ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বরিশাল সিটি নির্বাচন

জনপ্রিয়তার শীর্ষে সাদিক, দুশ্চিন্তায় সরোয়ার

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ৭ জুলাই ২০১৮

জনপ্রিয়তার শীর্ষে সাদিক, দুশ্চিন্তায় সরোয়ার

খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল ॥ আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের ভোটারদের কাছে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। নির্বাচনের দিন যতই ঘনিয়ে আসছে সাদিকের জনপ্রিয়তা ততই বেশি বেড়ে চলেছে। বিএনপি মনোনীত মেয়র প্রার্থী ও বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মজিবর রহমান সরোয়ারের তুলনায় রাজনীতিতে নবীন ও বয়সেও অনুজ আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর পক্ষে প্রতীক বরাদ্দের আগেই নির্বাচনী মাঠে নৌকার জোয়ার সৃষ্টি হওয়ার বিষয়টি রাজনৈতিক অঙ্গনে বেশ আলোচিত ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কারণেই বিএনপি মনোনীত প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ারের নির্বাচনে জয়ের চেয়ে এখন ব্যক্তিগত প্রেস্টিজইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, বিশেষ করে সরোয়ার অনুসারি এমনকি তিনি (সরোয়ার) নিজেও বিষয়টি আমলে নিয়ে ছক আঁকছে কীভাবে অন্তত এই নির্বাচনী বৈতরণী পার পাওয়া যায়। চার বারের সাংসদ ও একবার মেয়র হিসেবে নির্বাচিত বিএনপির এই নেতা (সরোয়ার) নিজের জয়লাভ নিয়ে এখনই শঙ্কিত বলেও আভাস পাওয়া গেছে। কারণ নির্বাচনের দীর্ঘ প্রস্তুতির মধ্যে সাদিক আব্দুল্লাহ নিজের ইমেজ সাধারণ ভোটারদের মধ্যে তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। এমনকি দলগত সকল বিরোধ মিটিয়ে নির্বাচনী মাঠেও একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করে ফেলেছেন। বিষয়টি সরোয়ার দেখছেন ভিন্নভাবে। সরোয়ারের আশঙ্কা ক্ষমতাসীন দল তাদের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে নির্বাচন একপেশে করতে পারে। গত ৪ জুলাই বিকেলে বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটিতে সংবাদ কর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে মজিবর রহমান সরোয়ারের এ আশঙ্কা প্রকাশ পায়। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, ভোটের লড়াইয়ে তিনি (সরোয়ার) এবার কতটুকু টিকতে পারবেন সেই শঙ্কা থেকেই নির্বাচনী প্রচারে আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠে নামার পূর্বে হঠাৎ করে মিডিয়ার মুখোমুখি হওয়ার পেছনে অন্যতম কারণ। সরোয়ারের অনুসারিরাই বলছেন, অন্যান্য প্রার্থী অপেক্ষা এবারের নির্বাচনে মজিবর রহমান সরোয়ার হেভিওয়েটের প্রার্থী হলেও মাঠপর্যায়ে এখনও কোন সাড়া ফেলতে পারেননি। বিএনপির দলীয় নেতাকর্মীরা অজ্ঞাত কারণে নির্বাচন নিয়ে রয়েছেন নীরব। অথচ বিএনপির শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে বরিশালের পরিচিতি থাকলেও বর্তমান দৃশ্য বলছে ভিন্নকথা বরং বিএনপি যেখানে নীরব সেখানে আওয়ামী লীগের সর্বস্তরে নির্বাচনী তোড়জোড় চোখে পড়ার মতো। বিএনপির একাধিক সূত্রের দাবি, দলের শীর্ষ নেতা মজিবর রহমান সরোয়ার নিজেই নির্বাচনী মেজাজে নেই। অন্য একটি সূত্র বলছে, মজিবর রহমান সরোয়ার এবার প্রার্থী হতে চাননি। দলীয় হাইকমান্ড ও তারেক রহমানের পরিকল্পনায় সরোয়ারকে দলীয় মনোনয়ন দিয়ে মাঠে রাখার কৌশল করা হয়েছে। সূত্রগুলো আরও জানিয়েছেন, আগে থেকেই বিএনপির হাইকমান্ড আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে সাদিক আব্দুল্লাহর মনোনয়ন পাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত ছিল। সবদিক বিবেচনায় সাদিকের সঙ্গে লড়াইয়ে সরোয়ারই মোক্ষম প্রার্থী হওয়ায় তাকেই দল থেকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছে। সেই ভাবনা থেকেই বিএনপির হাইকমান্ড আগেভাগেই সরোয়ারকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে চূড়ান্ত করে রেখেছিল। তবে রাজনৈতিক কৌশলগত কারণে বরিশাল জেলা বিএনপির সভাপতি এবায়েদুল হক চাঁন ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিছ আক্তার জাহান শিরিনের নাম সম্ভাব্য প্রার্থিতার তালিকায় অগ্রভাগে রেখে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডকে গোলক ধঁাঁধার মধ্যে রাখতে চেয়েছিল। যাতে করে ক্ষমতাসীন দল থেকে সাদিক আব্দুল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে মনোনয়ন দেয়া হয়। তাহলেই একপ্রকার খালি মাঠে নির্বাচনী বিজয় ছিনিয়ে নিয়ে যেত বিএনপি।সূত্রমতে, আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডও বিএনপির এই কৌশল আঁচ করতে পেরে বিএনপির প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ারের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করার মতো যোগ্যতা রাখে এমন বিবেচনায় বয়সে তরুণ হলেও নির্বাচনী মাঠে গ্রহণযোগ্যতা অর্জনকারী সাদিক আব্দুল্লাহকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন নিশ্চিত করেন। তাছাড়া এই মুহূর্তে বরিশালের রাজনীতিতে সাদিকের বিকল্প কাউকে মনোনয়ন দেয়া হলে নির্বাচনী পরিবেশ পাল্টে যাওয়ার আশঙ্কাও ছিল। কারণ বরিশালের রাজনৈতিক মাঠ দীর্ঘদিন থেকে সাদিক আব্দুল্লাহর দখলে রয়েছে। খোদ বিএনপির নেতাকর্মীরাই বলছেন, সাদিককে প্রার্থী করায় নির্বাচনী লাড়াইয়ে যাওয়ার আগেই বিএনপি দিশেহারা হয়ে পড়েছে। আওয়ামী লীগের প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর ইয়াং ক্রেজ ও সব মহলে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা থাকায় সর্বত্র এই তরুণ নেতা বেশ শক্তপোক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন। তাছাড়া এই তরুণ নেতাকে নগর পিতা হিসেবে দেখতে চাচ্ছেন অধিকাংশ সাধারণ ভোটাররা। সবকিছু মিলিয়ে সাদিকের নির্বাচনী পরিবেশ অনুকূলে থাকায় সরোয়ার পড়েছেন চরম বেকায়দায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির একাধিক দায়িত্বশীল নেতারা বলেন, নির্বাচনী মাঠে নামার আগেই সরকার বিরোধী দলটি খেই হারিয়ে ফেলেছে। একদিকে নির্বাচনী মাঠে সাদিকের প্রভাব, অন্যদিকে বিএনপির ঘাড়ে প্রশাসনিক আতঙ্ক ভর করায় তারা নির্বাচনী মাঠে নামার ছক মিলাতে পারছেন না। যে কারণে মাঠে না নেমে খোদ দলীয় প্রার্থী মজিবর রহমান সরোয়ার নিজেই পরিস্থিতি দেখছেন। বিষয়গুলো নিয়ে ঘরোয়াভাবে নেতাকর্মীদের নিয়ে দফায় দফায় বৈঠক অব্যাহত রেখেছেন। দায়িত্বশীল নেতাদের এই আতঙ্কিত মনোভাব দেখে বিএনপির মাঠপর্যায়ের নেতাকর্মী এমনকি সমর্থকরাও নির্বাচন নিয়ে কোন কথা বলতে রাজি হননি। এ অবস্থায় নির্বাচনে বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে ভোটের লড়াই তীব্র হওয়ার কোন আলামত মিলছে না। বিএনপির গা ছাড়া ভাব দেখে আপনা আপনি আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী সাদিক আব্দুল্লাহর নির্বাচনী জোয়ার সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছে। ইতোমধ্যে দলমত নির্বিশেষে সাধারণ ভোটাররা আগামীর নগরপিতা হিসেবে সাদিককেই ভাবতে শুরু করেছেন। জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য ও পৌর মেয়র মোঃ হারিছুর রহমান বলেন, বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত হোসেন হিরণের মৃত্যুর পর দলকে সু-সংগঠিত করতে দিনরাত একাকার করে কাজ করেছেন সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ। জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের বিভাজন দূর করে বেশ স্বল্প সময়ে সকল নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ করে গত ৮ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বরিশাল সফরকালীন জনসভাকে জনসমুদ্রে পরিণত করতে অগ্রণী ভূমিকা ছিল সাদিক আব্দুল্লাহর। তিনি আরও বলেন, দক্ষিণ বাংলার আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক অভিভাবক পার্বত্য শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক (মন্ত্রী), বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহর জ্যেষ্ঠ পুত্র সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ ইতোমধ্যে বরিশাল মহানগরীর ৩০টি ওয়ার্ডের যেগুলোতে পূর্ণাঙ্গ কমিটি ছিল না সেখানে ওয়ার্ড কমিটি করাসহ দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ইউনিট কমিটিও গঠন করেছেন। পাশাপাশি তাদের নির্বাচনে কাজ করার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সাধারণ জনগণের মন জয় করে নেয়া আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহর দাদা সাবেক কৃষি মন্ত্রী শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভগ্নিপতি এবং এই অঞ্চলের অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতা। সাদিক আব্দুল্লাহর বাবা পার্বত্য শান্তিচুক্তির রূপকার আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং সাবেক চীফ হুইপ। মুজিব আদর্শে বিশ^াসী রাজনৈতিক পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম হিসেবে সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহকে বরিশালবাসী তাদের একজন করে গ্রহণ করেছেন অনেক আগেই। এখন বঙ্গবন্ধুর এই উত্তরসূরিকে মেয়র নির্বাচিত করে বরিশালের উন্নয়নের মূল দায়িত্ব তার কাছে দিবেন বলেও উল্লেখ করেন জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য হারিছুর রহমান। ১৩ মামলার আসামি বিএনপির প্রার্থী ॥ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আটজন মেয়র প্রার্থীর মধ্যে দুইজনের মনোনয়নপত্র বাতিল করা হলেও আপীলের মাধ্যমে জাতীয় পার্টির দলীয় প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস তার প্রার্থীতা ফিরে পেয়েছেন। এখন পর্যন্ত সাতজন মেয়রপ্রার্থীর তালিকা চূড়ান্ত রেখেছে নির্বাচন কমিশন। সিটি কর্পোরেশনের রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে মনোনয়নপত্রের সঙ্গে প্রার্থীদের হলফনামায় মেয়র প্রার্থীদের উল্লেখ করা তথ্যে জানা গেছে, সিটি কর্পোরেশনের প্রথম পরিষদের নির্বাচিত সাবেক মেয়র, বরিশাল সদর আসনের চার বারের সাবেক এমপি ও সাবেক হুইপ মজিবর রহমান সরোয়ার বর্তমানে কেন্দ্রীয় বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও বরিশাল মহানগর বিএনপির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। তথ্যানুযায়ী এলএলবি পাস সরোয়ারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময় দায়ের হওয়া হত্যা, নাশকতা, দুর্নীতি, আয়কর ফাঁকিসহ ১৮টি মামলার মধ্যে পাঁচটি থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন। তবে এখনও ১৩টি মামলায় তিনি আসামি রয়েছেন। আর এর প্রত্যেকটি মামলাই আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। মামলাগুলোর মধ্যে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন, আয়কর অধ্যাদেশ, দুর্নীতি দমন আইন, অস্ত্র আইন, পাসপোর্ট আইন, সরকারী কাজে বাধা, হত্যাসহ বিভিন্ন ধারা রয়েছে। আর এসব মামলার মধ্যে সাতটি বরিশালে ও ছয়টি ঢাকার বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। বাসদ মনোনীত মেয়র প্রার্থী ডাঃ মনিষা চক্রবর্তীর বিরুদ্ধেও বিশেষ ক্ষমতা আইনের একটিসহ দুটি মামলা আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। যার একটি মামলা বরিশালে অপরটি ময়মনসিংহে। এ ছাড়া জাতীয় পার্টির দলীয় প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপসের বিরুদ্ধে প্রতারণার ধারা সংবলিত দুটি মামলা রয়েছে। যদিও মামলা দুটির ওপরে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট ডিভিশন কর্তৃক স্থগিতাদেশ রয়েছে। জাপা প্রার্থীর মতবিনিময় সভা ॥ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) মনোনীত লাঙ্গলের মেয়র প্রার্থী ইকবাল হোসেন তাপস বলেছেন, আমাকে বরিশালবাসী ভোট দিয়ে নির্বাচিত করলে আমি কখনও নগর পিতা বা ভাই হব না। আমি নগরবাসীর সেবক হয়ে বরিশালের সম্মানিত জ্ঞানীগুণিদের সমন্বয়ে বরিশাল শহরকে আধুনিক নান্দনিক শহরে রূপ দেয়ার কাজ করে যাব। এখানে সব বড় দলের প্রার্থী রয়েছে আমার সঙ্গে আরও দুইজন মেয়র প্রার্থী রয়েছে এদের ভেতর একজন রাজনৈতিক পরিবারের সন্তান তার আত্মীয়-স্বজনরা সরকারে রয়েছে আরও একজন দীর্ঘদিনের মাঠের রাজনৈতিক নেতা। আমাকে বরিশালবাসী ঠিকমতো চেনেন না, জানেন না। শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টায় বরিশাল রিপোর্টার্স ইউনিটির কার্যালয়ে সংবাদ কর্মীদের সঙ্গে এক মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন।
×