ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ফেরদৌসী মজুমদারের নতুন বই ঘিরে সুহৃদ সমাবেশ

এখন লিখতে গিয়ে দেখছি, হায়, জীবন ফুরিয়ে এসেছে...

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ৭ জুলাই ২০১৮

এখন লিখতে গিয়ে দেখছি, হায়, জীবন ফুরিয়ে এসেছে...

একটা দারুণ ব্যাপার ঘটে গেল বলতে হবে। অনুষ্ঠানের চরিত্রটি সাধারণত যেমন হওয়ার কথা, যা এ ধরনের আয়োজনে হয়ে-টয়ে থাকে, তার থেকে স্পষ্টতই আলাদা ছিল শুক্রবারেরটি। এদিন শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে বিশেষ এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। নতুন বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠান। এতে কমন বৈশিষ্ট্যগুলো যথারীতি অনুসরণ করা হয়। তবে আবেদন ছিল স্বতন্ত্র। আলাদা গুরুত্বের হয়ে উঠেছিল অনুষ্ঠানটি। এর অনেকগুলো কারণ। মূল কারণ-ফেরদৌসী মজুমদার। ঢাকার মঞ্চের অত্যুজ্জ্বল তারকা। টেলিভিশনের প্রিয় মুখ। সুঅভিনেত্রী। তবে তিনি অনুষ্ঠানের মধ্যমণি হয়েছিলেন লেখিকা পরিচয়ে। ফেরদৌসী মজুমদার ইতোমধ্যে কয়েকখানা পুস্তক রচনা করেছেন। এখনও লিখছেন। যখন যা মনে আসে নিজের মতো করে লিখে রাখেন তিনি। গত ১৮ জুন ছিল কিংবদন্তি শিল্পীর জন্মদিন। বিশেষ দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত হয়েছে তার আরও একখানা নতুন বই। নিজের লেখা বইটি ঘিরেই অনুষ্ঠান। থিয়েটার আয়োজিত অনুষ্ঠান, কী আশ্চর্য, সুহৃদ সমাবেশে রূপ নিয়েছিল। অন্যরকম এক মিলনমেলা কী যে উপভোগ করেছেন সবাই! বিষয় যেহেতু লেখালেখি, বক্তা হয়ে এসেছিলেন ড. আনিসুজ্জামান, শামসুজ্জামান খান, আনিসুল হকের মতো খ্যাতিমানরা। নাট্যজনদের প্রতিনিধি হয়েছিলেন নাসির উদ্দীন ইউসুফ। এসেছিলেন তাসমিমা হোসেন, মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর প্রমুখ। আর লেখিকার ঘরের মানুষটি, লেখিকাকে আগলে রাখার মানুষটি রামেন্দু মজুমদার। তিনি ছিলেন পুরোভাগেই। মঞ্চের সামনে যে দর্শক সারি, সেখানেও অনেক চেনা মুখ। বিশিষ্টজনদের আনাগোনা। ফেরদৌসী মজুমদারের অভিনয়ের ভক্ত অনুরাগী তরুণ তরুণীরা এসেছিলেন ঝাঁকে ঝাঁকে। সকলের উপস্থিতিতে নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। মঞ্চে তখন বড় বড় মানুষ। ভারি ভারি কথা হতেই পারত। তা হলো না। সবাই সহজ করে বলার চেষ্টা করলেন। এ কাজে, নিশ্চিত করেই বলা যায়, তাদের উৎসাহিত করেছে নতুন বইয়ের নামটি। বইয়ের নাম- যা ইচ্ছা তাই। ফেরদৌসী মজুমদারের বয়স এখন ৭৫ বছর। এত দেখেছেন, করে দেখিয়েছেন, অভিজ্ঞতায় পূর্ণ তিনি। লেখার রসদ আছে তার কাছে। অথচ তিনি কিনা যা ইচ্ছা তাই লিখেছেন! এ হতে পারে না। তাই আগেভাগে বইটি হাতে নিয়ে, পাতা উল্টে এমন সরল নামকরণের রহস্য ভেদ করার চেষ্টা করেন মঞ্চে আমন্ত্রিতরা। এবং তারা তখনই হয়ত নিশ্চিত হয়ে যান যে, যা তা লেখা হয়নি বইতে। সহজবোধ্য করতেই এমন নাম বেছে নেয়া। এবং বক্তারাও সহজ লেখার মতো সহজ ভাষায় বই ও তার লেখিকাকে বিশ্লেষণ করতে প্রয়াসী হন। তাদের বক্তৃতায় গাম্ভীর্য ধরে রাখার অহেতুক চেষ্টা ছিল না। উল্টো হাসিরাশি হয়েছে খুব। বইয়ে নানা শিরোনামে মোট ১৭টি লেখা। একটি লেখায় প্রসঙ্গ হয়ে এসেছেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আরও অনেকের সঙ্গে ফেরদৌসী মজুমদারকে পড়িয়েছেন। কেমন পড়িয়েছেন তা সকলকে জানাতে ছাত্রীর লেখা থেকে উদ্ধৃত করেন তিনি, যেখানে বলা হয়, ‘আনিসুজ্জামান স্যার আমাদের রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন পড়াতেন- কী ভালই পড়াতেন।’ বইয়ের এই অংশটুকু সবচেয়ে খাসা বলে মন্তব্য করেন তিনি। এমন রসবোধে একসঙ্গে হেসে ওঠে মিলনায়তন। পরে আনিসুজ্জামান ছাত্রীর লেখার স্বীকৃতি দেন। বলেন, বইয়ে ফেরদৌসীর বলার যে ভঙ্গি, সেটি ভীষণ আকর্ষণ করে। তার কৃতজ্ঞতার বোধ আছে। চারপাশের চরিত্রগুলো পর্যবেক্ষণ করে নিজে সেই চরিত্র হুবহু অঙ্কন করতে জানে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানও বলেন, ফেরদৌসী মজুমদারের লেখার ভঙ্গি স্বকীয়। বলায় অভিনেত্রীর ভাই শহীদ মুনীর চৌধুরীর প্রভাব আছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, আমি ফেরদৌসী আপাকে ৪০ বছর ধরে চিনি। তিনি পরিবার সমাজ রাষ্ট্র রাজনীতিকে যেভাবে দেখেছেন বইতে সেভাবেই তুলে ধরেছেন। কথা সাহিত্যিক আনিসুল হক ‘যা ইচ্ছা তাই’ লিখতে পারাকে লেখার স্বাধীনতা হিসেবে বর্ণনা করেন। তাসমিমা হোসেন পাঠ প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, চমৎকার একটা ‘যা ইচ্ছা তাই।’ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর এই লেখা অব্যাহত রাখার পরামর্শ দেন। তারও আগে স্বামী রামেন্দু মজুমদার স্ত্রীকে লেখায় আরও সময় দেয়ার আহ্বান জানান। এইসব আহ্বান, প্রশংসা বাক্য, সবই মঞ্চে বসে শুনছিলেন ফেরদৌসী মজুমদার। লাজুক একটা ভঙ্গি করে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিলেন বেশিরভাগ সময়। কারও কারও কথা শুনে আবার হেসেছেনও। এবং অতঃপর নিজের বলাটি। ছোট্ট ভূমিকায় তিনি বলেন, আমি কথা বলতে পারি, বক্তৃতা নয়। আসলে তা-ই। বক্তৃতা করলেন না। কথা বললেন। কথাও ঠিক নয়। কথার জাদু! এ জাদুতে বুঁদ হয়েছিলেন সবাই। তার সহজ আকর্ষণীয় নির্ভুল বলা রসবোধ উপস্থিত শ্রোতারা নিশ্চয় অনেকদিন মনে রাখবেন। ফেরদৌসী মজুমদারের শৈশব, নোয়াখালীর একান্নবর্তী পরিবারে ১৪ ভাই বোনের সঙ্গে বেড়ে ওঠার গল্প আগেই বিভিন্ন লেখায় ও সাক্ষাতকারে এসেছে। এর পরও এদিন নতুনের মতো শোনায়। শুনে হাসতে হাসতে খুন হওয়ার অবস্থা হয় অনেকের। একইসঙ্গে পারিবারিক অনুশাসন মূলবোধ নীতি আদর্শ ইত্যাদি সম্পর্কে সুন্দর একটি ধারণা পাওয়া যায়। তিনি বলেন, ভাই বোন বাবা মাসহ চারপাশের বিচিত্র মানুষজনের প্রত্যেককে আমি এক একটি চরিত্র হিসেবে গ্রহণ করেছিলাম। এ অভিজ্ঞতা পরে নাটকে কাজে লেগেছে। বইতেও লিখেছি। তিনি বলেন, আমি যা লিখি তা জীবন থেকে নেয়া। যা লিখি, অতি সত্য। এর পরই কেমন যেন বুজে আসে কণ্ঠ। ভারাক্রান্ত মনে হয় তাকে। প্রবীণ অভিনেত্রী বলেন, এখন লিখতে গিয়ে দেখছি, হায়, জীবন ফুরিয়ে এসেছে...। আসলেই তো জীবন ফুরিয়ে যায়। এইসব মহাজীবন ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই প্রিয় বই হয়ে হাতে উঠুক। আলো হয়ে পথ দেখাক আগামী প্রজন্মকে। প্রকাশনা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে আসা সুহৃদরাও তাই আরও আরও লেখার অনুরোধ জানালেন। ‘যা ইচ্ছা তাই’ বইটি যত্নের সঙ্গে প্রকাশ করেছে জার্নিম্যান। কী আছে বইতে? জবাবে লেখিকা নিজের বয়ানটি এরকম- যখন যে ঘটনা, যে বিষয়, যে মানুষ আমার মনে দাগ কেটেছে- আমাকে একটু হলেও ভাবিয়েছে, সেটাই আমি কাগজে কলমে বন্দী করেছি। যা কিছু অদ্ভুত, যা কিছু বিস্ময়কর, যা কিছু আমি আগে কখনও দেখিনি, শুনিনি, সেটাই যে আমি কখন লিখে ফেলি আমি নিজেও জানি না। তবে ভোরবেলটাই আমার প্রিয় সময়। ওই অল্প আলোতে, নানান পাখির ডাকে, মিষ্টি বাতাসে আমার লিখতে ভাল লাগে। শুধু ভাল লাগার জন্যেই লেখা...। সরল স্বীকারোক্তি হলেও, নানা কিছু এতে উঠে এসেছে। অনেকগুলো ফুল দিয়ে গাঁথা একটি মালা যেন। দুর্লভ কিছু ফটোগ্রাফও যোগ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে সংগ্রহে রাখার মতো। ১৪০ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ৪০০টাকা।
×