ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিশ্বকাপে বন্ধুত্ব -মুনতাসির সিয়াম

প্রকাশিত: ০৪:৫৪, ৭ জুলাই ২০১৮

বিশ্বকাপে বন্ধুত্ব  -মুনতাসির সিয়াম

প্রতিদিন বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে মাঠে ফুটবল খেলতে যায় সারেক। আজকে স্কুল থেকে ফিরে টিভি দেখতে বসেছে দেখে বড় ভাইয়া নিবির এসে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে সারেক? আজ মাঠে খেলতে যাওনি? ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে হতাশ গলায় জবাব দিল সারেক, না। -কেন, শরীর খারাপ হয়েছে? আবারও উত্তরে ছোট্ট করে না বলে চুপ করে রইল সারেক। সবসময় হাসিখুশি ছটফটে ছোট ভাইকে আজকে মনমরা হয়ে বসে থাকতে দেখে একটু খারাপ লাগল নিবিরের। নিবির বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করে। ঈদের ছুটিতে বাড়িতে এসেছে। দুই একদিনের মধ্যেই ফিরে যাবে। এদিকে তার ছোট ভাই সারেক এবার ক্লাস সেভেনে উঠেছে। ছোট ভাইয়ের প্রাণবন্ত আচরণ সবসময়ই নিবিরকে আনন্দ দেয়। খেলাধুলায় মেতে থাকা সারেক আজকে মাঠে খেলতে না গিয়ে বাসায় বসে টিভি দেখছে, তার মানে নিশ্চয় এর পেছনে কোন কারণ আছে। এর ওপর এখন ফুটবল বিশ্বকাপ চলছে। সারা দুনিয়া এই আয়োজনে নিজ নিজ পছন্দের দল ও প্লেয়ারদের নিয়ে মেতে আছে। প্রতিটা বাড়ির ছাদে উড়ছে পছন্দের দলের রঙ-বেরঙের পতাকা। সারেকেরও ফুটবল খেলা ভীষণ পছন্দের। এবারে বাসায় এসে একদিনও এমন হতে দেখেনি নিবির যে, সারেক তার প্রিয় দল আর্জেন্টিনার জার্সি পরে বিকেল বেলা ফুটবল খেলতে বের হয়নি! সারেকের পাশে এসে বসল নিবির। ছোট ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করল, কি হয়েছে ভাইয়া? মন খারাপ কেন তোমার? নিজের মন খারাপের সময় ওর জন্য বড় ভাইয়ের এমন কষ্ট পাওয়া দেখে সারেকের মন আরও খারাপ হয়ে গেল। ভাইয়ার দিকে ঘুরে বসে জবাব দিল সারেক, আমি আর জাহেদের সঙ্গে ফুটবল খেলব না। তাই আজকে মাঠে যাইনি। -খেলবে না কেন? তোমরা না দুইজন বেস্ট ফ্রেন্ড? স্কুলে গিয়ে একসঙ্গে বসে ক্লাস কর। গতকালও না বলেছিলে তুমি আর জাহেদ একই দলে খেললে তোমাদের কখনও কেউ হারাতে পারবে না! তাহলে আবার কি হলো? -হ্যাঁ বলেছিলাম, ভাইয়া। কিন্তু এখন আর আমরা বন্ধু নই। আজকে ক্লাসে যাওয়ার পর ফুটবল বিশ্বকাপ নিয়ে হওয়া আলোচনায় আমি যখন বললাম মেসি সবার থেকে ভাল ফুটবল প্লেয়ার, তখন জাহেদ বলেছে না ওর প্রিয় প্লেয়ার নেইমার মেসির থেকেও ভাল খেলে। তখন আমি রাগ করে চলে এসেছি। আর কোন কথা বলিনি ওর সঙ্গে। -আরে বোকা এত সামান্য একটা বিষয় নিয়ে কারওর বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায় নাকি! ও নেইমারের খেলা পছন্দ করে তাই ওর চোখে নেইমারই সেরা ফুটবল প্লেয়ার। তুমি মেসির খেলা পছন্দ কর, তাই তোমার চোখে মেসিই সেরা। যার যার আলাদা পছন্দ থাকতেই পারে। সবার পছন্দ তো আর এক হবে না, তাই না?-কিন্তু ভাইয়া, আমি তো ওকে আগে এসব কথা বলিনি। ওই প্রথম শুরু করেছে। তাই আমিও ওকে কথা বলতে ছাড়িনি। প্রিয় দলের প্রতি প্রিয় প্লেয়ারের প্রতি সারেক আর জাহেদের ভালবাসার অনুভূতি নিয়ে উত্তেজনা বুঝতে পারে নিবির। যাকে আমরা ভালবাসি তাকে সবসময় সবার থেকে এগিয়ে রাখি। এমনটাই স্বাভাবিক। তারমানে তো এটা নয় যে প্রিয় দল আর প্লেয়ারদের নিয়ে বন্ধুত্বের সম্পর্ক নষ্ট করে ফেলব। ছোট ভাই সারেককে শান্তভাবে বোঝানো শুরু করে নিবির। বলে, তুমি কি জান সারেক যে নেইমার আর মেসিকে নিয়ে তোমরা ঝগড়া করে নিজেদের বন্ধুত্ব শেষ করে দিয়েছ, ওরা নিজেরাও খুব ভাল বন্ধু? অবাক হয়ে প্রশ্ন করে সারেক, কিন্তু কিভাবে? ওরা তো একে অপরের শত্রু দলের হয়ে খেলে। সবসময় ওদের নিয়ে প্রতিযোগিতা হয় কে বেশি ভাল ফুটবল খেলে! -হ্যাঁ, কিন্তু সেটা করি আমরা। দুইজনের মধ্যে তুলনা করে ওদের একে অপরের শত্রু বানিয়ে ফেলি। আর এরমধ্যে দিয়ে আমরা বন্ধুরাও একে অপরের শত্রু হয়ে উঠি। অথচ ওরা এসব জানেই না। এমনকি কে বেশি ভাল খেলে এটা নিয়েও ওরা কখনও চিন্তা করে না। ওরা কেবলভাবে কিভাবে আরও নিজের খেলার মান ভাল করা যায়; ভাল খেলার মাধ্যমে নিজেদের দলকে কিভাবে ওরা আরও এগিয়ে নিয়ে যাবে সে কথা! তুমি কি জান, যে মেসি আর নেইমারকে নিয়ে তোমরা দুই বন্ধু ঝগড়া করেছ ওরা নিজেরা একে অপরের কত ভাল বন্ধু! ক্লাব ফুটবলে কিছুদিন আগে যখন দুইজন একসঙ্গে একই দলে খেলত তখন কত মজা করেছে ওরা! একসঙ্গে প্র্যাকটিস করত, ঘুরত, গল্প করত আরও কত কত খবর আছে ওদের দুইজনের বন্ধুত্বের। এমনকি তুমি আর জাহেদ যেমন টিফিনের সময় একসঙ্গে স্কুল ক্যান্টিনে গিয়ে নাস্তা কর, ওরাও তাই করত। -ইউটিউবে দেখেছি আমি এসব। -তাহলে জানার পরও বোকার মতো ওদের নিয়ে নিজের বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া করেছ কেন? এতে কি সত্যিই প্রমাণ হবে যে কে বেশি ভাল ফুটবল খেলে? কখনই হবে না। কারণ, ওরা সবসময় নিজেদের মতো করে নিজেদের জায়গা থেকে খেলে। এমনকি ঐযে বললাম একই ক্লাবের হয়ে যখন খেলত তখন তো ওরা মাঠে একে অপরকে গোল দিতেও সাহায্য করত, তাই না! ওরা যদি নিজেদের শত্রু মনে করত তাহলে কি এমনটা করত? বরং ভাবত একজনকে গোল করতে সাহায্য করলে সে নিজে পিছিয়ে যাবে। তা না করে নিজেদের দলকে জেতানোটাই ওদের কাছে বেশি জরুরী মনে হয়েছে। আর শোন, ব্রাজিল আর্জেন্টিনা তো পাশাপাশি অবস্থিত দুইটি বন্ধু রাষ্ট্র। জাতীয় দলেও একে অপরের শত্রু দলের হয়ে খেলে না ওরা। কেউই খেলে না। খেলার সময় শুধুমাত্র নিজ নিজ দেশের হয়ে খেলে তারা। খেলা শেষে আবার যার যার জায়গায় চলে যায় তারা। এটাই নিয়ম। ওরা প্রত্যেকেই প্রত্যেককে সম্মান করে বলেই কেউ কাউকে নিয়ে খারাপ কথা বলে না। আমরাই ওদের প্রতি ভালবাসা দেখাতে ওদের নিয়ে খারাপ কথা বলি। যা আসলে ওদের ছোট করা হয়। -বুঝতে পেরেছি ভাইয়া। আসলেই ওদের নিয়ে নিজেদের বন্ধুদের মাঝে ঝগড়া করা উচিত না, যখন ওরা নিজেরাই একে অপরের বন্ধু। এখন তো সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আমি বরং এখনই ফোনে সরি বলি জাহেদকে। সোফা থেকে উঠে গিয়ে আম্মুর মোবাইল নিয়ে জাহেদের বাসায় ফোল করলো সারেক। ওপাশ থেকে ফোন ধরা মাত্রই নিজের ভুলের কথা স্বীকার করে সরি বলল সারেক। এরপর ওর ভাইয়ার বোঝানো সব কথা জানানোর পর জাহেদও নিজের ভুলটা বুঝতে পারল। বন্ধুর কাছে ও নিজেও সরি বলে স্বীকার করল, আসলেই খেলা নিয়ে বন্ধুর সঙ্গে ঝগড়া করা একদম ঠিক কাজ নয়। বরং সবার খেলাই একসঙ্গে উপভোগ করা উচিত আমাদের। আর আবারও বন্ধু হয়ে গেল দুজনে। দ্বিতীয় বর্ষ, নৃবিজ্ঞান বিভাগ; চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
×