আফজাল, বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা শুদ্ধানন্দ মহাথেরো, রামকৃষ্ণ মিশনের সাধারণ সম্পাদক স্বামী গুরু সেবানন্দ, খ্রিস্টান এসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও, ইসকনের প্রতিনিধি সুখীল দাস, সংগঠনের সদস্য সচিব মামুন আল মাহতাব বক্তব্য দেন। জাতীয় সঙ্গীতের মাধ্যমে সূচনা হওয়া অনুষ্ঠানে অতিথিদের পাশাপাশি শিক্ষার্থী, ধর্মীয় সংগঠনের কর্মী ও সংস্কৃতিকর্মীদের উপস্থিতিতে পরিপূর্ণ ছিল জাতীয় জাদুঘরের প্রধান মিলনায়তন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন ড. নুজহাত চৌধুরী। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রচারিত এক ভিডিও বার্তায় জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে হাজার হাজার বছর ধরে নানা ধর্ম-বর্ণের মানুষ সম্প্রীতি নিয়ে বসবাস করছে। দেশ সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে গেছে। বিভেদ এবং সংঘাত যে হয়নি তা নয়। সব মিলিয়ে যে সম্প্রীতির অবনতি হয়েছে, তা সত্ত্বেও আমরা এর উপরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রেখে সামনের দিকে অগ্রসর হয়েছি।’ অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবাল শুভেচ্ছা বক্তব্যে বলেন, আমরা যে দেশটি পেয়েছি সেখানে কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন মানুষ নেই। কিছু ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ রয়েছে। আমরা সবাই একই। তবুও আমাদের মধ্যে সম্প্রীতির অভাব রয়েছে। এদের সবাইকে নিয়ে যদি আমরা দেশটিকে এগিয়ে নিতে না পারি তবে মহাকাশে স্যাটেলাইট পাঠিয়ে, মেট্রোরেল তৈরি করে কিংবা অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি দিয়ে কি হবে? আজ যদি আমরা কোন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান কিংবা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর কাউকে জিজ্ঞাসা করি ‘আপনি কেমন আছেন?’ সে যদি এদিক ওদিক তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলে ‘ভাল নেই’। একটা দেশ ভাল চলছে কি খারাপ চলছে তা বোঝা কিন্তু খুবই সোজা নিজেকে প্রশ্ন করলেই আপনারা উত্তর পেয়ে যাবেন। ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ নামটি খুবই চমৎকার হয়েছে। সবাইকে নিয়ে আমরা সম্প্রীতি রক্ষা করতে পারি। আমাদের পাশের দেশ ভারতের এত বড় গণতন্ত্র কিন্তু সামান্য গরুর মাংস খাওয়ার জন্য প্রাণ দিতে হয়। মিয়ানমার থেকে ১০ লাখ রোহিঙ্গার ওপর বর্বর নির্যাতন করে এদেশে পাঠিয়ে দেয়া হলো। পৃথিবী জুড়েই অসাম্প্রদায়িকতার চর্চা চলছে। আমাদের দেশেও এর প্রভাব এসে পড়েছে। তবে হতাশ হওয়ার কিছু নেই, দুঃসময়ে টিকে থাকাটাই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশকে নিয়ে আমরা আশাবাদী। আমরা এদেশকে সম্প্রীতির দেশ গড়ে তুলব। আমরা সব ধর্মের মানুষকে নিয়ে এদেশে বসবাস করব। ভবিষ্যতে দেশের সম্প্রীতি রক্ষা করতে হলে ধর্ম যার যার কিন্তু উৎসবগুলো সবাইকে পালন করতে হবে। শুভেচ্ছা বক্তব্যে ইমেরিটাস অধ্যাপক এ.কে আজাদ চৌধুরী বলেন, একটি কাব্যিক নাম দিয়ে পথচলা শুরু করল ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’। এই সম্প্রীতি বাঙালীর। মুক্তিযুদ্ধের সময় সব ধর্মের মানুষ এক হয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম। তখনও আমাদের মধ্যে কোন সম্প্রীতির অভাব ছিল না। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, মানুষে মানুষে বিভেদ নেই। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর মাত্র তিনটি বছর পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। এরপর সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানী মনোভাবে বিশ্বাসীদের কারণে দেশে আবারও অসাম্প্রদায়িক চেতনা ঢুকে গেল। বারবার ক্ষমতার পালাবদল হলো কিন্তু এখনও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুদের সহিংসতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সম্প্রীতি কখনও একা আসবে না। মানুষে মানুষে বিভেদের পাহাড় গড়ে সম্প্রীতি রক্ষা করা যাবে না। সমতার ভিত্তিতে সমাজ গড়লেই সম্প্রীতির বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, পঁচাত্তরের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতি অন্ধকারে চলে গিয়েছিল। দীর্ঘদিন অন্ধকারে থাকায় এই অশুভ চক্র প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিয়েছে। তারা রাজনীতি থেকে সুবিধা নিচ্ছে। এজন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশের সম্প্রীতি রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে। একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ দেখার জন্য এদেশের বীর শহীদরা আত্মাহুতি দিযেছিলেন। শহীদদের রক্ত যেন বৃথা না যায় সেজন্য একত্রিত হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। বৌদ্ধ ধর্মীয় নেতা শুদ্ধানন্দ মহাথেরো বলেন, আমার হাজার বছরের ইতিহাস মিলন আর সম্প্রীতির ইতিহাস। ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতার সেখানে স্থান নেই, স্থান নেই একাত্তরের পরাজিত শক্তির। ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রুখে দিতে সমাজের সর্বস্তরে আজ ঐক্য প্রয়োজন। ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা আমাদের মুক্তিযদ্ধের আদর্শ জলাঞ্জলি দিতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। ধর্ম যার যার, বাংলাদেশ আমারÑ এই বোধ আজ নতুন করে ছড়িয়ে দিতে হবে সবার মাঝে। সাংবাদিক আবেদ খান বলেন, মুক্তিযোদ্ধারা চেয়েছিলেন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ। কিন্তু সেই লক্ষ্য থেকে আমরা পিছিয়ে আছি বলেই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজটি করা জরুরী। আবার সম্প্রীতিবিরোধী একটি শক্তিও সমাজে দাঁড়িয়ে গেছে। সে কারণেই আমাদের এখন মানুষের কাছে যেতে হবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী সকল ধর্ম, বর্ণ, নারী, পুরুষ ঐক্যবদ্ধভাবে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে। আহ্বায়ক পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ সংগঠন গড়ে তোলার লক্ষ্যে গত কয়েক মাস ধরে আমরা ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মতবিনিময সভা করেছি। রাজধানীতে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা এসব সভায় এসে এ সংগঠনের গুরুত্ব তুলে ধরেছেন। এর বাইরে বুদ্ধিজীবী, জ্যেষ্ঠ নাগরিকদের সঙ্গে আমরা ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে কথা বলেছি। সবার কথায় প্রতিফলিত হয়েছে, একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরেও দেশ সেই লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারেনি। বরং সময়ের পরিবর্তনে অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দিয়েছে। সম্প্রীতির সেই বাংলাদেশের জন্য তাই আমাদের একত্রিত হওয়া প্রয়োজন। তিনি আরও বলেন, সময় এসেছে আমাদের আবারও ১৯৫২, ১৯৫৪ ১৯৬৯ আর একাত্তরের মতো একতাবদ্ধ হয়ে হিংস্র শকুনের দলকে রুখে দেয়ার। আমার হাজার বছরের ইতিহাস মিলন আর সম্প্রীতির ইতিহাস। ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতার সেখানে স্থান নেই, স্থান নেই একাত্তরের পরাজিত শক্তির। ধর্মান্ধ, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রুখে দিতে সমাজের সর্বস্তরে আজ ঐক্য প্রয়োজন। ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ জলাঞ্জলি দিতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে।
×