ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চাঁপাইয়ের ম্যাংগো ফেস্ট যোগ করল ভিন্নমাত্রা

প্রকাশিত: ০২:৫৬, ৭ জুলাই ২০১৮

 চাঁপাইয়ের ম্যাংগো ফেস্ট যোগ করল ভিন্নমাত্রা

ডি.এম তালেবুন নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ॥ তিন দিনের ম্যাংগো ফেস্ট হয়ে গেল চাঁপাইনবাবগঞ্জে। আম সা¤্রাজ্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে এ ধরনের জমজমাট ম্যাংগো ফেস্ট প্রথম হলেও ইতোপূর্বে দুই বার জেলায় ম্যাংগো প্রদর্শনী হয়েছে। তবে এবারের ম্যাংগো ফেস্টে অন্যান্য বছরের আয়োজিত আম প্রদর্শনীর সঙ্গে কিছুটা ভিন্নতা রয়েছে। সেই সব প্রদর্শনীতে শুধু হরেক রকমের আমের প্রদর্শনী হলেও এবারের ভিন্নতা অন্য মাত্রা যোগ করেছে। আমকে বিশেষায়িত বাণিয়ে পর্যটন শিল্পের বিকাশ সাধনে কাজ করার চেষ্টা করা হয়েছে। সঙ্গে যোগ করা হয়েছে আম থেকে উৎপাদিত নানান শ্রেণীর (১৬ ধরনের) দ্রব্যাদি। দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা ও তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে কাজ করা হয়েছে। একই সঙ্গে জেলার শিল্প, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কর্মকা-ে যে ভিন্নতা রয়েছে তাও তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে প্রদর্শনীর সঙ্গে সঙ্গে। যার জন্য প্রথম দিন ২৯ জুন আয়োজন করা হয়েছিল বর্ণিল শোভাযাত্রা। এবার একেবারে শহরের মধ্যে ম্যাংগো ফেস্টের আয়োজন না করে বেছে নেয়া হয়েছিল শহরের কাছাকাছি মহানন্দা নদীর ওপারে শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর সেতুর শেষ মাথায় বারঘরিয়া অংশের একটি শিশু পার্ককে। তাই উদ্বোধনী বর্ণিল শোভাযাত্রা ডাঃ মেসবাহুল হক স্টেডিয়াম চত্বর থেকে সেতু পেরিয়ে বারঘরিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই উপলক্ষে শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর বীরশ্রেষ্ঠ সেতুর উভয় দিকে রেলিংয়ের উপরে মধুচুসকী লাইট দিয়ে সাজানো হয়েছিল। যা সন্ধ্যা থেকে সকাল পর্যন্ত বর্ণিল ছিল। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের র‌্যালি শেষে ফেস্টের স্টল পরিদর্শন করেন সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব জিল্লার রহমান। জনাব জিল্লার এই জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার কৃতী সন্তান হবার কারণে তার উৎসাহে ও অনুপ্রেরণায় জেলা প্রশাসন জেলার আম, লোকজ ঐতিহ্য, দর্শনীয় স্থান ও হস্তশিল্প নিয়ে এই মেলার আয়োজন করেন। এর মধ্যে স্থানীয় সংসদ সদস্য আব্দুল ওদুদের রয়েছে বড় ধরনের উৎসাহ ও প্রেরণা। স্টল পরিদর্শন শেষে জেলার পুরান ঐতিহ্য লাঠিখেলা অনুষ্ঠিত হয়। একাধিক দল এই লাঠিখেলায় অংশগ্রহণ করেন। পরে বিরাট পরিসরে অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। বারঘরিয়ার এই দৃষ্টিনন্দন পার্কে তিন দিনই ছিল উপচেপড়া ভিড়। তবে শনিবার দ্বিতীয় দিন ফেস্টের মাঠে পা ফেলার জায়গা ছিলনা। বিকেলের দিকে ঐতিহ্যবাহী লাঠি খেলা শেষ না হতেই প্যান্ডেলে শুরু হয়ে যায় গম্ভীরা গান, পরে আলকাপ গান দিয়ে ছিল মনকাড়া আয়োজন। এ ছাড়াও ছিল খাবার জন্য কয়েকটি স্টল। তার মধ্যে অনন্য ও নজর কাড়া স্টল ছিল কলাইয়ের রুটি, সঙ্গে বেগুন ভর্তা ও হাসের মাংস। পকেট উজাড় করে খেয়েছে সব বয়সের মানুষ। এছাড়াও ছিল পার্কের পাস দিয়ে বয়ে যাওয়া মহানন্দা নদীতে ভ্রমণের ব্যবস্থা। যদিও স্থানটি একেবারে শহরের বাইরে হলেও বিনোদনে কোন ঘাটতি ছিল না। এ ছাড়াও ‘আম উৎপাদন, সংরক্ষণ ও আম ভিত্তিক পর্যটন শিল্পের বিকাশ এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলায় অথনৈতিক সম্ভাবনা’ শীর্ষক সেমিনার স্থানীয় সুধী মহল ও বহিরাগতদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে রেখেছে। প্রধান অতিথি তার বক্তব্যে অর্থকরী আম ফল যেন অল্প সমেয় নষ্ট না হয় তার জন্য এখানে সংরক্ষণে আধুনিক মানের প্রতিষ্ঠান গড়ার আশ্বাষ দেন। এ ছাড়াও বক্তব্য রাখেন প্রফেসর সুলতানা রাজিয়া, আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রুহুল আমিন, পৌর মেয়র নজরুল ইসলাম, কৃষি সম্প্রসারণের উপ-পরিচালক মনজুরুল হুদা, আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণাগারের (সাবেক আম গবেষণাগার) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. হামিম রেজা প্রমুখ। এই উৎসবে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পর্যটকরা জেলার বিভিন্ন হারিয়ে যাওয়া আমসহ সুমিষ্ট বাহারি আমের স্টলগুলো ঘুরে ঘুরে দেখেন। এছাড়াও বিভিন্ন আম বাগান ঘুরে দেখেন ও আম ক্রয় করেন। ফলে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম সম্পর্কে দেশের এবং বিদেশের মানুষের চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিন্নতা সম্পর্কেও সম্যক ধারণা ও জ্ঞান অর্জন করবে। ম্যাংগো ফেস্টের তৃতীয় ও শেষ দিন ছিল একেবারে প্রাণহীন শোকাহত। শিবগঞ্জ উপজেলার তরুণ দক্ষ নির্বাহী কর্মকর্তা হঠাৎ করে মারা যাবার কারণে প্রশাসন তৃতীয় দিনের অনুষ্ঠানের সকল কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়। বাদ পড়ে যায় আম খাওয়া প্রতিযোগিতা, আমচাষী ও মেলায় আগত দর্শনার্থীদের মধ্য হতে গ্রামীণ খেলাধুলার প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রূপান্তরিত হয় দোয়া, মাগফেরাত ও মোনাজাতে। এবারের ম্যাংগো ফেস্টের স্থান নির্ধারণ ও সময় ও স্থান বিবেচনায় কিছুটা ত্রুটি থাকায় অনেক জাতের আম প্রদর্শনে ব্যর্থ হয় কমিটি। বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জে বৈশাখ থেকে শুরু হয়ে কার্তিকের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আম মৌসুম থাকে। যেমন মৌসুমের শুরুতে এখানে বাজারে আসে গোপালভোগসহ আরও দুইশটি গুটি জাতের আম। যার স্থায়ী কাল মাত্র ১৫ থেকে ২০ দিন। এখানে উল্লেখ্য, যে চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রায় দেড় হাজার জাতের আম রয়েছে। এর মধ্যে এই সময়ে বারঘরিয়ার আম প্রদর্শনীতে মাত্র কয়েকটি চলমান জাত দেখানো হয়েছে। যেমন নাভী জাতের সুরমা ফজলি, রানী পছন্দ, কুমাপাহাড়ীসহ বারি আম-৪ (হাইব্রিড) যার ওজন প্রতিটি ৬০০ গ্রাম। এসব আম এখনও বাজারে আসেনি। বিশেষ করে আরও একটি জাত যার নাম ল্যাংড়া (গৌড়মতি) এখনও বাজারে আসেনি। যার কারণে এই ধরনের প্রদর্শনী বৈশাখ জৈষ্ঠ্যের সময় জেলা শহরে করলে বিশি ভাল হতো। আষাড় শ্রাবণে কানসাটে এবং ভাদ্র, আশ্বিন, কার্তিকে ভোলাহাটে বিশেষ করে ভারতের প্রধান আম সা¤্রাজ্য পশ্চিম বাংলার মালদহ। চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের আংশিক ও পুরো ভোলাহাট উপজেলা মালদহ জেলার খুবই কাছাকাছি। মাত্র ১০ মিনিটে মালদহ থেকে ভোলাহাট আসা যায়। এই অঞ্চলের আম মালদহের আমের সঙ্গে খুবই মিল থাকায় সাদে গন্ধে অনন্য। যার কারণে ভোলাহাট অঞ্চলে এ ধরনের ম্যাংগো ফেস্ট বা প্রদর্শনী হলে আমচাষীরা দারুণভাবে উপকৃত হতো। চুরিয়ে আনা হতো মালদহের আম। চাঁপাইনবাবগঞ্জে অনুষ্ঠিত ম্যাংগো ফেস্টে সব মিলিয়ে ৪৮ এর অধিক দোকান বা স্টল থাকলেও ক্রেতারা তেমনভাবে উপকৃত হয়নি। কল্যাণপুর হাটিকালচারের উপপরিচালক ড. সাইফুর রহমান ও কৃষিবিদ জোহরুল হক জানান আম মৌসুমে জেলার তিনটি স্থানে প্রদর্শনী করতে পারলে আম চাষীরা দারুণভাবে উপকৃত হতো। তবে এবারের ম্যাংগো ফেস্ট ছিল খুবই অগোছানো। যার কারণে যারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসেছিলেন তারা হয়রানি শিকার হয়েছে। তাছাড়া বর্ষাকাল থাকায় অনেক ব্যক্তি বা পর্যটক চেয়েছিলেন আমের সঙ্গে সঙ্গে চারা কিনতে। কিন্তু আমের চারা বিক্রির তেমন কোন ব্যবস্থা ছিল না। প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন স্থানে নানান জাতের আমের প্রায় সাড়ে চার লাখ চারা গাছ এখান থেকে নিয়ে যায়। একই সঙ্গে বিভিন্ন হটিকালচার সেন্টার ও চারা বিক্রেতারা চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে প্রায় ১০ লাখ আমের গুটি নিয়ে গিয়ে চারা তৈরি করে তা রূপান্তরের মাধ্যমে ব্যবসা করে থাকে। চারা রোপণ পদ্ধতি, সার দেবার নিয়ম নীতি, সেচ প্রয়োগ, আগাছা দমন, ছাঁটাইকরণ, গরগাছা দমন, ফুল ভাঙ্গা, আমের পোকামাকড় দমন ব্যবস্থা, ফল সংগ্রহ পদ্ধতি, অনুন্নতাজাতকে উন্নত জাতে রূপান্তর ও আম শোধন পদ্ধতি সম্পর্কে তেমন কোন স্টল ছিল না। এমনকি আমের উৎপাদন ম্যানুয়াল থাকলে বাহির থেকে আসা ব্যক্তিরা উপকৃত হতো। বিশেষ করে বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পর্যটকরা তেমন কিছু নিয়ে যেতে পরেনি। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম বিদেশে রফতানি করে আরও বেশি অর্থ আহরণ করা সম্ভব এই দিশা পেয়েছে আমচাষীরা। এদিকে প্রতি বছর সম্প্রসারিত হচ্ছে আম বাগান। ২০১০ সালে জেলায় আমের জমির পরিমাণ ছিল মাত্র ১৯ হাজার হেক্টর। সেই জমি মাত্র কয়েক বছরে বেড়ে এখন ৩০ হাজার হেক্টরে পরিণত হয়েছে। বরেন্দ্রর ধানি জমি যা লাল মাটি হিসাবে পরিচিত ছিল এবং জেলার চরাঞ্চলে প্রায় প্রতিযোগিতা করে আমের আবাদ বাড়ছে। চরের যেসব জমিতে বছর গেলে এক পয়সার ফসল আসত না তা এখন রূপান্তরিত হয়ে আমের জমি হয়েছে। একইভাবে কয়েক বছর বরেন্দ্রর ধানি জমিতে ছিল না ফসলের সমারোহ ও ধানের দাম। তাই সেসব জমি আম চাষীরা বিশাল এলাকাজুড়ে আমের আবাদ করেছে। নওগাঁ, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১৬টি থানাতে আম গাছে ভরে গেছে। এই হারে আম গাছ লাগানো ও অধিক মুনাফা ও দাম থাকলে আগামী ১০ বছরে এই বরেন্দ্রসহ চরাঞ্চলে আমের জমির পরিমাণ ২৫ হাজার হেক্টর ছাড়িয়ে যাবে। গত দশ বছর আগেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় আম গাছের পরিমাণ ছিল ১৭ লাখ ৮২ হাজার ৯৩০টি। তা এখন ছুঁই ছুঁই করছে ২৬ লাখে। জেলায় আশ্বিনা আমের গাছ ছিল প্রায় ৪৫ হাজার, ফজলি ৪৪ হাজার ৭শত, ল্যাংড়া গাছের পরিমাণ ১৮ হাজারের কাছাকাছি ছিল, গোপাল ভোগ ১ লাখ ১০ হাজার ৬৮টি, খিরশাপাত বা হিমসাগর ১ লাখ ৭০ হাজার ৯৮০টি, বোম্বাই ৫৯ হাজার, লক্ষণভোগ ৬৯৬৫০টি, আ¤্রপালি ৩২ হাজার, যাহা এখন বেড়ে হেয়েছে ৫০ হাজার, মল্লিকা-৯৩০০, অন্যান্য উন্নত জাত ১০ লাখ ৪৮০, গুটি ১৬০৯৪০টি। এসব গাছের পরিমাণ কোন কোন ক্ষেত্রে দ্বিগুণ, আবার কোনটি শতকরা ৭০% ভাগ বেড়েছে। নাচোলের মতো বরেন্দ্র ভূমিতে এক সময়ে কোন আম গাছ ছিল না। এখন সেই নাচোলে ১ লাখ ৩২ হাজার ২১৮টি গাছ হয়েছে। এমনকি ভোলাহাটের মতো ছোট থানায় ১ লাখ ৭০ হাজার বিভিন্ন জাতের আম গাছ রয়েছে। সব চেয়ে বেশি আম গাছ রয়েছে জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায়। পূর্বে ৯ লাখ ৮১ হাজার ৩১০টি গাছ থাকলেও তা বেড়ে ১২ লাখ হয়েছে। এই উপজেলার অনেক আম বাগানে বছরের ১২ মাস কোন ধরনের সূর্যের আলো প্রবেশ করতে পারে না। শিবগঞ্জ থেকে সোনামসজিদ প্রায় ৫০ কিলোমিটার, আবার কানসাট থেকে ভোলাহাট, গোমস্তাপুর কোন কোন ক্ষেত্রে ৩০ ও ২০ মাইল। এসব রাস্তার ধারে রয়েছে আম বাগান। কোন কোন আম বাগানে সকালে প্রবেশ করলে সন্ধ্যা হলেও তা শেষ হয়না। যদিও মালিকানার ক্ষেত্রে একাধিক ব্যক্তি থাকলেও পাশাপাশি আম গাছের বাগান থাকায় তা বিস্তৃতি পেয়েছে। এ ধরনের আম বাগানের বিস্তৃতি পৃথিবীর কোথাও দেখতে পাওয়া যাবে না। এসব আম বাগানের মালিকরা সারা বছর বসে বসে বাগান বিক্রির পয়সায় সংসার থেকে শুরু করে ছেলে মেয়ের পড়াশুনা চালিয়ে থাকে। এদের অধিকাংশ হজ পালন করেছে গৃহিণী ও ছেলেমেয়েকে নিয়ে। তবে এদের অনেকের আয়কর দিতে হয় না। দিলেও তার পরিমাণ খুবই কম। এবার আমের দাম না থাকায় চাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে পুষিয়ে নেবার স্বপ্ন দেখছে নামলা ও নাভীজাত আম নিয়ে।
×