ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

হালিমা খাতুন

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ৭ জুলাই ২০১৮

হালিমা খাতুন

ভাষাসৈনিক হালিমা খাতুন চলে গেলেন চিরদিনের মতো। জীবন চলে জীবনের নিয়মে। অনিবার্যভাবে পরকালের ডাকও আসে যথাসময়ে। চলে যেতে হয় সবাইকে অনন্ত ডাকে। তবে কীর্তিমান প্রাজ্ঞজনেরা শেষ বিদায় নিয়েও থেকে যান এই কর্মচঞ্চল পৃথিবীতে। হালিমা খাতুনও সেই মাপেরই একজন গুণী ব্যক্তিত্ব যার শেষ যাত্রা আরও বেশি করে তাকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। যে স্বাধীনতা সূর্যের বীজ রোপিত হয়েছিল ’৫২-এর মহিমান্বিত ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তার সরাসরি অংশগ্রহণকারীরা আজ অবধি জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। যেখানে বাগবিত-ার কোন অবকাশই নেই। ’৫০-এর দশকে পাকিস্তানী শাসন-শোষণের এক জ্বালাময়ী রক্তক্ষয়ী ইতিহাস। যার শুরুটা হয়েছিল ভাষা সংগ্রামের ঐতিহ্যিক কালপর্বের মধ্য দিয়ে। ১৯৩৩ সালে জন্ম নেয়া হালিমা খাতুন বাগেরহাটের স্কুল জীবন শেষ করে প্রফুল্ল চন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে এমএ ডিগ্রী নেন। ১৯৫২ সালের অগ্নি স্ন‍াত দিনগুলোয় তিনি তার ছাত্রজীবনে প্রয়োজনীয় সময় পার করার মধ্য দিয়েই রাজনীতিতেও নিজের অংশীদারিত্ব প্রমাণ করেন। শুধু তাই নয়, ভাষা আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক ঘটনাপঞ্জিরও প্রত্যক্ষ সহযোগী হয়ে উঠতে তার সময় লাগেনি। তৎকালীন সময়ের রাজনীতি মানেই ছিল ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষার এক অনবদ্য লড়াই। যে চিরায়ত বাঙালিত্ব হালিমা খাতুনকেও তাড়িত করেছিল মাতৃভূমি আর মাতৃভাষার প্রতি অপরিমেয় দায়বদ্ধতায়। যে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের সংখ্যা ছিল হাতেগোনা তখন ভাষা আন্দোলনের ঐতিহ্যিক শক্তিকে অনুধাবন করে নিজেকে সম্পৃক্ত করা এক অভাবনীয় যুগ পরিকল্পনা। যে কঠিন ব্রতে শুধু নিজেই দীক্ষিত হননি অনেক ছাত্রীকেও এর অংশীদার করতে পেরেছিলেন। যা আজও জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে এবং চিরদিন করবে। ২১ ফেব্রুয়ারির সেই রক্তমাখা অগ্নিঝরা দিনে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে প্রথম রাস্তায় নেমে এসেছিলেন হালিমা খাতুনসহ চারজন ছাত্রী। শুধু তাই নয়, পরের ঘটনা পরম্পরায় আরও অনেক সংগ্রামী ইতিহাসের অকুতোভয় সৈনিক ছিলেন হালিমা খাতুন। পুলিশের গুলিতে আহতদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করা থেকে শুরু করে সাহায্য তহবিল গঠন এমনকি চাঁদা তোলা, লিফলেট বিলি, পোস্টার লেখা এবং মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নেয়াই ছিল হালিমা খাতুনের প্রাত্যহিক রুটিন। এই মহীয়সী নারীর কর্মজীবন শুরু হয় শিক্ষকতার মতো মহান পেশা দিয়ে। তৎকালীন সময়ে এটাই ছিল নারীদের জন্য সম্মানজনক কাজ। পরবর্তীতে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রীও অর্জন করেন। রাজশাহী মহিলা কলেজের সূচনালগ্ন থেকেই তিনি এই মহৎ কাজের সঙ্গে জড়িতই ছিলেন না, শিক্ষকতার দায়িত্ব নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। পরবর্তীতে যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটে। অধ্যাপক হিসেবে অবসর নেন ১৯৯৭ সালে। ইতোমধ্যে ১৯৬৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব নর্দান কলোরাডো থেকে প্রাথমিক শিক্ষা বিষয়ে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেন। শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি সর্বোচ্চ ডিগ্রী অর্জন করেই ক্ষান্ত হননি, সৃজনশীল কর্মদ্যোতনায় কচিকাঁচাদের জীবন গড়ার ব্রুতও গ্রহণ করেন। তাদের জন্য লিখেছেন ‘সোনা পুতুলের বিয়ে’ ‘কাঁঠাল খাবো’, হরিণের চশমা’, ‘পাখির ছানার মতো কাহিনী সম্পদ’। তার সম্পর্কে প্রবাদ আছে তিনি নিরক্ষর, হতদরিদ্র গৃহপরিচারিকাদের জন্য ন্যূনতম শিক্ষার আলো জ্বালাতে তার মূল্যবান শ্রম ও অর্থ ব্যয় করতে কুণ্ঠিত হতেন না, অস্থিমজ্জায়, আত্মায় এই নিবেদিত শিক্ষক ৮৬ বছর বয়সে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। কিডনি, উচ্চ রক্তচাপসহ অনেক বার্ধক্যজনিত রোগে ভুগছিলেন। তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করে শোকসন্তপ্ত পরিবারকে সমবেদনা জানাচ্ছি। স্বনামখ্যাত আবৃত্তিশিল্পী প্রজ্ঞা লাবণী এই ভাষা সংগ্রামীর একমাত্র সন্তান।
×