একজন কবি জাতিকে স্বপ্ন দেখায়। জাতির দূর ভবিষ্যতের করণীয় ধারণ করে রচনা করেন কবিতা। মানবতাকে প্রতিনিধিত্ব করেন। কোনো মানব সন্তানের কোনো অপমান কবি সহ্য করতে পারেন না। সহ্য করে চুপ হয়ে বসে থাকে না কবির কলম। যখন কোনো ভূখ-ের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হয়েছে লুণ্ঠিত বর্গীদের দ্বারা। গর্জে উঠে কলম। গর্জে উঠে কবিতা। প্রতিবাদে সরব হয় কবিতার শিল্পে বুনিত শব্দসম্ভার। দেশের ও বিশ্বের মানুষ অবাক হয় কবির কাব্যে ব্যবহৃত অলঙ্কারিক বিদ্রোহে। ফুঁসে উঠে পাঠকের মন স্বৈরাচারী শাসকের প্রতিকূলে। শাসক ভাবে, এই তো আমার ভালোবাসার আদৌতে মেকি রক্তাক্ত হাতের পরিচয় জেনে যাচ্ছে সবাই। মনের পাপীষ্ট আসনে অনুভব করে পোখরার ভূমিকম্প। না আর অপেক্ষা করা যাবে না। হলে দেরি এই কবি আমার রাজ্যে ভিসুভিয়াসকে উম্মুক্ত করবে। লাভাতে পুড়ে যাবে আমার ইবলিশি ক্রীড়নক। সে করেছে রাষ্ট্রদ্রোহ। ঐ দ্রোহীর জন্য মঞ্চস্থ করো বিচারের নামে দমন। ঐ কণ্ঠ ও কলমকে পরিয়ে দাও লৌহশৃঙ্খল। উম্মুক্ত বাতাস ও আলো করে দাও নিষিদ্ধ। হলো কারারুদ্ধ সেই কবি কয়েকটি বসন্তের জন্য। কলম নেই তার লেখার। লাল দালানের প্রত্যেকটি দালানই হলো যার কবিতা লেখার খাতা। লৌহদ-গুলো হলো যার কবিতার শ্রোতা।
এরকম কবির নাম আমরা শুনেছি। তাঁদের কবিতাও পড়েছি। নিজের ভিতরে দ্রোহের দাবানল জ্বেলেছি। তন্মধ্যে আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, পল সাত্রে, পিবি শেলি, আদোনিস, মাহমুদ দারভিশ অন্যতম।
কবিতা কী পারমাণবিক বোমা? হ্যাঁ! অবশ্যই পারমাণবিক বোমা বা তার থেকেও সংক্রমণশীল। কেননা এই কবিতাই পারে সভ্যতাকে গড়তে। এই কবিতাই পারে মানুষের ভিতরের অমানুষটাকে পিষে ফেলে কল্যাণের তরে মানুষ গড়তে। এই কবিতাই পারে বিপ্লব গড়তে। এই কবিতাই পারে জালিমশাহীর রাজ গুড়ে দিতে। এই কবিতাই পারে আন্দোলনের বেগ বাড়াতে। কবিতার ছত্রগুলি স্লোগান হয়ে দ্রুম দ্রুম করে ভাঙ্গে দেশ পরিচালনার আবরণে যারা বুর্জোয়া তাদের গদি। কবিতার তেজষ্ক্রিয়তায় বর্গীরা অনুভব করে হিরোশিমা বা নাগাসাকির ধ্বংসের রূপ। তাইতো সততই তারা তটস্থ থাকে। এ রকম কবিতাকে তারা পৃথিবীর সব থেকে শক্তিশালী বোমা ভাবে। এ রকমই একজন পারমাণবিক বোমা কবিতার কোবিদ হলেন ইসরাইলি-ফিলিস্তিনি কবি দারিন তাতোর। নিম্নোক্ত কবিতাটি লিখে ফেসবুকে পোস্ট করার জন্য গত ৩ মে ২০১৮ তে তাঁর আটবছরের জেল হয়েছে। কবিতাটি হচ্ছে :
‘প্রতিহত করো, হে আমার জনতা, রুখে দাও ওদের
——
প্রতিহত করো, হে আমার জনতা, রুখে দাও ওদের
জেরুজালেমে আমি আমার ক্ষতগুলোকে সজ্জিত করেছি আর আমার বিষাদগুলোকে নিঃশ্বাস নিতে দিয়েছি
আর আমার করতালুতে করে আত্মাকে বহন করেছি
একজন ফিলিস্তিনি আরবের জন্য।
‘শান্তিপূর্ণ সমাধান’র আগে আমি বিনাশ হবো না
কখনোই আমার কেতনকে নমিত করবো না
যতক্ষণ না তাদেরকে আমার ভূমি হতে বিতাড়িত করতে পারবো।
আশু এক সময়ের জন্য তাদেরকে হিসেব করেছি।
প্রতিহত করো, হে আমার জনতা, রুখে দাও ওদের।
প্রতিহত করো, হে আমার জনতা, প্রতিরোধ গড়ো
ঔপনেবেশিক দস্যুদের রুখে দাও।
বখরা করে নাও লজ্জাকর সংবিধানের
যেটি অসম্মান ও খেলোকে আরোপিত করে
আর আমাদেরকে ন্যায়বিচার পুনঃস্থাপনে বিরত রেখেছে।
ওরা নিষ্পাপ শিশুদেরকে পুড়িয়েছে;
যেমনটি হাদিল, ওরা ওকে প্রকাশ্যেই গুলি করেছিল,
তাকে দিনের উজ্জ্বল আলোতেই হত্যা করেছিল।
প্রতিহত করো, হে আমার জনতা, রুখে দাও ওদের।
রুখে দাও ঔপনিবেশিকদের আক্রমণ করে।
আমাদের চারপাশে ওদের মুতসুদ্দিদের প্রতি কোনো দয়া নয়
কে আমাদেরকে শান্তিপূর্ণ ঘোরের সঙ্গে যুক্ত করে রাখবে?
সন্দেহপ্রবণ জবানগুলোকে ভয় পেয়ো না;
তোমার হৃদের সত্য অনেক শক্তিশালী,
এটা এ রকমই বৃহৎ যেমনটি তোমার ভূমিতে তোমার প্রতিরোধ
সেটি জীবিত আছে হানা দেয়ায় ও বিজয়ের মধ্যে।
তাই আলী তার কবর থেকে আহ্বান করছে:
রুখে দাও, আমার বিদ্রোহী জনতা।
ধূনার উপরে গল্প হিসেবে আমার নাম লিখ;
তোমাদের মধ্যে আমি সাড়া হিসেবে বিদ্যমান থাকব।
প্রতিহত করো, হে আমার জনতা, রুখে দাও ওদের।
প্রতিহত করো, হে আমার জনতা, রুখে দাও ওদের।’
সত্যিই কী তেজষ্ক্রিয়া এই কবিতায়! পৃথিবীর অবৈধ দখলদার ইসরাইলের রক্তমাখা বর্গীর রাজ্যে কী কম্পনই না তুলেছিল এই তরুণী কবি দারিন তাতোর! ইসরাইলের রেইনে হতে ১৯৮২ সালের ১৬ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন দারিন। ৩৬ বছর বয়সের তরুণী বিদ্রোহী কবি দারিন তাতোর ২০১৫ সালে সোশ্যাল মিডিয়ায় তিনটি পোস্ট দিয়েছিলেন। এর মধ্যে একটি ছিল তাঁর উপর্যুক্ত কবিতাটি। কবিতাটি তিনি স্বকন্ঠে আবৃত্তি করে এর সঙ্গে একটি ভিডিও জুড়ে দিয়েছিলেন। ভিডিওটি ছিল একটি প্রতিবাদে অংশ নেয়া একদল বিক্ষোভকারীর।
এসব পোস্টের কারণেই তাকে সাজা দেয়া হয়েছে। উক্ত পোস্ট দেয়ার পরই তাঁকে ২০১৫ সালে গ্রেফতার করা হয়। সে সময় তিনি কয়েক মাস জেলে ছিলেন। এরপর ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে তাঁকে গৃহবন্দী করা হয়।
প্রথমে তাঁকে তেল আবিবের একটি ফ্ল্যাটে আটকে রাখা হয়। গৃহবন্দী থাকা অবস্থায় তাঁকে মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেট পর্যন্ত ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি। ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ তখন তাঁকে ‘জননিরাপত্তার জন্য হুমকি’ বলে বর্ণনা করেছিল।
লেখকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন পেন এই রায়ের নিন্দা জানিয়েছে। তারা বলেছে, কবি দারিন তাতোরকে তাঁর কবিতা এবং শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের কারণেই টার্গেট করা হয়েছে।
এক বিবৃতিতে পেন বলেছে, ‘দারিন তাতোর সেই কাজটাই করেছেন, যেটি লেখকরা প্রতিদিন করেন- আমরা প্রতিদিন আমাদের শব্দ দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ জানাই।’
কবিতা লিখা ও পোস্ট করার জন্য দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর কবি দারিন তাতোর বলেছেন, “আমার বিচার ইসরাইলের মুখোশ খুলে দিয়েছে। সারা বিশ্ব এখন আমার কাহিনী জানবে। তারা জানবে ইসরাইলের গণতন্ত্র আসলে কী। এটি কেবল ইহুদীদের গণতন্ত্র। এখানে আরবরাই শুধু জেলখানায় যায়।
আদালত বলেছে আমি সন্ত্রাসবাদের দোষে দোষী। যদি এটা সন্ত্রাসবাদ হয়, আমি গোটা দুনিয়াকে আমার ‘সন্ত্রাসবাদী ভালোবাসা’ জানাই।”
তিনি ২০১৫ সালে কয়েকমাসের জন্য যখন জেলে ছিলেন তখনকার অপমান, লজ্জা ও অমানবিকতা তাঁকে ভাবিয়েছিল। এ ছাড়াও তিনি নিজদেশে বসবাস করেও অনুভব করেছিলেন বন্দী হিসেবে। আসল নাগরিকদের কোনো অধিকার নেই ফিলিস্তিনে। তাদেরকে উদ্বাস্তু করা হয়েছে। চালানো হচ্ছে হত্যাযজ্ঞ। শিশুরা পাচ্ছে না আদর, স্নেহ, মমতা। নিষ্ঠুরতা! চারপাশে অমানবিকতা। তাই তো তিনি লিখেছেন ‘পানশালার আড়ালে কবি’ কবিতাটি:
‘বন্দিশালায় আমার অনেকের সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছে
এতজন যে হিসেব কষতে পারি না:
হন্তারক ও অপকর্মা,
চৌর্যবৃত্তির লোক ও অসত্যবাদী,
সচ্চরিত্র ও বিশ্বাসহীন ব্যক্তি,
হৃত আত্মা ও সন্দিগ্ধমনা ব্যক্তি,
বিধ্বস্ত ও ক্ষুধার্ত ব্যক্তি।
অতঃপর আমার মাতৃভূমির অসুস্থতা,
ব্যথামুক্ত জন্মগ্রহণ
অবিচার মেনে চায়নি
তাদের শৈশবে পৌঁছা পর্যন্ত
যাদের নিষ্কলুষতা লঙ্ঘিত হয়েছিল।
ধরনীর বাধ্যবাধকতা তাদেরকে নিস্তব্ধ করেছিল।
তারা বয়সের ভারে ন্যূব্জে পড়ল।
না, তাদের দুঃখ বেড়ে গেল,
নিপীড়ন জোরালো হলো,
গোলাপ ফুল যেমন নোনতা পানিতে হয়।
তারা ভালোবাসাকে আলিঙ্গন করল ভীতিহীনভাবে,
আর এই ঘোষণার জন্য দোষী সাব্যস্ত হলো যে,
‘আমরা এই ভূখ-কে সীমাহীন ভালোবাসি,’
তাদের কর্মের প্রতি বিস্মরণশীল...
তাই তাদের প্রীতি তাদেরকে মুক্ত করলো।
দেখো, বন্দিশালা প্রেমিকদের জন্য।
আমি আমার আত্মাকে জিজ্ঞেস করি
সন্দেহ ও হতাশার মুহূর্তগুলোতে:
‘তোমার পাপকর্মগুলো কী?’
এর অর্থ তখনই আমার থেকে পলায়নপর।
আমি সেটিকে বলি
আর আমার ভাবনাগুলোকে উত্থিত করে;
আমি লিখি চলতি অবিচার সম্বন্ধে,
কালির সদিচ্ছায়,
একটি কবিতা আমি লিখেছি...
যার অপরাধ আমার অবয়ব পরেছে,
আমার আপাদমস্তক,
আমি একজন কবি যে বন্দিশালায় আটক,
একজন কবি শিল্পময় একটি ভূখ-ে।
আমি শব্দের জন্য অপরাধী,
আমার মসি যা একটি উপকরণ।
কালি-হৃদের লহু-সাক্ষী দিচ্ছে
আর অপরাধগুলো পড়ছে।
শোনো, আমার গন্তব্য, আমার জীবন,
বিচারক যা বলছে তাতেই:
একটি কবিতা অভিযুক্তের পক্ষে দাঁড়িয়েছে,
আমার কবিতা দুষ্কর্মে মাতাল হয়েছে,
ভূখ-ের স্বাধীনতায়,
শিল্পীর পরিণতি শ্রীঘর।’
দারিন তাতোর বলেছেন যে, ‘কবিতা কোন অপরাধ নয়।’ অবশ্যই কবিতা কোনো অপরাধ নয়। কবিতা প্রেম। কবিতা ভালোবাসা। কবিতা বিদ্রোহ। কবিতা জালিমের কম্পন। কবিগণ মানবতার। কবিগণ জনতার। কবিগণ প্রেমের। কবিগণ স্বাধীনতার। কবিগণ প্রকৃতির। তাই এই মানব দরদী, স্বাধীনতার ও প্রকৃতির কবিকে উম্মুক্ত আলো-বাতাসে ফিরে দেয়া হোক!
উল্লেখ্য, উক্ত কবিতা দুটো ফ্রি দারিন ওয়েবসাইট থেকে সংগৃহীত। লেখক কর্তৃক অনূদিত। তথ্য ও উপাত্ত্ব সংগৃহীত হয়েছে উইকিপিডিয়া, দ্য গার্ডিয়ান, আল জাজিরা ও বিবিসি থেকে।
শীর্ষ সংবাদ: