ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

এগিয়ে চলেছে এলজি এসপির তৃতীয় পর্যায়

উন্নয়ন এখন নিচের ধাপ থেকে ওপরের দিকে যাচ্ছে

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৭ জুলাই ২০১৮

  উন্নয়ন এখন নিচের ধাপ থেকে ওপরের দিকে যাচ্ছে

সমুদ্র হক ॥ উন্নয়ন এখন নিচের ধাপ থেকে ওপরের দিকে যাচ্ছে। এই পরিকল্পনায় মাঠ পর্যায়ের মানুষের চাহিদার ভিত্তিতেই ইউনিয়ন পরিষদের উন্নয়নের লোকাল গবর্নেন্স সাপোর্ট প্রজেক্টের (এলজিএসপি) তৃতীয় পর্যায়ের কাজ এগিয়ে চলেছে। এবারেরও মেয়াদ পাঁচ বছর। এর আগে প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজের শত ভাগ সাফল্য এসেছে। সূত্র জানায় তৃতীয় পর্যায়েও দেশের সবগুলো ৪ হাজার ৫ শ’ ৫০টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সঙ্গে এই প্রথম ১৬টি পৌরসভা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ব্যয়ের প্রাক্কলন করা হয়েছে ৫ হাজার ৫ শ’ ৩৫ কোটি টাকা। এই অর্থের মধ্যে কিছু অংশ বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ হিসেবে নেয়া হয়েছে। দেশকে দ্রুত মধ্যম আয়ের দিকে এবং এসডিজি অর্জনে এগিয়ে নিতে এলজিএসপির বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে। বিশ্বের সকল উন্নত দেশে উন্নয়নের পরিকল্পনা করা হয় একেবারে মাঠ পর্যায়ের মানুষের চাহিদার ভিত্তিতে। উন্নয়ন এগিয়ে যায় ওপরের দিকে। বাংলাদেশেও এলজিএসপি কার্যক্রম শুরু হয়েছে সেভাবেই। নিচের দিকের মানুষের চাহিদার ভিত্তিতে উন্নয়ন এগিয়ে চলেছে ওপরের দিকে। এতে উন্নয়নের সমতা থাকছে। ইংরেজী এলজিএসপির বাংলা অনুবাদ করলে দাঁড়ায়, স্থানীয় সুশাসনে সহযোগিতা প্রকল্প। মাঠ পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে এলজিএসপির মাধ্যমে। প্রতিটি ইউনিয়নের আয়তন ও জনসংখ্যার ভিত্তিতে বরাদ্দ মেলে। প্রকল্পের প্রতিটি স্কিম গ্রহণ করা হয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে ওয়ার্ড সভায় জনগণের মতামতের ভিত্তিতে। প্রস্তাবগুলো গ্রহণ করে পাঠানো হয় উপজেলা নির্বাহী অফিসারের (ইউএনও) কাছে। তারপর উপজেলা পরিষদের সভায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সর্বসম্মতিক্রমে প্রকল্প পাশ করা হয়। প্রকল্পের ৩০ শতাংশ কাজ বাস্তবায়িত হয় নারীদের দ্বারা প্রণীত সংস্কার ও উন্নয়ন কাজের স্কিম। প্রকল্পের ওয়ার্ড ভিত্তিক সকল বৈঠকে নারীর অংশগ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কর্মসূচীর সকল কমিটিতে নারীদের মতামত না থাকলে সেই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয় না। এভাবে নারীর ক্ষমতায়নে এলজিএসপি বড় ভূমিকা রেখেছে। প্রতিটি উন্নয়ন মনিটরিং ও অডিট করা হয় নিবিড়ভাবে। এ জন্য রয়েছে প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট ইউনিট। জাতীয় প্রকল্প পরিচালক, উপ-প্রকল্প পরিচালক, উর্ধতন কনসালটেন্ট, মাঠ পর্যায়ে জেলার উপ-পরিচালক স্থানীয় সরকার বিভাগ ও জেলা ফ্যাসিলিটেটর (ডিএফ)। এলজিএসপির বগুড়ার জেলা ফ্যাসিলিটেটর (ডিএফ) মইনুল আলম জানান, তৃতীয় পর্যায়ের দ্বিতীয় বর্ষের কাজ শুরু হয়েছে। বগুড়া জেলার প্রথম বর্ষের সাফল্য সন্তোষজনক। অডিট আপত্তিতে যে ত্রুটিগুলো পাওয়া গেছে তা সেরে নেয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে যে ৯২টি ইউপির জন্মনিবন্ধনের অর্থ জমা হয়নি তা জুন মাসের মধ্যে সরকারী খাতে জমা হয়েছে। যে পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ টাকা। এলজিএসপির নির্দেশিকায় বলা আছে যে, ইউনিয়নে অডিট আপত্তি থাকবে সেই ইউনিয়নে বাৎসরিক বরাদ্দের ২৫ শতাংশ দেয়া হবে। আপত্তি নিষ্পত্তি হওয়ার পর বাকি ৭৫ শতাংশ দেয়া হবে। সেভাবেই প্রতিটি ইউনিয়নে উন্নয়ন কাজে জবাবদিহিতা এসেছে। এ ছাড়াও প্রতিটি ইউনিয়নের ভাল কর্মকা-ের ওপর ৪০ নম্বর বরাদ্দ করা আছে। যে ইউনিয়ন পারফরমেন্সে ৪০ নম্বর পাবে তাদের উন্নয়নে বাড়তি বরাদ্দ দেয়া হবে। বগুড়ার ১ শ’ ৮টি ইউপির মধ্যে ৬০টি ইউপির পারফরমেন্স ভাল। বাকিগুলোও চেষ্টা করছে। বগুড়ায় গেল বছর সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে শেরপুর উপজেলার গাড়িদহ ইউপিতে। পরিমাণ ছিল ৩৪ লাখ ৮৮ হাজার ৫ শ’ ৭৮ টাকা। সবচেয়ে কম বরাদ্দ ছিল শাজাহনপুরের আমরুল ইউপিতে। বরাদ্দ ছিল ৪ লাখ ৩৯ হাজার ৭ শ’ ৫৩ টাকা। এত কম অর্থ বরাদ্দের বিষয়ে ডিএফ মইনুল আলম বলেন, ওই ইউনিয়নে অডিট আপত্তি থাকায় ২৫ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়। অডিটের কারণগুলো সমাধানের পর বাকি ৭৫ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হবে। ইতোমধ্যে জুলাই মাস থেকে দ্বিতীয় বছরের বরাদ্দের অর্থ প্রতিটি ইউনিয়নের ব্যাংকের হিসাবে জমার কাজ শুরু হয়েছে। এলজিএসপির বরাদ্দের অর্থ ইউনিয়নগুলোর উন্নয়ন কর্মকান্ডের রিপোর্টের ওপর আপনা-আপনি চলে যায়। প্রতিটি ইউনিয়নে বরাদ্দ মেলে জনসংখ্যা ও আয়তনভেদে ২০ লাখ টাকা থেকে ৩৭ লাখ টাকা পর্যন্ত। বরাদ্দের অর্থে গেল বছর বগুড়ার ইউপিগুলোতে ১ হাজার ৯ শ’ ৯৭টি স্কিম বাস্তবায়িত হয়েছে। গ্রাম উন্নয়নে এলজিএসপি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। বছর কয়েক আগেও যে গ্রামের প্রসূতি রাস্তা এবড়ো খেবড়ো থাকায় হাসপাতালে পৌঁছতে পারত না তারা এখন সময় মতো ম্যাটারনিটি সেন্টারে পৌঁছে। সুস্থ শিশুর জন্ম দেয়। মা ও শিশু নিরাপদে থাকে। এলজিএসপি এভাবে টেকসই উন্নয়ন অভিষ্ট (এসডিজি) অর্জনেও সহযোগী হয়েছে। গ্রামে পল্লী বিদ্যুত না গেলে সোলার প্যানেলে বিদ্যুতায়িত হয় প্রতিটি ঘর। গ্রামের কোথায় কি করতে হবে চাহিদার নিরূপণ ও অগ্রাধিকার নির্ধারণ ওয়ার্ডের লোকজনই ইউপিকে জানায়। ইউপি ওয়ার্ডের ৫ শতাংশ ভোটারের উপস্থিতিতে সিদ্ধান্ত নেয় ও জবাবদিহিতা করে। পরিষদ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ছোটখাট অবকাঠামো নির্মাণ কাজ করে। কোন স্কিম বাস্তবায়িত করার আগে পুরুষ ও নারীর সমন্বয়ে দেখভাল (সুপারভাইজার) কমিটি গঠিত হয়। এলজিএসপির বগুড়ার ডিএফ জানিয়েছেন, গ্রামের মানুষের মতামতের আলোকে জনগণের চাহিদা নিরূপণ করে রাস্তাঘাট ছোট ব্রিজ, বক্স কালভার্ট, স্যানিটেশন, সকল সংস্কারসহ ছোটখাট সকল কাজই থাকে জবাবদিহিতা। এলজিএসপি প্রথম পাইলট প্রকল্প করে সিরাজগঞ্জ। এর সাফল্যের পরই গ্রাম উন্নয়নে জবাবদিহিতার আওতায় ৫ বছর মেয়াদের কর্মসূচী চালু করে। ২০০৬ সালে প্রথম পর্যায়ের এলজিএসপি শুরুর পর পাঁচ বছরের সফলতায় দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ শুরু হয় ২০১১ সালে। সফলতার ধারবাহিকতায় বর্তমানে তৃতীয় পর্যায় শুরু হয়েছে গেল বছর ২০১৭ সালে। ওই বছর ৩১ জানুয়ারি একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এলজিএসপির অর্থ বরাদ্দ দেন। কাজের সফলতার ওপর ভিত্তি করে চতুর্থ পর্যায় ও ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে, এমনটি জানিয়েছে সূত্র। এভাবে নির্ধারিত সময়ের আগেই দেশ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হবে। একই সঙ্গে নির্দিষ্ট সময়ের (২০৩০ সাল) আগে এসডিজি অর্জন করতে সক্ষম হবে। সাফল্যের একটি ইউনিয়ন বগুড়ার গাড়িদহ। এই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জমির উদ্দিন বলেন, এলজিএসপির বরাদ্দ যেভাবে এবং যে জবাবদিহিতার মধ্যে আসে তাতে গ্রামের নারী পুরুষের সরাসরি অংশগ্রহণে উন্নয়নের গতি বাড়ে। সকল মানুষের মতামত প্রকাশের সুযোগ থাকে। গেল বছর তিনি যে অর্থ পেয়েছেন দ্রুত উন্নয়ন কাজ করার পর সাফল্যের ভিত্তিতে দক্ষতা ভিত্তিক বরাদ্দ পেয়েছেন। চলতি বছর যে অর্থ বরাদ্দ মিলবে তা বাস্তবায়নে ওয়ার্ডের মানুষকে ডেকে বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বগুড়ার শেখেরকোলা ইউনিয়নের গ্রামে ইতোমধ্যে মাটি কেটে কয়েকটি সংযোগ রাস্তা বানিয়ে দুই ধারে নারকেলের চারা রোপিত হয়েছে। সবজি উৎপাদন প্রধান এই ইউনিয়নে ছোটখাট অবকাঠামো উন্নয়নের পাশাপাশি জনস্বার্থের প্রয়োজনীয় সকল কাজই করা হয়। সবজি উৎপাদনেও এলজিএসপির অর্থে ইক্যুইপমেন্ট কেনা হয়। বগুড়ার স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক সুফিয়া নাজিম জানালেন, এলজিএসপির কাজে সফলতা এসেছে। ওয়ার্ড কমিটির প্রকল্প বাস্তবায়নের সফলতায় বাড়তি বরাদ্দ আসে। এই কাজের বৈশিষ্ট হলো দেখভাল ও গ্রামের উন্নয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণে গাঁয়ের মানুষের সঙ্গে বর্তমান ও সাবেক জনপ্রতিনিধিও থাকেন। একইভাবে বছরের বাজেট পেশ করা হয় সময়ের দুই মাস আগে। এই বাজেটের ওপর আলোচনা যোগ-বিয়োগ করার পর উপজেলা নির্বাহী অফিসার তা অনুমোদন দেন। স্থানীয় সরকার পর্যায়ের সর্বনিম্ন ধাপ ইউনিয়ন পরিষদকে আগে যেভাবে মূল্যায়ন করা হতো এখন তা পাল্টেছে।
×