ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মতিন বৈরাগী

শিল্প-সাহিত্যের বিশ্বাস-অবিশ্বাস

প্রকাশিত: ০৭:৪৬, ৬ জুলাই ২০১৮

শিল্প-সাহিত্যের  বিশ্বাস-অবিশ্বাস

প্লেটো মনে করতেন সুষম মানবচরিত্র গঠন আদর্শ রাষ্ট্র বা পরিকল্পিত রাষ্ট্র গঠনে সহায়ক। [অবশ্য তিনি এ কথাটি উচ্চারণ করেননি যে মানুষ কী করে সুষম চরিত্র অর্জন করতে পারে]। তিনি হোমারের কাব্যে দেবতাদের চরিত্রের মতো নিকৃষ্ট মানব চরিত্র নির্মাণকে গ্রহণ করতে পারেননি। তাঁর সমূহ ধারণা ছিল যে এসব চরিত্র সমাজ গঠনে বা তার আদর্শ রাষ্ট্রগঠনে সহায়ক নয়। তিনি আরও মনে করেছিলেন হোমারের রচনা পাঠ গ্রীক-সমাজের তরুণদের উপকারের পরিবর্তে অধঃপাত ঘটাবে, কারণ দেবতারা সকল সৌন্দর্য ও মঙ্গলের প্রতীক, হোমার তাঁদের মানুষের মতো নীচু প্রবৃত্তি দিয়ে নির্মাণ করেছেন এবং ষড়যন্ত্র, শঠতা, প্রবঞ্চনা, ইন্দ্রিয়পরায়নতা, ক্রোধপূর্ণ বৈশিষ্ট্য দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। অন্যদিকে টলেস্টয় ধনী ভূস্বামী হয়েও সামন্ততান্ত্রিক ধ্যানধারণা যথাসম্ভব বর্জন করে মহত্মের উদহরণ হয়েছেন। টলেস্টয় তার বিশাল সম্পত্তি বিপুল অংশই কৃষকদের দান করেছিলেন। টলেস্টয় কে লেনিন রুশ-বিপ্লবের আয়না বলে উল্লেখ করেছেন। বাস্তবে টলেস্টয় বলশেভিক ছিলেন না, কমিউনিস্টও না। তাঁর অসাধারণ প্রজ্ঞা ও মনীষা মানব কল্যাণে নিয়োজিত রাখাকে কর্তব্য মনে করেছিলেন। তিনি সেক্সপিয়ারের সৃষ্টিকেও অতিমূল্যায়িত করতে চাননি। বরং তীব্র সমালোচনাই করেছেন। তিনি ম্যাকবেথ, অথেলো, হ্যামলেট, রোমিও জুলিয়ট প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন যে মানব চরিত্রের যথাযথ রূপায়ন এতে নেই। এমন কী মপাসার সাহিত্যের বহু বিষয়কে নাকচ করে দিতেও দ্বিধা করেননি। মানুষের চিরন্তন মহিমাকে উপেক্ষা করেননি। মার্কসের ও নন্দতত্ত্ব সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত ছাড়া পূর্ণাঙ্গ কোন লেখা নেই। মার্কস-এ্যাঙ্গেলস রাজনৈতিক বিষয়াবলি আলোচনা প্রসঙ্গে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জনের কাছে চিঠিতে কিংবা তাদের রচনায় শিল্প-সাহিত্য প্রসঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলেছেন বা লিখেছেন। পরবর্তীতে মাকর্সবাদী নন্দনতত্ত্ববিদরা সেই সবের উপর ভিত্তি করে এর একটা পূর্ণ রূপ দিতে চেষ্টা করেছেন। লেনিন তার পার্টিসাহিত্যে যে আলোচনা করেছেন তা নন্দনতত্ত্বের সারাংশ হয়ে আছে। তবে যেটুকু এই মহান ব্যক্তিগণ করে গেছেন তার ভিত্তিসৌধ নিছক অল্পনয়। মাওসেতুং তার ইয়েনান ফোরামের ভাষণে শিল্প-সাহিত্য প্রসঙ্গে দেয়া দিক নির্দেশনাগুলো আজও আমাদের কাজে লাগে। তেমনি রবীন্দ্রনাথ টলেস্টয়ের ‘শিল্প কী’ এই প্রসঙ্গে কিছু বলতে ও লিখতে চাইলেও তা আর হয়ে ওঠেনি। টলেস্টয়ের ভাবনার সঙ্গে তার মিল কতখানি তা আজ আর আমরা নিরূপণ করতে পারি না, কিন্তু তার নানা মন্তব্য থেকে বোঝা যায় যে তিনি টলেস্টয়ের শিল্প ভাবনা প্রসঙ্গে একমত না হলেও শিল্প যে মানুষের জন্য এই মতো বজায় রাখতে ভোলেননি। ‘চিরন্তন মানবের মাহিমারে তবু/উপহাস করি নাই কভু’ এই বোধ ছড়িয়ে আছে তার সৃষ্টিতে।’ তবু একটা কথা থেকে যায় যে শিল্প বিচারে যত মত তৈরি হয়েছে তা বিতকের্র উর্ধে নয়। নানাভাবেই পক্ষ-বিপক্ষ হয়ে তর্ক জায়গা করে নিয়েছে। কিন্তু কখনওই এটা স্বীকৃত নয় যে শিল্প-সাহিত্য স্থূল এবং ভাড়ামির, নীচুতা, যৌনতা সংবলিত এক বিবৃতি। সত্য হলো আডিয়া প্লেটোর মতো, আর এ কারণে তিনি কবিদের নির্বাসন চেয়েছিলেন। কারণ কবিরা সংবেদনশীল মানুষ, এবং কল্পনাচারী। এগুলো আমরা এখনও প্রত্যক্ষ করি। শাসকরা মিথ্যে বলে, রাজনীতিবিদরাও, তারা মনে করে মিথ্যে বার বার বললে আর তা প্রচারের জোরে সত্যকে অপসারণ করে, আপাতত সরিয়ে দেয়। রবীন্দ্রনাথও ছিলেন ঔপনিবেশিক সমাজের চেতনার ভেতরে আটকে পড়া মানুষ। সেদিক থেকে টলেস্টয়ের সাহস নিজ শ্রেণীচ্যুতির মধ্যদিয়ে প্রবাহিত, রবীন্দ্রনাথের আকাক্সক্ষায় সমাজের আশা-নিরাশার ছাপ বর্তমান থাকলেও এবং মানুষই শেষ পর্যন্ত শেষ কথা এমন বিশ্বাস বিধৃত হলেও সীমাবদ্ধতার একটা সুক্ষ্মরেখা আছে। সীমাবদ্ধতার এই সন্ধিক্ষণে নতুনে ফিরবার একটা স্পষ্ট বোধরেখা এখনও তৈরি হয়নি। যার চেষ্টা আজ জরুরী। কেবলমাত্র নতুনরাই পারে এই ঘোর থেকে শিল্প-সাহিত্যকে রক্ষা করতে, কারণ তারা এখনও পুরোপুরি পচে যায়নি। তবে তার জন্য অনুশীলন দরকার, গড্ডালিকা প্রবাহে নয়, যুক্তিযুক্ত ভাবনায়। আর সেসব প্লেটো-টলেস্টয়-রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ও দর্শনের সঙ্গেই সঙ্গতিপূর্ণ, সেইটুকুই তর্কাতর্কির ভিত্তিসৌধ। ০২. পৃথিবীর সকল সৃজনকর্ম মানুষের, উৎস প্রকৃতি ও সমাজ। কোন ব্যক্তির একক কোন কাজের ফলাফল নয়। দলবদ্ধ মানুষের মধ্য থেকে সংবেদনশীল মানুষ যেমন অঙ্কন, সুর ও কাব্য যা মন্ত্র আকারে উচ্চারিত হয়েছে তখন তা সমাজবদ্ধ সকল মানুষকে সম্মোহিত করতে পেরেছে, তখন সেসব দখলে চলে গেছে প্রভাবশালীদের হাতে। [ খ্রিস্ট ধর্ম যখন প্রচারিত হয়, তখন প্রচ- রক্তপাত, হত্যা ধ্বংস হয়েছিল অনিবার্য আর যখন তা পায়ে দাঁড়াতে পারল আর শাসক যখন বুঝতে পারল যে এর ব্যবহার তার জন্য লাভের সে তা গ্রহণও করল পৃষ্ঠপোষকতাও করল, পরিণামে এক সময়ে তা জনগণের মৃত্যুর ফাঁদ হয়ে উঠল, নানা মত গজিয়ে উঠল, এখন আর শাসককে নিজশক্তিতে তার উপর আক্রমণ চালাতে হয় না, নিজেরাই নিজেদের জন্য যথেষ্ট প্রমাণিত হলো। গীর্জা চূড়ান্ত ক্ষমতা গ্রহণ করে কত মানুষ যে পুড়িয়ে মারল কত জ্ঞানীগুণীকে দেশ ছাড়া করল, কত শুভবুদ্ধিকে পুঁতে ফেলল তার ইতিহাস তো খুব বেশি দিনের নয়] ক্ষমতাবানরাই এখন তাকে অনুষ্ঠানে নিয়ে পণ্য করে ফেলেছে। যেমন আজও হয়। সেকালে কবিরাও ব্যবহৃত হয়েছে আশ্রয়-প্রশ্রয় নিয়েছে রাজদরবারে, এবং নিজ সুখে স¤্রাটের গুণকীর্তন করেছে যা নব্য সংস্করণ আমাদের চারপাশে রয়েছে। [কোন সৃজনশীল মানুষ তা’ করতে পারে না, করে প্রাপ্তির লোভে, যারা স্বাধীনতা স্বাধীনতা বলে চিৎকার করে অথচ এর প্রকৃত অর্থ বোঝে প্রাপ্তিতে। চারণ কবিরা জীবিকা নির্বাহ করেছে মানুষের মধ্যে থেকে, গণশিল্পীরা গেয়েছে, মিস্ত্রিরা নির্মাণ করেছে, শিল্পীরা এঁকেছে, মানুষই তাদের উৎসাহিত করেছে, খাবার বাঁচবার পথে সাহায্য দিয়েছে। নয় এমন যে তা দ্বারা দরবারি কবির মতো শিল্পীর মতো তারা খ্যাতি পেয়েছে পুরস্কৃত হয়েছে, বরং বলা যায় অত্যন্ত দীনহীনভাবে জীবনপাত করে গেছে। দুই সৃষ্টির মাঝে নিশ্চয়ই ফারাক আছে, দূরত্বও আছে, কিন্তু দরবারি সৃষ্টি দরবারের অমাত্যরা বাহ্ বাহ্ বলে বাহবা দিয়েছে, এরও কারণ এমন নয় যে তারা তার মর্যাদা বুঝেছে, দিয়েছে এ কারণে যে তার প্রভুর এটা বিলাস। জনগণের মধ্যের কবি/কবিয়াল যে মানুষকে বিনোদন দিয়েছে, সে বলেছে সেই কথা যা জনগণ শুনতে চায়, নিজের বেদনার রূপ দেখতে পায়, সত্যিকে আবিষ্কার করতে পারে। তবুও মানুষ ততটা জাগ্রত হতে পারেনি আজও, যখনই সে জাগতে চেয়েছে তখনই তার সংবেদনের অংশটি ক্ষমতাবানরা নিজেদের হাতে নিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করে ও করেছে। উত্তোরিত ইতিহাস জনগণের সম্পত্তি আর নয়। তেমনি চেতনাও ইতিহাসের ধারায় মুক্ত হতে হতে আবার খাঁচাবন্দী হয়ে যায় ভুল রাষ্ট্র ভুল মানুষের মধ্যে বিরাজ করে বলে। ০৩. এ কথা বেঠিক নয় যে অসচেতন হয়ে সাহিত্য সৃষ্টিতে শিল্পের ত্রুটি থেকে যায়। রবীন্দ্রনাথও বিশ্বাস করতেন শিল্পের কোন উদ্দেশ্য নেই। বাস্তবে তার সৃষ্টি মানুষ গ্রহণ করেছে এবং ব্যাপক মাত্রায় আজও শক্তিমান রয়েছে। কোন পাঠক সচেতন হয়ে পড়লে লাখ করবেন যে রবীন্দ্রনাথ যা কিছু তার বিশ্বাস থেকে আমাদের মাঝে রেখে গেছেন তা মানব লগ্ন এবং সমাজের দুঃখ কষ্ট বেদনার বয়ান, নানাভাবে। তার সময়কালকে বিবেচনায় রেখে তার সৃষ্টিকে গ্রহণ করতে হবে। লাতিনের লেখক ও কবি সাহিত্য-তত্ত্ববিদ বোরহেস নাকি বলেছেন রবীন্দ্রনাথ কবি হিসেবে তৃতীয় শ্রেণীর, বলবার স্বাধীনতা তার আছে। প্রশ্ন উঠবে বোরহেস এ কথা বলেছেন কোন্ সমাজে দাঁড়িয়ে। তার চারদিকের পরিবেশ কেমন ছিল, তার কাল আর রবীন্দ্রনাথের কালের মধ্যের ব্যবধান কত। যদিও রবীন্দ্রনাথের শ্রেণীগত অবস্থানটা বোরহেসের মতো ছিল না, রবীন্দ্রনাথ উপনিবেশিক সমাজের আর বোরহেস পুঁজিবাদী বিশে^র মানুষ।।কাজী নজরুল নিবেদিত প্রাণ হয়ে মানুষের জাগরণে তার সৃষ্টিকে নিবেদন করে গেছেন। নানা রাজনৈতিক ও সাম্প্রদায়িক কারণে নজরুল তখন খানিকটা কোণঠাসা হলেও, তার বাণী মানুষই ব্যবহার করেছে ও করে আজও প্রতিটি সংগ্রামে। সে খানে শিল্পশুদ্ধি ব্যাপক ও বিস্তৃত না হতে পারে, কিন্তু তা কোনভাবেই জনগণের বিরুদ্ধে সুর নয়। জীবনানন্দকে নতুন করে খুঁড়ে খুঁড়ে বের করা হচ্ছে যদিও উত্তাল দিনগুলোর কোন হাওয়া তার গায়ে লাগেনি, কিন্তু গায়ে হাওয়া লাগানোর মৌলিক অর্থ কি? হৈচৈ করা, দলবাজি করা, তা তো নয়, একজন শিল্পীর সেসব কাজও না। জীবনানন্দ তেমনই এক মানুষ যিনি নির্বিকার ছিলেন সকল পারিপার্শ্বিকতা থেকে। ০৪. শিল্পের দায় মানুষের কাছে, শিল্পীরও। শিল্পের জন্ম ইতিহাস অন্তত: তাই বলে। মানুষ তার ইচ্ছাশক্তির প্রবল তোড়ে একদিন হাত কে মুক্ত করতে পারল, আর শুরু হলো তার মানবজীবন। এই জীবন ¯্রােতের নানা মোড়ে মানুষ প্রকাশ জগতেও কল্পনাকে যুক্ত করতে পারল। সেই কল্পনা প্রকাশ উন্মূখ হলে সে তার প্রকাশে যুক্ত করল কল্পনা, যুক্ত করল প্রযোজনীয় কাজে শ্রমলাঘবের উদ্দেশ্য, সম্মোহনে, এবং যুথবদ্ধ জীবন প্রণালিতে। সঙ্গত কারণে শিল্প নিছক আনন্দ দান নয় বরং বলা যায় এটা পরবর্তীর আরোপিত ধারণা। কিছু মানুষ বিপুল মানুষকে প্রতরণা করে, ঠকায় এবং নির্জীব ও নির্লিপ্ত রাখতে এই তত্ত্বকে উপরে তুলে ধরেছে। ০৫. কথিত আছে নবাব সিরাজদ্দৌলার বিধবা পতœী বেগম লুৎফুন্নেছাকে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়েছিল মীরনদ্দৌলা, যে সিরাজ হত্যা ঘটিয়েছিল, উত্তরে সিরাজ বিধবা পতœী নাকি বলেছিল ‘যে হাতির পিঠে চড়েছে সে কখনও গাধার পিঠে চড়ে না।’ আমাদের পুরস্কারপ্রাপ্ত কবিরা বা ভিন্ন রাষ্ট্র থেকেও সম্মানের পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন তারা যদি পাড়ার সংগঠন অথবা তৃতীয় গ্রেডের পুস্তক ব্যবসায়ীদের পুরস্কার গ্রহণে মঞ্চে ওঠেন তখন সেটা গাধার পিঠে চড়ার সামিলই হয়। আর এটা ঘটে সংস্কৃতির প্রকৃত বোধের অভাবে।
×