ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

আছে মাদক কারবারিও

বুলবুলের কাঁধে ১২ মামলা, কাউন্সিলর পদে বেশিরভাগই অশিক্ষিত

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৭ জুলাই ২০১৮

  বুলবুলের কাঁধে ১২ মামলা, কাউন্সিলর পদে বেশিরভাগই অশিক্ষিত

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ রাজশাহীর আলোচিত পুলিশ কনস্টেবল সিদ্ধার্থ সরকার হত্যাসহ নাশকতার ১২ মামলার বোঝা মাথায় নিয়ে এবার রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক) নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল। যদিও এসব মামলায় জামিনে রয়েছেন তিনি। বুলবুল তার হলফনামায় এসব মামলার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। শুধু তাই নয়, এবার রাসিক নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থীর তালিকায় উঠে এসেছে মাদককারবারির নামও। এছাড়া কাউন্সিলর প্রার্থীদের বড় অংশই অশিক্ষিত। অনেকে স্কুলের গন্ডিই পাড় হননি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিএনপির প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের নামে রয়েছে পুলিশ হত্যাসহ মোট ১২টি মামলা। এসব মামলাগুলোর মধ্যে রাজশাহী নগরীর চার থানায় রয়েছে ৯টি। নির্বাচন কমিশনে দেয়া বুলবুলের হলফনামা ঘেটে জানা যায়, তার বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগ ২০১১ সাল থেকে ২০১৬ পর্যন্ত ১২টি মামলা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে পুলিশ কনস্টেবল সিদ্ধার্থ সরকার হত্যা, বিস্ফোরকদ্রব্য ও নাশকতা। পুলিশ কনস্টেবল সিদ্ধার্থ সরকার হত্যা মামলায় ইতোমধ্যে চার্জশিট হয়েছে। সে মামলায় তিনি জেলও খেটেছেন। বাকি ৮টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এছাড়া অপর ৪টি মামলা হাইকোর্ট থেকে স্থগিত করে রাখা হয়েছে। এছাড়াও জাতীয় পার্টির মনোনয়ন প্রার্থী হাবিবুর রহমানের নামে রয়েছে ১টি মামলা। বুলবুলের বিরুদ্ধে যতগুলো মামলা দায়ের করা হয়েছে সবগুলোই রাজশাহীর থানা ও আদালতে। বাংলাদেশ জাতীয়পার্টির মনোনীত মেয়র প্রার্থী হাবিবুর রহমানের নামে কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রতারণার মামলা রয়েছে। যা বিচারাধীন। জানা গেছে, বুলবুলের বিরুদ্ধে পুলিশ কনস্টেবল সিদ্ধার্থ সরকার হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মহানগর গোয়েন্দা শাখা পুলিশের পরিদর্শক মোঃ নূর হোসেন খন্দকার এজাহার নামীয় ৯০ আসামির মধ্যে তদন্ত সাপেক্ষে ৮৮ জনকে অভিযুক্ত করেন। বাকি দু’জনের নাম-পরিচয়ে মিল না থাকায় তাদের চার্জসিট থেকে বাদ দেয়া হয়। তদন্তে এজাহার নামীয় আসামির বাইরে আরও একজনের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৮৯ জনে। পরে এই মামলায় চার্জসিট দাখিল করা হয়। জানা গেছে, শুধু বুলবুলই নয় এবার বিএনপি থেকে যেসব কাউন্সিলর প্রার্থী নির্বাচন করছেন তাদের বেশিরভাগেরই বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগে মামলা রয়েছে। অধিকাংশ কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগ একাধিক মামলা রয়েছে। বেশির ভাগই বিচারাধীন রয়েছে। নাশকতা মামলায় বিএনপির বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর জেলও খেটেছেন। বিশেষ করে ১০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত এসব মামলা হয়েছে। এছাড়া বিএনপির সরকার পতনের ডাক দিয়ে কর্মসূচী পালনকালে জ্বালাও পোড়াও পেট্রোল বোমা দিয়ে গাড়ি পোড়ানো, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষসহ বিভিন্ন কারণে এসব মামলা দায়ের করা হয়। এসব মামলায় কাউন্সিলর আনোয়ারুল আজব আজীম, প্যানেল মেয়র ও নারী কাউন্সিলর নুরুন্নাহারসহ বেশকিছু কাউন্সিলর জেল খেটেছেন। রাজশাহী জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা আতিয়ার রহমান জানান, প্রার্থীদের মামলা থাকলে কোন সমস্যা নেই। তবে কোন প্রার্থীর বিরুদ্ধে যদি কোন মামলায় আদালত থেকে ওয়ারেন্টজারি থাকে তবে সেক্ষেত্রে তার মনোনয়নপত্র বাতিল করা হবে। তিনি জানান, মেয়র বা কাউন্সিলর পদে যারা এবার অংশ নিচ্ছে তাদের হলফনামা পুলিশ দিয়ে তদন্ত করে নেয়া হয়েছে। যেসব প্রার্থী হলফনামায় মামলার বিষয়টি উল্লেখ করেছেন তাদের মামলাগুলোর অবস্থাও খতিয়ে দেখা হয়েছে। যদি প্রার্থীরা হলফনামায় মামলায় ওয়ারেন্টভুক্ত থাকার পর উল্লেখ না করে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পেলে তার প্রার্থিতা বাতিল করা হবে। এদিকে মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ইফতেখায়ের আলম জানান, বিএনপির মেয়র প্রার্থীসহ অনেক কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে নাশকতার অভিযোগে নগরীর ৪ থানায় ৯টি রয়েছে। মামলাগুলো আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। ইতোমধ্যে অনেক মামলায় চার্জসিট দেয়া হয়েছে। তবে মেয়র বা কোন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে আপাতত গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি নেই বলে জানান তিনি। কাউন্সিলর প্রার্থীর তালিকায় মাদক কারবারি ॥ এদিকে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন (রাসিক) নির্বাচনে এবার সাধারণ কাউন্সিলর পদে এক চিহ্নিত মাদক কারবারি প্রার্থী হয়েছেন। নির্বাচন কমিশনে তার মনোনয়নপত্র বৈধ বলেও ঘোষণা হয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই ধরনের ব্যক্তি কাউন্সিলর নির্বাচিত হলে ওয়ার্ডের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রতিনিয়ত খারাপের দিকেই যাবে। রাসিকের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের এই কাউন্সিলর প্রার্থীর নাম জহিরুল ইসলাম। তিনি ওই ওয়ার্ডের চন্ডিপুর মহল্লার আবদুর রাজ্জাকের ছেলে। সর্বশেষ গত ২ এপ্রিল নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা থানা পুলিশ জহিরুল ও তার এক সহযোগীকে একটি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, চার রাউন্ড গুলি ও ১২ হাজার পিস ইয়াবাসহ গ্রেফতার করে। নগরীর হড়গ্রাম এলাকায় গভীর রাতে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে এক যুবককে তুলে নিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ তাদের গ্রেফতার করেছিল। এ ঘটনায় জহিরুলের বিরুদ্ধে দুটি মামলা দায়ের হয়। এরপর থেকেই তিনি কারাগারে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপারের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের শাস্তিস্বরূপ জহিরুলকে কাশিমপুর কারাগারে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আসন্ন সিটি নির্বাচনে কাউন্সিলর পদের প্রার্থী হিসেবে তার মনোনয়নপত্র তোলা হয়েছে। জহিরুলের বিরুদ্ধে মোট মামলা রয়েছে ৬টি। নির্বাচন কমিশনে দাখিল করা জহিরুলের হলফনামায় এ তথ্য দেয়া হয়েছে। মোট ৬ মামলার মধ্যে পবা থানার একটি হত্যা মামলার বিচার চলছে রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। অন্য পাঁচটি মামলারও বিচার কাজ চলছে বিভিন্ন এলাকায়। জহিরুল ইসলামকে এলাকার মানুষ একজন চাঁদাবাজ ও সন্ত্রাসী হিসেবেই চেনেন। তারপরও এই ব্যক্তি এবার কাউন্সিলর পদের প্রার্থী। এলাকার লোকজন জানান, জহিরুলের আত্মীয়-স্বজন তার পক্ষে মনোনয়নপত্র তুলেছেন। তারা জহিরুলকে ভোট দেয়ার জন্য নানাভাবে হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। এ অবস্থায় এলাকার ভোটাররা আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন। তবে জহিরুলের ভয়ে কেউ এ নিয়ে প্রতিবাদের সাহস পাচ্ছেন না। জহিরুলের প্রার্থিতার বিষয়ে জানতে চাইলে জেলার সিনিয়র নির্বাচন কর্মকর্তা আতিয়ার রহমান বলেন, মামলা থাকলেও আইনে প্রার্থিতার সুযোগ রয়েছে। তবে কোন মামলায় দুই বছরের বেশি কারাদ- হয়ে থাকলে তার প্রার্থিতার সুযোগ নেই। বিধি অনুযায়ী জহিরুল প্রার্থিতার সুযোগ পাচ্ছেন বলেও জানান তিনি। তবে এ ধরনের প্রার্থী জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হলে এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির প্রতিনিয়ত অবনতি হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। কাউন্সিলর প্রার্থীর অর্ধেক স্কুলের গ-ি পার হননি ॥ রাজশাহী সিটি কর্পোরেশনের সাধারণ ওয়ার্ডে ১৬৩ জন কাউন্সিলর পদে তাদের মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এদের মধ্যে অর্ধেক প্রার্থী স্কুলের গ-ি পার হতে পারেননি। যারা স্কুলের গ-ি পার হতে পারেননি, তাদের অধিকাংশ আবার হলফনামায় নিজেকে স্বশিক্ষিত বা স্বাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন বলে উল্লেখ করেছেন। হলফনামায় উল্লেখ করা প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতার এমন হাল থেকে সুশাসনের জন্য নাগরিক রাজশাহীর আঞ্চলিক সমন্বয়কারী সুব্রত পাল বলেন, ‘তার মানে যারা শিক্ষিত তারা নির্বাচনে আসছে না। নির্বাচনের সেই পরিবেশ এখনও দেশে সৃষ্টি না হওয়ায় শিক্ষিতরা নিজেদের গুটিয়ে রাখছে।’ নির্বাচন কমিশনে দেয়া প্রার্থীদের হলফনামা থেকে জানা গেছে, স্নাতক বা তার চেয়ে বেশি লেখাপড়া করেছেন ১৮ জন। স্নাতক বা সমমানের ২৪ জন, এইচএসসি ৩৬ জন, এসএসসি ১৯ জন, অষ্টম শ্রেণী বা তার চেয়ে নিচে ৩০ জন, স্কুলে যাননি বা স্বাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন ৩৫ জন এবং ডিপ্লোমা প্রকৌশলী একজন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি নগরীর ১৮ নম্বর ওয়ার্ডে অষ্টম শ্রেণী বা তার নিচে শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রার্থী আছেন। এছাড়া ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী তৌহিদ সুমন প্রথমে নিজেকে স্বাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন লিখলেও পড়ে তা কেটে এমএসএস পাস উল্লেখ করেছেন। যদিও এ কাউন্সিল প্রার্থীর বিরুদ্ধে যৌনচারের অভিযোগ রয়েছে। এলাকাবাসীর তোপের মুখে তিনি এলাকাছাড়াও ছিলেন। বিস্তর অভিযোগ উঠায় সম্প্রতি তাকে নগর যুবলীগ থেকেও বহিষ্কার করা হয়েছে। লিটন-বুলবুল কোলাকুলি ॥ খায়রুজ্জামান লিটন রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক মেয়র। আর মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল মহানগর বিএনপির সভাপতি ও সদ্য বিদায়ী মেয়র। আগামী ৩০ জুলাই রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রধান দুই প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে লড়ছেন লিটন ও বুলবুল। রাসিক নির্বাচনে প্রধান দুই দলের প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থী তারা। দুই মেরুতে অবস্থান করেও শুক্রবার দুইজনকে কোলাকুলি ও কুশল বিনিময়ে দেখা গেল। শুক্রবার বিকেল ৪ টা ১৫ মিনিটে রাজশাহীতে একটি টেলিভিশনের নির্বাচনী টকশোর দৃশ্যধারণ শুরু হয়। প্রায় ৫০ মিনিটের টকশোতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা নিজেদের সফলতা ও অপরের ব্যর্থতার বিষয়গুলো তুলে ধরেন। অনুষ্ঠানের শেষের দিকে উপস্থাপক খায়রুজ্জামান লিটন ও বুলবুলের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কের কথা তুলে ধরে নির্বাচনের পরেও এমনই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখার জন্য আহ্বান জানিয়ে টকশো শেষ করেন। টকশোতে খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, আমি মেয়র থাকলেও রাজশাহীবাসীর উন্নয়নের কথা চিন্তা করে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে গেছি, যাতে রাজশাহীর উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্প পাওয়া যায়। কিন্তু সদ্য বিদায়ী মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল মেয়র হয়েও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন নি। এমনকি প্রধানমন্ত্রী কয়েকবার রাজশাহীতে আসলেও বুলবুল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন নি। উন্নয়নের জন্য কোন প্রকল্প ও বরাদ্দ চাননি প্রধানমন্ত্রীর কাছে। এতে করে পিছিয়েছে রাজশাহী। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে খায়রুজ্জামান লিটনের সঙ্গে কথা না বলেই দ্রুতগতিতে হাটতে শুরু করেন বুলবুল। এ সময় বুলবুল হেটে চলে যাচ্ছেন দেখতে পেয়ে তার দিকে কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে বুলবুলকে বুকে জড়িয়ে নেন এবং কোলাকুলি করেন লিটন। এ সময় উপস্থিত সবাই জাতীয় চার নেতার অন্যতম শহীদ এএইচএম কামারুজ্জামান হেনার ছেলে খায়রুজ্জামান লিটনের প্রশংসা করেন। উল্লেখ্য, রাজনীতির বাইরে এসে মানবিকতা ও মহানুভবতার পরিচয় প্রদান খায়রুজ্জামান লিটনের এই প্রথম দিলেন, তা নয়। এর আগে গত ২৮ জুন রাসিক নির্বাচনের মনোনয়নপত্র জমাদানের শেষ দিনে নির্বাচনের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলের অসুস্থ সন্তানকে দেখতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন। এর আগে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা, সাবেক রাসিক মেয়র মিজানুর রহমান মিনু অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে বাসায় দেখতে গিয়েছিলেন খায়রুজ্জামান লিটন।
×