ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

কিডনি বিকল রোগীদের নিয়ে জমজমাট ডায়ালাইসিস ব্যবসা

প্রকাশিত: ০৬:০২, ৭ জুলাই ২০১৮

  কিডনি বিকল রোগীদের নিয়ে জমজমাট ডায়ালাইসিস ব্যবসা

নিখিল মানখিন ॥ কিডনি বিকল রোগীদের নিয়ে কিছু সংখ্যক অসাধুু ব্যবসায়ী নিম্নমানের ডায়ালাইসিস ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে ব্যাপক সংখ্যক কিডনি রোগীর তুলনায় ডায়ালাইসিস সেন্টার খুবই কম, মাত্র ৯৬ এবং ১৮ হাজার রোগী এসব সেন্টারে সপ্তাহে ২ বার করে ডায়ালাইসিস পায়। বেসরকারী সেন্টারগুলোতে সাড়ে তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ডায়ালাইসিসের ফি রাখা হয়। সপ্তাহে একজন রোগীকে দু থেকে তিনবার ডায়ালাইসিস করাতে ৬ থেকে ১০ হাজার টাকা খরচ হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় মোট কিডনি রোগীর তুলনায় মাত্র ১৫ শতাংশ রোগী ডায়ালাইসিসের সুযোগ পায়। বাকি বিপুল সংখ্যক রোগী অর্থাভাবে ডায়ালাইসিস করতে পারে না। এ সুযোগে কিডনি বিকল রোগীদের কাছ থেকে নানা কৌশলে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে একটি চক্র। মফস্বল থেকে আগত রোগীরাই এমন ফাঁদে বেশি পড়ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। বাংলাদেশ রেনাল এ্যাসোসিয়েশন জানায়, দেশে প্রায় ২ কোটি লোক কোন না কোন ধরনের কিডনি রোগে ভুগছে। আক্রান্ত ৭৫ ভাগ রোগী কিডনি নষ্ট হওয়ার আগে এ মরণব্যাধির অস্তিত্ব ধরতে পারেন না। কিডনি বিকল রোগীর চিকিৎসা এত ব্যয়বহুল যে, মাত্র শতকরা ৭ থেকে ১০ ভাগ লোকের চিকিৎসা চালিয়ে যাবার সামর্থ্য আছে। দেশে প্রতি বছর ২৫ হাজার লোকের কিডনি বিভিন্ন কারণে হঠাৎ করে অকেজো হয়ে যায়। প্রতি বছর কিডনি জনিত রোগে প্রায় ৪০ হাজার লোক মারা যায়। দেশে কিডনি বিকল রোগীদের জন্য কিডনি দাতার সঙ্কটও প্রকট। কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য অপেক্ষমাণ মোট রোগীর মাত্র শতকরা ২ ভাগ রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন করা সম্ভব হয়। অন্যরা নিজেদের মতো চেষ্টা করে রোগী নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমান। বাকিরা ডায়ালাইসিস দিয়ে বাঁচার চেষ্টা করে থাকেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টাকা দিয়েও কিডনি সংগ্রহ করা সম্ভব হচ্ছে না। কিডনি দেয়ার পর ফলোআপ চিকিৎসা ও বিভিন্ন কারণে নানা শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন জীবিত কিডনি দাতারা। পাশাপাশি রয়েছে কিডনি সার্জনের সঙ্কট। আইনী জটিলতাসহ নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় কিডনি প্রতিস্থাপন কার্যক্রমে অংশ নিতে চান না সার্জনরা। দেশে কিডনি রোগ চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলেও খুব ব্যয়বহুল। প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালু থাকলেও সফলতার মাত্রা খুব বেশি সন্তোষজনক নয়। দেশের সব চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা প্রতিস্থাপনের ব্যবস্থা নেই। সীমিত চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ডায়ালাইসিস ও প্রতিস্থাপন কার্যক্রম চালু রয়েছে। কিডনি রোগের উপসর্গ ও চিকিৎসা সম্পর্কে অধ্যাপক ডাঃ শহিদুল ইসলাম সেলিম দীর্ঘদিন ধরে কিডনি রোগ ও প্রতিকার নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। তিনি জনকণ্ঠকে জানান, বিভিন্ন কারণে কিডনি অকেজো হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে কারও কারও কিডনি হঠাৎ করে অকেজো হয়ে যায়। বাংলাদেশে ডায়রিয়া, অতিরিক্ত বমি, অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ, বিভিন্ন রকম ইনফেকশন, ম্যালেরিয়া, প্রসবকালীন জটিলতা, সাংঘাতিক ধরনের নেফ্রাইটিস, বিভিন্ন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ও কিডনির পাথরের কারণে হঠাৎ করেই কিডনি অকেজো হয়ে যায়। এ ধরনের কিডনি অকেজো হয়ে যাওয়ার ভাল দিক হচ্ছে, এগুলো অনেক ক্ষেত্রেই প্রতিরোধ করা যায়। সময় মতো সঠিক চিকিৎসা করলে অনেকের কিডনি পুনরায় স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরে পায়। এ দেশে প্রতি বছর প্রায় ২৫ হাজার লোকের কিডনি বিভিন্ন কারণে অকেজো হয়ে যায়। সঠিক চিকিৎসা করলে প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ রোগীর কিডনি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। অধ্যাপক ডাঃ শহিদুল ইসলাম সেলিম জানান, কিডনি প্রতিস্থাপনের দু দিন আগে থেকে পরবর্তী সারাজীবন ধরে রোগীকে নিউরাল ও সেলসেপ্ট নামে দুটি ওষুধ খেয়ে যেতে হয়। ওই দুটি ওষুধ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। কিডনি প্রতিস্থাপন ভালভাবে সম্পন্ন হলেও ওই দুটি ওষুধ নিয়মিত না খেলে রোগীর মৃত্যু অনিবার্য হয়ে পড়ে। আর প্রতিটি নিউরাল (১০০এমজি) দাম ১৫০ টাকা এবং প্রতিটি সেলসেপ্টের দাম ১১০ টাকা। এ ছাড়া কিডনি ভালভাবে মিল না হলে সাইমুলেট নামে দুটি ইনজেকশন দিতে হয়। এই প্রতিটি ইনজেকশনের দাম পড়ে দেড় লাখ টাকা। সারাজীবন ব্যবহার করতে হওয়ার কারণে ওই দুটি ওষুধ নিয়মিত খেতে পারে না অনেক দরিদ্র পরিবার। তাই ওই দুটি ওষুধের ওপর থেকে আমদানি কর উঠিয়ে দিলে কিডনি প্রতিস্থাপন করা অনেক রোগী উপকৃত হবে। জটিল অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, দেশে প্রয়োজনের মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশ কিডনি প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। কিডনি দানে আইনী জটিলতা এবং আগ্রহী ব্যক্তির স্বল্পতার কারণে তা প্রতিস্থাপন অনেকাংশে আটকে আছে। ১৯৮২ সালে দেশে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপিত হলেও নিয়মিতভাবে কিডনি প্রতিস্থাপন শুরু হয় ১৯৮৮ সাল থেকে। এ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫০৫টি কিডনি প্রতিস্থাপনের অস্ত্রোপচার হয়েছে, এর মধ্যে শিশুদের ১১টি। ২৯ বছরের হিসাবে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবছর মাত্র ১৭টি বা প্রতি দুই মাসে তিনটি কিডনি প্রতিস্থাপিত হচ্ছে। কিডনি রোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম এ ওহাব দেশে প্রথম কিডনি প্রতিস্থাপন উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেন, দেশে কিডনি প্রতিস্থাপন অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু দেশে কিডনি দাতার সঙ্কট প্রকট হয়ে উঠেছে। কিডনি দাতা ও গ্রহীতার ওষুধের মূল্যহ্রাস এবং মস্তিষ্কের মৃত্যুর (ব্রেইন ডেথ) পর তার বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অসুস্থ ব্যক্তির দেহে সংযোজন করার সুযোগ রেখে আইন তৈরি করা দরকার। কিডনি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডাঃ এম এ সামাদ বলেন, পৃথিবীব্যাপী কিডনি রোগের হার অত্যন্ত ব্যাপক। বাংলাদেশে প্রায় ২ কোটি লোক কোন না কোন কিডনি রোগে আক্রান্ত। কিডনি বিকলের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয় বহুল বিধায় এ দেশের শতকরা ১০ জন রোগী এ চিকিৎসা চালিয়ে যেতে পারে না। অর্থাভাবে অকালে প্রাণ হারান সিংহভাগ রোগী। পক্ষান্তরে, একটু সচেতন হলে ৫০ থেকে ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে কিডনি বিকল প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ জন্য প্রয়োজন প্রাথমিক অবস্থায় কিডনি রোগের উপস্থিতি ও এর কারণ শনাক্ত করে তার চিকিৎসা করা। কিডনি ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ হারুন অর রশিদ বলেন, দেশে ব্যাপক সংখ্যক কিডনি রোগীর তুলনায় ডায়ালাইসিস সেন্টার খুবই কম মাত্র ৯৬টি এবং ১৮ হাজার হাজার রোগী এসব সেন্টারে সপ্তাহে ২ বার করে ডায়ালাইসিস পায়। বেসরকারী সেন্টারগুলোতে সাড়ে তিন হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত ডায়ালাইসিস মূল্য রাখা হয়। তিনি বলেন, সাউথ এশিয়াতে মোট কিডনি রোগীর তুলনায় মাত্র ১৫ শতাংশ রোগী ডায়ালাইসিসের সুযোগ পায় বাকি বিশাল সংখ্যক রোগী অর্থাভাবে ডায়ালাইসিস নিতে পারে না। তাই বাংলাদেশে ডায়ালাইসিস খরচ কমাতে সরকারী বেসরকারীভাবে বাস্তবিক উদ্যোগ নিতে হবে।
×