ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

হাত বাড়ালেই আর মিলছে না মাদক ॥ সাঁড়াশি অভিযানে কমে আসছে আগ্রাসন

প্রকাশিত: ০৬:০১, ৭ জুলাই ২০১৮

    হাত বাড়ালেই আর  মিলছে না মাদক ॥ সাঁড়াশি অভিযানে কমে আসছে আগ্রাসন

গাফফার খান চৌধুরী ॥ সারাদেশে চলমান মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের কারণে মাদকের আগ্রাসন কমে আসছে। তবে পুরোপুরি নির্মূল হয়নি। ঢাকায় মাদকের আঁতুড়ঘর হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদপুর ও মিরপুরে অবস্থিত উর্দুভাষী অবাঙালীদের বিহারী ক্যাম্প ও ঢাকার কয়েকটি বস্তি ঘুরে মাদকের আগ্রাসন অনেক কমে যাওয়ার চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। আগের মতো আর হাত বাড়ালেই এসব জায়গায় মাদক মিলছে না। ক্যাম্পের অনেক বাসিন্দা ক্যাম্প ছেড়ে দিচ্ছেন। তবে মাদক মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর জামিনে ছাড়া পেয়ে অনেকেই আবার ক্যাম্পে যাতায়াত শুরু করেছেন। ক্যাম্পগুলোতে মাদক প্রবেশের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তবে অভিযানের আগে ঢুকে পড়া মাদকই অত্যন্ত গোপনে ক্যাম্পের ভেতরে নির্ভরযোগ্য মাদকসেবীদের কাছে বিক্রি হচ্ছে। যদিও তার পরিমাণ একেবারেই কম। এদিকে বৃহস্পতিবার ভোর থেকে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত ঢাকায় পুলিশ ও র‌্যাবের অভিযানে গ্রেফতার হয়েছে ৭৯ জন। গ্রেফতারকৃতদের অধিকাংশই মাদকসেবী। কিছু খুচরা ব্যবসায়ীও আছে গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার হয়েছে অস্ত্রগোলাবারুদ, ইয়াবা ও ফেনসিডিল। শুক্রবার বিকেল তিনটা থেকে সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত ঢাকার মোহাম্মদপুরে অবস্থিত উর্দুভাষী অবাঙালীদের বসবাসের জেনেভা ক্যাম্প ও মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট ক্যাম্পে অবস্থান করে দেখা গেছে, সেখানে আগের মতো আর মাদক বিক্রির জন্য হাকডাক নেই। হুমায়ুন রোডের মাথায় জেনেভা ক্যাম্পের একটি দোকানে বসে মাদক ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করা হলেও কোন ফল হয়নি। উল্টো সেখানকার বাসিন্দারা বলছিলেন, তাড়াতাড়ি চলে যান। ক্যাম্পের ভেতরে সারাক্ষণ পুলিশ ও র‌্যাবের গোয়েন্দারা সিভিলে ঘোরাফেরা করছে। কোনভাবে যদি বুঝতে পারে, মাদকের বেচাকেনা করতে এসেছেন, তাহলে ধরে নিয়ে যাবে। প্রায় একমাস ধরে ক্যাম্পে এমন কঠিন অবস্থা চলছে। তারপরেও মাদক নির্মূল হয়নি। নতুন করে মাদকের চালান ক্যাম্পে প্রবেশ করতে পারছে না। তবে আগে ঢুকে পড়া চালানের মধ্যে যেসব মাদক বিক্রি হয়নি, সেসব মাদক এখন অত্যন্ত নির্ভরযোগ্য লোকের কাছে বা মাদকসেবীর কাছে খুবই গোপনে বিক্রি হচ্ছে। আগে এসব রাস্তায় দাঁড়ানো যেত না। এখন তার বালাই নেই। যারা ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা করত, তাদের অনেকেই গ্রেফতার হয়ে জেলে রয়েছে। আর যারা গ্রেফতার হয়নি, তারা ক্যাম্প ছেড়ে আত্মগোপনে চলে গেছে। তবে মাদকের মামলায় গ্রেফতার হওয়ার পর সম্প্রতি জামিনে ছাড়া পাওয়াদের অনেকেই নতুন করে ক্যাম্পে ঘোরাফেরা শুরু করেছে। তবে তারা মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখছে কি না তা স্পষ্ট নয়। ক্যাম্পবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চলতি বছরের ২৬ মে র‌্যাব স্মরণকালের সবচেয়ে বড় মাদকবিরোধী অভিযান চালায় জেনেভা ক্যাম্পে। টানা ছয় ঘণ্টার সেই অভিযানে অন্তত দুই শতাধিক লোককে ধরা হয়েছিল। এদের মধ্যে প্রকৃত মাদক ব্যবসায়ী ও মাদক কারবারি হিসেবে শনাক্ত হওয়া ১৫৩ জনকে গ্রেফতার করে তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। এরপর পুলিশ আরেক দফায় ক্যাম্পে মাদকবিরোধী অভিযান চালিয়ে একশ জনকে গ্রেফতার করে। এরপর থেকে ক্যাম্পে মাদক ব্যবসা একেবারেই কমে যায়। ক্যাম্পের বাসিন্দারা বলছিলেন, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে খুবই পরিচিত ব্যবসায়ী সাঈদের দুই ভাই সাজু ও রাজু এবং তার ছেলে কামরানও রয়েছে। অভিযানে সাঈদও আটক হয়েছিল। পরবর্তীতে তার বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসা করার কোন অভিযোগ না থাকায় তাকে ছেড়ে দেয় র‌্যাব। আরেক ব্যবসায়ী সালাহউদ্দিনকেও গ্রেফতার করেছিল র‌্যাব। তার বিরুদ্ধেও কোন অভিযোগের সত্যতা না পেয়ে র‌্যাব তাকেও ছেড়ে দেয়। সাঈদের দাবি, তার ছেলে ও দুই ভাই পরিস্থিতির শিকার হতে পারে। তারা যদি সত্যিই মাদক ব্যবসায়ী হয়ে থাকে এবং বিষয়টি যদি তার জানা থাকত তাহলে তিনি নিজেই তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তুলে দিতেন। ক্যাম্পবাসীরা বলছেন, র‌্যাবের অভিযানের পর মাসখানেক সময় পার হয়ে গেলেও সেই অভিযানের রেশধরে এখনও ব্যক্তিগত শত্রুতা মেটাতে অনেকেই অনেককেই ফাঁসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছেন। যা ক্যাম্পের ভেতরে এক ধরনের বাড়তি উত্তেজনার সৃষ্টি করেছে। নিরীহ ক্যাম্পবাসীর মধ্যে এ নিয়ে রীতিমতো আতঙ্ক বিরাজ করছে। এজন্য অনেকেই ক্যাম্প ছেড়ে দিচ্ছেন। তার মধ্যে সাঈদও রয়েছেন। শুধু সালাহউদ্দিন বা সাঈদের ক্ষেত্রে নয়, অনেকেই মাদকবিরোধী অভিযানকে পুঁজি করে যার যার শত্রুকে মাদক ব্যবসায়ী আখ্যা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। যা রীতিমত আতঙ্কের। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের মিডিয়া বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান বলছেন, মাদকবিরোধী অভিযানকে কেউ যাতে পুঁজি করে ব্যক্তিগত শত্রুতা হাসিল করতে না পারে এজন্য তারা সতর্ক রয়েছেন। অভিযানে কোনক্রমেই সাধারণ মানুষ যাতে হয়রানির শিকার না হন, এজন্য পুলিশকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। র‌্যাবের লিগ্যাল এ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, সারাদেশে মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান চলমান থাকায় মাদক ব্যবসায়ীরা আত্মগোপনে চলে গেছে। যারা গ্রেফতার হচ্ছে, তাদের অধিকাংশই মাদকসেবী। তবে কিছু খুচরা ব্যবসায়ীও রয়েছে। পলাতকদের ওপর নজরদারি অব্যাহত আছে। সাঁড়াশি অভিযানের কারণে মাদকের চালানও আর আগের মতো আসতে পারছে না। ঢাকাসহ সারাদেশে মাদকের আগ্রাসন দিন দিন কমে আসছে। এদিকে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার বিকেল পর্যন্ত ঢাকায় পুলিশ ও ডিবি পুলিশের অভিযানে ৭৬ জন মাদক ব্যবসায়ী গ্রেফতার হয়েছে। তাদের কাছে থেকে উদ্ধার হয়েছে একটি পিস্তল, গুলি, শতাধিক বোতল ফেনসিডিল, ১১ হাজার পিস ইয়াবা, প্রায় দেড় কেজি হেরোইন, প্রায় দুই কেজি গাঁজা ও প্রায় ৭০ লিটার দেশী-বিদেশী মদ। অন্যদিকে র‌্যাব রাজধানীর খিলগাঁও চৌধুরীপাড়ার একটি বাসা থেকে সাড়ে ২৭ হাজার পিস ইয়াবাসহ দুই জনকে এবং রাজধানীর কল্যাণপুরে আম ভর্তি কার্টন থেকে শতাধিক বোতল ফেনসিডিলসহ এক মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে।
×