ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আলী যাকের

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ০৭:৪৬, ৬ জুলাই ২০১৮

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

দর্শকের উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা লাভ করেছি খুলনা, যশোর এবং রংপুরে। সিলেটেও উন্মুক্ত মঞ্চে দেওয়ান গাজীর কিস্সা মঞ্চায়ন করেছি আমরা। এই একটি নাটক দেওয়ান গাজীর কিস্সা জনপ্রিয়তার শীর্ষ স্পর্শ করেছিল তখন। মনে পড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত মঞ্চে এই নাটকটি অভিনয়ের সময়ে অভিনেতাদের আগেই দর্শকদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল অভিনেয় সংলাপগুলো। সত্যি কথা বলতে কী ঢাকার বাইরে অভিনয় করে অনেক বেশি আনন্দ পেতাম তখন। বুঝতে পারতাম যে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরের মানুষ সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্যে কেমন অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করত। ১৯৭৩ এ নিয়মিত নাট্যচর্চা শুরু করবার পরপর যখন আমরা বুঝতে পারলাম যে স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়মিত চর্চিত শিল্পমাধ্যম হিসেবে নাটক প্রতিষ্ঠিত হবার পথে তখন আমাদের মনে হলো যে বাংলাদেশের অন্যত্র নাটকের কি অবস্থা সে সম্বন্ধে কিছু ভাবনা চিন্তা করা দরকার। এই সময়ে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত আমাদের কিছু বন্ধুবান্ধব বলতে শুরু করে দিয়েছেন যে নাটকও শেষ পর্যন্ত কতিপয় এলিটিস্টদের হাতে গিয়ে পড়ল। বলে রাখা ভাল যে আমরা কজনা যখন নাট্যচর্চা শুরু করেছিলাম তখন একটিই ধারণা কাজ করেছিল আমাদের মধ্যে। আমরা চেয়েছিলাম শিল্পমাধ্যম হিসেবে নাটক প্রতিষ্ঠিত হোক ঢাকা শহরে। ঠিক যেমন হয়েছে লন্ডন কিংবা নিউইয়র্ক, প্যারিস কিংবা মস্কোয়। সেই কারণেই একটি সদ্য স্বাধীন চিন্তা-চেতনার শহর ঢাকায় আমাদের কর্মকা- শুরু করেছিলাম। তাছাড়া আমাদের মতো কতিপয়ের সাধ্য ছিল না বাংলাদেশের প্রধান শহরগুলোতে নাট্যচর্চা শুরু করার। সাধকে সাধ্যে পরিণত করার জন্য একটা শক্তিরও তো প্রয়োজন হয়? তবুও যখন যেখান থেকে একক কিংবা দলগতভাবে ডাক এসেছে আমরা যাবার চেষ্টা করেছি। মনে পড়ে গোটা ’৭০-এর দশক জুড়েই বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে নাটক নিয়ে সেমিনার সিম্পোজিয়াম হতো। এই সব জায়গায় আমাদের নিয়মিত ডাক পড়েছে এবং আমরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে উপস্থিত হয়েছি। এই সকল শহরের মধ্যে প্রধান হলো টাঙ্গাইল। মনে পড়ে আমার অকাল প্রয়াত বন্ধু আব্দুর রহমান রক্কুর কথা। এক বিশাল হৃদয়ের মানুষ ছিলেন তিনি। ছিলেন নাটক অন্তঃপ্রাণ। স্বচেষ্টায় টাঙ্গাইলে একটি নাটকের ধারার সৃষ্টি করেছিলেন। দল গড়েছিলেন নিজে। সাহায্য করেছিলেন যারাই দলবদ্ধভাবে নাটক করতে চায় তাদেরকে। একক প্রচেষ্টায় কলকাতা এবং ঢাকার নাট্যজনদের সান্নিধ্যে পৌঁছে যেতেন অবলীলায়। উৎপল দত্তের সঙ্গে তার সখ্য ছিল সর্বজনবিদিত। তার আহ্বানে অনেকবার টাঙ্গাইল গিয়েছি আমি বিভিন্ন আলোচনায় অংশগ্রহণ করার জন্য। যেমনি ছিল তার ভালবাসা নাটকের প্রতি তেমনি তিনি সম্মান প্রদর্শন করতে জানতেন সকল শিল্পী এবং দলকে। আমাদের দল নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়, একাধিকবার নাটকাভিনয় করতে টাঙ্গাইল গিয়েছে সেইসব দিনে। মনে আছে মেলার মাঝখানে উন্মুক্ত মঞ্চে একাধিক নাটক আমরা করেছি। এবং অবাধ বিস্ময়ে লক্ষ্য করেছি যে টাঙ্গাইলের সহ¯্রাধিক মানুষ রবীন্দ্রনাথের অচলায়তন এর মতো নাটক মেলা প্রাঙ্গণে বসে নীরবে উপভোগ করেছেন। অচলায়তন ছাড়াও আমাদের দলের একাধিক নাটক আমরা বিভিন্ন জেলা শহরের টাউনহলগুলোতে কিংবা তাঁবুর নিচে অবলীলায় অভিনয় করেছি যা দর্শক নন্দিত হয়েছে। মনে পড়ে ওই সময় এবং তারও কিছুপর পর্যন্ত আমরা একাধিকবার চট্টগ্রামে নাটক নিয়ে গেছি। আমাদের প্রথম ব্রেশটিও নাটক সৎ মানুষের খোঁজে ১৯৭৬ এ চট্টগ্রামের সেন্ট মেরী’স মঞ্চে একই দিনে তিনবার অভিনয় করেছিলাম। এই অভিনয় হয়েছিল সকাল ১১টা, বিকেল ৪টা এবং সন্ধ্যা ৭টায়। তখন জৈষ্ঠ্যের গরম। আবহাওয়ার অত্যাচারকে উপেক্ষা করে কেমন অনায়াসে নাটক করেছি সেই সব দিনে। এছাড়াও বিভিন্ন জায়গায় তাৎপর্যপূর্ণ মঞ্চ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছি আমরা। একবার, নোয়াখালীর মাইজদী শহরে বিদ্যুত ছিল না। মঞ্চের ওপরে একটা হ্যাজাক বাতি আর দর্শকদের মাঝে হ্যারিকেনের আলোয় সেমিনার হয়েছিল। এবং লক্ষ্য করে চমৎকৃত হয়েছিলাম যে প্রায় হাজারখানেক দর্শক দু’ঘণ্টা ধরে আমাদের কথাবার্তা শুনেছিল। আমাদের সাধারণ জ্ঞানে আমরা ভাবতেই পারি না যে বাংলাদেশের একটি ছোট শহরে এমন মানুষও আছে যারা এই ধরনের সমাবেশে উপস্থিত হতে পারে। আজকের লেখার মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাবার আগে আমার মনে হয় এই দর্শক আগ্রহ সম্বন্ধে আরও দু-চারটি কথা বলা প্রয়োজন। আমার ধারণা যে এখন এই ধরনের আলোচনা সভায় কিংবা সম্মিলনে বাংলাদেশের মানুষ জোগাড় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাহলে কি মানুষ বদলে গেছে? এক কথায় হয়তো বলা যায়- বদলে গেছে বৈকি। যে কোন গভীর, গম্ভীর, আনন্দদায়ক এবং রুচিশীল কর্মকা-ের জায়গায় স্থান করে নিয়েছে বর্ণময়, রিপু আন্দোলনকারী সস্তা বিনোদন যা আমাদের তরুণ প্রজন্মের রুচিটিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। এখন সুইচ টিপলেই বোম্বাইয়া সংস্কৃতির বন্যায় ভেসে যাই আমরা। কে আর মেধা নিবদ্ধ করে সূক্ষ্ম রুচির বিষয়গুলো বুঝবার চেষ্টা করে? এ বড় দুঃখের বিষয় এবং আমার ভয় হয় এখান থেকে পরিত্রাণ পাওয়া বড় দুরূহ ব্যাপার হবে। দর্শকের উৎসাহ এবং অনুপ্রেরণা লাভ করেছি খুলনা, যশোর এবং রংপুরে। সিলেটেও উন্মুক্ত মঞ্চে দেওয়ান গাজীর কিস্সা মঞ্চায়ন করেছি আমরা। এই একটি নাটক দেওয়ান গাজীর কিস্সা জনপ্রিয়তার শীর্ষ স্পর্শ করেছিল তখন। মনে পড়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্মুক্ত মঞ্চে এই নাটকটি অভিনয়ের সময়ে অভিনেতাদের আগেই দর্শকদের মুখে উচ্চারিত হচ্ছিল অভিনেয় সংলাপগুলো। সত্যি কথা বলতে কি ঢাকার বাইরে অভিনয় করে অনেক বেশি আনন্দ পেতাম তখন। বুঝতে পারতাম যে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরের মানুষ সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের জন্যে কেমন অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করত। নাটক মঞ্চায়নের অভিজ্ঞতা আনন্দদায়ক ছিল তো বটেই কিন্তু তার চেয়েও বেশি আনন্দদায়ক ছিল ওইসব জায়গার সংস্কৃতি কর্মীদের সঙ্গে দিনভর আড্ডা দেওয়া। কত তরুণকে জেনেছি যাদের প্রতিভা প্রকাশ করার কোন সুযোগই ছিল না ওইসব অপেক্ষাকৃত ছোট শহরে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা তখন মানুষ সাধারণভাবেই অনেক বেশি সংস্কৃতি সচেতন ছিল। মনে আছে একবার রংপুরের টাউনহলে নাটক মঞ্চায়ন করতে গিয়ে সেখানকার এক প্রবীণ নাট্যজনের কাছে শুনেছিলাম যে নটসূর্য শিশির কুমার ভাদুড়ী একবার এই টাউনহলে নাটক করেছিলেন এসে। তখন তিনি টাউনহলের মাঠে তাঁবুর নিচে মাস কয়েক অবস্থান করেছিলেন। এ সবই ইতিহাস! তবে নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণাদায়ক ইতিহাস। নাটক আমাকে দেশের বিভিন্ন জায়গায় নিয়ে গেছে বেশ কয়েকবার এবং প্রায় সমানভাবেই নাটক নিয়ে অথবা নাটকের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় সফর করেছি আমি। তবে সত্যিকথা বলতে কি দেশে নাটক করে যে আনন্দ আমি পেয়েছি আর কোথাও তেমনটি পাইনি। নাটক নিয়ে বিচিত্র সব ভ্রমণ কাহিনী সম্বন্ধে বারান্তরে লেখার আশা রইল পরবর্তীতে।
×