ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

গোলাম কিবরিয়া পিনু

লেখকের দায় ও গণতান্ত্রিকবোধ

প্রকাশিত: ০৭:৪৪, ৬ জুলাই ২০১৮

লেখকের দায় ও গণতান্ত্রিকবোধ

আবু সয়ীদ আইয়ুব এমন একজন লেখক, যার লেখা বার বার পড়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গি ও ভাবনাকে সমৃদ্ধ বা বিবেচনা করার স্পৃহা জাগানো যায়। পান্থজনের সখা, রবীন্দ্রনাথ ও আধুনিকতা, পথের শেষ কোথায়- এই তিনটি গ্রন্থ বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে পাঠক সমাজে উজ্জ্বল। প্রকাশিত হয়েছিলÑ ‘ব্যক্তিগত ও নৈর্ব্যক্তিক’ নামের একটি গ্রন্থ-১৩৯৮-এর ২৫ বৈশাখে কলকাতার দে’জ পাবলিশিং থেকে। এই গ্রন্থের লেখাগুলো বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল; সেগুলো এখনও গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতা লাভ করে আছে। গ্রন্থটি সেকারণে পাঠকের কাছে বিশেষভাবে মর্যাদা লাভ করেছে। কবিতা ও প্রেম গ্রন্থের প্রথম প্রবন্ধটি ‘কবিতা ও প্রেম’। এই প্রবন্ধে আইয়ুব কবিতার বিভিন্ন সংজ্ঞা বিভিন্নজনের উদ্ধৃতি সমন্বয়ে আলোচনা করেছেন। কবিতা কি শুধু অনুকরণমূলক শিল্প নাকি এর উর্ধে এক ব্যঞ্জনাময় অভিব্যক্তি। কবিতার অর্থ কি একেবারে অবলুপ্ত করা বা খানিকটা রেখে প্রকাশ করা উচিতÑ সে বিষয়ে তিনি প্রশ্ন তুলেছেন। এসবের কোন নির্ধারিত মীমাংসা- গোড়াপত্তন তিনি করেননি। করা কঠিন বলেই মনে হয়। কবিতার বিষয় বহু এলাকাকে গ্রহণ করে হতে পারে; কিন্তু তিনি প্রশ্ন তুলেছেন- ‘কিসের ব্যঞ্জনায় শিল্পরূপ সার্থকতার পর্যায়ে উন্নীত হয়? রং ও রেখার কোন কোন বিন্যাস আমাদের মনকে এমন গভীরভাবে নাড়া দেয় কেন- আমি নিজেকে এই প্রশ্ন করেছি। তার উত্তর হয়ত এই যে সার্থক শিল্পীর রং ও রেখার বিশেষ সন্নিপাতে পরম সত্তারই অনুভব জাগাতে পারেন আমাদের মনে।’ এ বিষয়ে তিনি সংশয়ে ‘হয়ত’ যোগ করে ‘পরমসত্তা’র অনুভবের কথা বলেছেন, কিন্তু অনেকে এই ‘পরমসত্তা’ সম্পর্কে দ্বিমত প্রকাশ করতে পারেন কেননা ‘পরমসত্তা’ বিষয়টি সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা অনেকের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। সে কারণে সার্থক শিল্পীর শিল্পিত বিন্যাস বিভিন্নজনের মনকে বিভিন্নভাবে নাড়া দিতে পারে, এ জন্য কোন ছক ব্যবহার করা কি আদৌ সম্ভব? আইয়ুব উল্লেখ করেছেন ‘Humanism, Positivism, Utiliarianism, Marxism, Pragmatism’ প্রভৃতি মানুষকেই সর্বোচ্চ আঁধারে বলে ঘোষণা করে থাকে। কিন্তু আইয়ুব মানুষের বাইরে পরমতত্ত্ব বা চরমমূল্যের সন্ধান করতে চান, এই বিষয়টি আইয়ুব তার নিজস্ব দর্শনভিত্তিক বিবেচনায় এনে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বর্তমানকালকে কালের অনন্ত ধারা থেকে, মানুষকে সৌরম-ল এবং আরো বৃহত্তর নাক্ষত্রিক পরিম-লের বাসিন্দা থেকে বিচ্ছিন্ন দেখতে চান না। ঐশী প্রেরণাকেও তিনি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তিনি মার্কসবাদীদের মতো বিশ্ব ব্রহ্মা-কে একটি ডায়লেক্টিক বিবর্তনের অভিযাত্রী বলে জেনেও অন্য মাত্রায় অন্য পরিধিতে চরম মূল্য খুঁজতে চান। মার্কসবাদীদের সঙ্গে একমত হন যে, দর্শন-বিজ্ঞান যেমন, শিল্প-সাহিত্যও তেমনি কোন না কোন বাস্তব সত্তার উপলব্ধি থেকে সঞ্জাত। কিন্তু তিনি পরক্ষণেই এই বাস্তবসত্তাকে ‘পরমমূল্য’ দিয়ে অন্য ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করে থাকেন। আইয়ুব উল্লেখ করেছেনÑ ‘কবির জগত তার মনগড়া জগত নয় বটে, কিন্তু তা কবির ও সহৃদয়ের চিত্তনিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক বস্তু সত্তারূপে পরিগণ্যও নয়, বাইরের বিশ্ব ও মনের ভাবনা-বেদনা তাতে একাকার হয়ে মিশেছে।’ এই সত্য যথোপযুক্ত বলে মনে হয়েছে। প্রবন্ধটিতে লেখক ‘প্রেম’কে সত্য-মিথ্যার ‘জোড়া মেলানো ব্যাপার’ বলে ভেবেছেন। প্রেমের বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণে আস্থা রাখেননি এবং প্রেমের ব্যাখ্যা বিজ্ঞানীর পক্ষে অনাধিকার চর্চা বলে তিনি মনে করেছেন। প্রেমের সঠিক বর্ণনা করার ভাষা খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি মনোবিজ্ঞানের সূক্ষ্মতর পরিভাষাও দিশা দিতে পারে না বলে- তাঁর বিশ্বাস। দুই. সমালোচনার উত্তর এই প্রবন্ধটি ‘পঁচিশ বছরের প্রেমের কবিতা’ সম্পর্কিত অমলেন্দু বসুর সমালোচনার উত্তর। অমলেন্দু বসু ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায় এ সমালোচনা ১৩৬৩ মাঘ সংখ্যায় লিখেছিলেন। আইয়ুব তার এই প্রবন্ধে প্রেম সম্পর্কে বলতে চেয়েছেনÑপ্রেম হলো উপলব্ধি, আবেগ ও এষণার একটি বিশেষ প্যাটার্ন। এমনও প্রেম রয়েছে, যা যৌন আকর্ষণে সম্পর্কিত নয়। এক্ষেত্রে ভগবানের প্রতি ভক্তের অনুভূতির কথা তিনি উল্লেখ করেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন ‘সাম্প্রতিক সাম্যবাদী কাব্য দেশপ্রেম ও সমাজপ্রেমের ভাববিন্যাস ও নর-নারীর প্রেমের অত্যন্ত কাছে এসে পড়েছে, অনেক সময়ে ধোঁকা লাগে কবিতাটির উদ্দিষ্ট সমাজ না প্রিয়া। তবে এর চেয়ে সার্থকতর আমার মনে হলো সেই সব বামপন্থী কবিতা যেখানে প্রেমানুভূতি অদ্যর্থ অথচ সমাজবোধের মধ্যে বিধৃত ও তার দ্বারা ঐশ্বর্যম-িত।’ যদিও এই লেখাটি অনেক দিন আগের, তবুও এ মূল্যায়ন বর্তমানেও গুরুত্বপূর্ণ। বামপন্থী চেতনাতাড়িত যেসব কবি কবিতা লেখেন, তারা তিন চার দশকে কবিতাকে সমৃদ্ধ করেছেন, বলা চলে বাংলাদেশেও তাদের ভূমিকায় কবিতার মূল ভূমি জেগে উঠেছে ও সমৃদ্ধ হয়েছে। গত দু’হাজার বছরে সোজাসুজি ও নির্ভেজাল প্রেমের প্রকাশ এত বিস্তৃতভাবে ঘটেছে, তা উল্লেখ করে আইয়ুব সমকালীন প্রেমের কবিতায় ব্যক্তিরুচির অন্য ধরনের প্রকাশ টেনে আনতে পক্ষপাতী। তিনি আক্ষেপ উচ্চারণে বলেছেনÑ ‘কবিতার সাহিত্যিক বিচার ভাল-মন্দ মাঝারি অনেকে অনেক রকম করেছেন, তার স্বরূপ জিজ্ঞাসা, আর কিছু না হোক বিরল তো বটেই। বাংলা প্রবন্ধে সর্বত্র ইতিহাসের ছড়াছড়ি দেখে আমি বড় হতাশ বোধ করি।’ এ অংশ যথার্থ বলেই মনে হয়েছে। বিশেষত আমাদের এ দেশেÑবাংলাদেশের কবিতার ক্ষেত্রে এ সত্যটি আরো বেশি মনোযোগের দাবি রাখে। গত দুই ও তিন দশকে যত কবিতা লেখা হয়েছে, সেই তুলনায় কবিতার আলোচনা দীনতায় ন্যুব্জ। তিনি বিশেষ জোর দিয়ে বলেছেনÑ‘দার্শনিকরা কোন বিচারই সরাসরি সিদ্ধ বা পুরোপুরি অসিদ্ধ নয়; সর্বত্রই কিছু সত্য, কিছু ভ্রান্তি, কিছু যুক্তি, কিছু খেয়ালের মিশেল পাওয়া যায়। মাত্রাভেদ অবশ্য আছে এবং একজন দার্শনিক কোন মতটিকে বরণ বা গঠন করবেন সেটা শেষ পর্যন্ত অনেকাংশে নির্ভর করে তার ব্যক্তিস্বরূপের ওপর, তার বিশিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গির ওপর। এদিক দিয়ে দেখতে গেলে আবার মনে হয় দার্শনিক বিচার বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এবং শিল্পসৃষ্টির মধ্যবর্তী।’ এভাবে বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বিভিন্ন মতের সহাবস্থানকে আইয়ুব স্বীকার করে স্বাগত জানিয়েছেন। এ প্রয়োজনে বিতর্ক, তুলনামূলক বিচার বিবেচনা গ্রহণযোগ্য বলে মতামত ব্যক্ত করেছেন। এই প্রবন্ধের শেষে আইয়ুব আধুনিক কবি সমালোচক ও কাব্যানুরাগীদের সম্পর্কে বিপরীত মন্তব্য করেছেনÑ ‘এ এক অদ্ভুত যুগে আমরা বাস করছি, যখন কবিরা দাবি করেন এবং সে দাবি সমালোচকরা সোৎসাহে সমর্থন করেন। যে প্রত্যেকটি কবিতা পাঁচবার করে পড়তে হবে এবং প্রত্যেকটি ছত্রের শেষে পাঁচ মিনিট ধরে ভাবতে হবে, নইলে কবিতা হবে হেঁয়ালি; তীক্ষè ও সজাগ বুদ্ধি এবং প্রভূত জ্ঞানভা-ার না থাকলে কবিতা পাঠে অধিকার জন্মাবে না কারও।’ আইয়ুবের মতো একজন বিশিষ্ট কাব্য সমালোচক ও কবিতা পাঠক যিনি রবীন্দ্রনাথের কাব্যকে বিশেষভাবে আলোচনা এনে নতুন ব্যাখ্যা ও ব্যঞ্জনায় উজ্জ্বল করেছেন, তার এই উল্লিখিত মন্তব্য বিশেষভাবে মনোযোগ আকর্ষণ করে। এই মন্তব্যের নিরিখে বলতে পারিÑ আজ আধুনিক কবিতা বিশেষত বাংলাদেশের কবিতা এই সময় এসে পাঠকপ্রিয়তা হারাচ্ছে এর কারণ কি একদল কবির উন্নাসিক কাব্য রচনা নয়? যে কাব্য রচনা শূন্যজাত বন্ধায় ছটফট করে, যা পাঠককে দোলা তো দেয় না বরং পাঠককে কবিতা সম্পর্কে বিরূপ মনোভাব তৈরিতে সাহায্য করে। সীমিত কবিতার পাঠক যখন কবিতা পড়ে আন্দোলিত হয় না, তখন তা কবিতার ট্র্যাজিক অবস্থা বলেই বিবেচনা করা যেতে পারে। সাম্য ও স্বাধীনতা ‘সাম্য ও স্বাধীনতা’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৫৫ মাঘ-চৈত্র ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকায়। এ লেখাটি বর্তমান সোভিয়েত রাষ্ট্রের পতনের পর আরও তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে। ১৩৫৫ সালে আইয়ুব সোভিয়েত ইউনিয়নের গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতার কথা আলোচনা করেছিলেন। এ প্রবন্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নে ব্যক্তি স্বাধীনতার যে সীমাবদ্ধতা লক্ষ্য করেছিলেন, তা অকপটে উল্লেখ করেছেন। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাম্য ও স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট, সীমাবদ্ধতা ও নিয়ন্ত্রণ পুরো প্রবন্ধ জুড়ে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। আইয়ুব রুশ বিপ্লবকে শুধু বিপ্লব হিসেবেই মনে করেননি, একে ‘বিপ্লাবাদপি গরীয়সী, মহাপ্রলয় ও মহাসৃষ্টির এক অপূর্ব সংগম’ বলে মনে করেছেন। তারপরও তিনি এর অসংহতি ও অসম্পূর্ণতা আবিষ্কার করেছিলেন, এখানেই তার দূরদৃষ্টি, রুশ বিপ্লবকে ভবিষ্যতের অনপ্ত সম্ভাবনাময় ভেবেছেন। তার প্রবন্ধে উল্লেখ হয়েছেÑ ‘পরার্থপরতার যে সহজাত বৃত্তিগুলো ধনিকচালিত দেশে অবদমিত থাকে কিংবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যক্তিগত দান-খয়রাতের নালা-ডোবায় সামান্য একটু ছাড়া পায়। তাকে রাষ্ট্রের বিশাল সমুদ্রবক্ষে তরঙ্গায়িত করে তুলে মানবজাতির অভাবনীয় উৎকর্ষের দ্বার খুলে দিয়েছে রুশ বিপ্লব।’ রুশ বিপ্লবÑসাম্য ও সৌভ্রাত্র কিংবা ফরাসী বিপ্লবকে রক্ত-মাংসে রূপ দিতে অনেক পরিমাণে সফল হয়েছে বলে আইয়ুব বিশ্বাস করেছেন কিন্তু পর পরই আইয়ুব স্বাতন্ত্র্য, আত্মবিকাশ ও প্রকাশের স্বাধীনতা সম্পর্কে প্রশ্ন তুলেছেন। সোভিয়েত সমাজকে অগ্রগামী ইতিহাসের বিবেচনায় এনে তিনি সমালোচনা করতে উদ্যোগী হয়েছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের ভাষা টেনে এনেছেনÑ ‘দেহে দেহে পৃথক বলেই মানুষ কাড়াকাড়ি হানাহানি করে থাকে, কিন্তু সব মানুষকে এক দড়িতে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে সমস্ত পৃথিবীতে একটি মাত্র বিপুল কলেবর ঘটিয়ে তোলবার প্রস্তাব বলগর্বিত অর্থতাত্ত্বিক কোন জার এর মুখেই শোভা পায়’ এবং তা সমর্থন করেছেন। আইয়ুব অবশ্য স্বাধীনতার সুনির্দিষ্ট সীমানাকে স্বীকার করেছেন। তিনি শিল্প, সাহিত্য, দর্শন ও বিজ্ঞানে ব্যক্তি মানুষের গভীর ও মূল্যবান অভিব্যক্তি প্রকাশে ছক কাটা, ঝর্ণা নিষেধের বেড়া তোলা সমর্থন করেননি, কেননা তা ধীরে ধীরে সৃষ্টি ক্ষেত্রকে মরুক্ষেত্রে পরিণত করে। এই মরু প্রক্রিয়া তিনি সোভিয়েত সমাজে লক্ষ্য করেÑ এর উত্তরণের জোর দিয়েছিলেন। আইয়ুব স্বাধীনতার দুটি মূল শর্ত উল্লেখ করেছেন। এক ভাবাত্মক ও অন্যটি অভাবাত্মক। সোভিয়েতে ভাবাত্মক শর্ত। অর্থাৎ অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য, সাধারণ শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এবং সর্বোপরি জীবিকা অর্জনের ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ নিরাপত্তা অনেকটা পূরণ হয়েছিল, যা স্বাধীনতার জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তা পর্যাপ্ত নয়। এ বিশ্লেষণে আইয়ুব আরও স্বাধীনতার পক্ষপাতি, যে স্বাধীনতা ব্যক্তিত্ব বিকাশের পথ সম্পূর্ণ উন্মুক্ত রাখবে। বর্তমানে সোভিয়েতের রাষ্ট্র ভেঙ্গে যাওয়ার পেছনে ব্যক্তিত্ব বিকাশের স্বাধীনতা কতটুকু কাজ করেছেÑ তা আজ ভাববার বিষয়। সোভিয়েত সমাজে মার্কসীয় গোড়ামি কতটুকু স্থান দখল করেছিল, তা আজ ভেবে দেখা প্রয়োজন। মার্কসবাদ সর্বগ্রাসী ধর্মমতের মতন কি প্রাচীর গড়ে তুলেছিল? এ প্রশ্ন আইয়ুব তুলেছিলেন বহু আগেই। এভাবে সোভিয়েত সমাজের সীমাবদ্ধতা চিহ্নিত করেছেন তিনি। অত্যধিক নিয়ন্ত্রণ, চাপিয়ে দেয়া মতামত কখনও সুনাম বয়ে আনতে পারে না বলেই আইয়ুব অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। ‘দেশের অধিকাংশ লোক যদি কঠিন নির্যাতনের মধ্যে তাদের শুষ্ক বিক্ষোভ বুকে চেপে নিয়ে বসে থাকে এবং সেই অবস্থায় কোন নতুন কথার সুর তাদের বিক্ষোভের সুরের সঙ্গে মিলে যায়, তাহলে কোটি কোটি মানুষের মনের সব ক’টা তার ঝঙ্কার দিয়ে উঠবে, রাষ্ট্র সত্যই বিপন্ন হবে।’ হ্যাঁ সত্যিই সোভিয়েত রাষ্ট্র আজ ভেঙ্গে চোরাবালিতে গিয়ে পৌঁছেছে। তবে আইয়ুব বলেছেনÑ ‘আজ সন্দেহাতীতরূপে এ কথা সাব্যস্ত হয়ে গিয়েছে যে সমাজতন্ত্র ধনতন্ত্র অপেক্ষা অনেক উন্নত ও উন্নতিশীল ব্যবস্থা।’ তিনি প্রবন্ধের শেষে বলেছেনÑ ‘সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের বিরোধিতা আসতে পারে দুই দিক থেকে : এক ভূতপূর্ব ধনিকশ্রেণী এবং তাদের ভাড়াটিয়াদের তরফ থেকে এবং দ্বিতীয়ত : যারা সোভিয়েত রাষ্ট্রের উপস্থিত সমাজতান্ত্রিকতার স্থবির প্রগতিবিমুখ রূপ দেখে ধৈর্য হারিয়ে সেটাকে আবার গতিশীল করার জন্য সমাজবাদের আরও উন্নত স্তরে নিয়ে যাবার জন্য উদ্যোগী হয়েছেন, তাদের ভেতর থেকে অথবা যারা সমাজতন্ত্র অপেক্ষাও সমুন্নত কোন সামাজিক ব্যবস্থার কম্পছবি মনের মধ্যে দেখতে শুরু করেছেন; কারণ সমাজতন্ত্রও ইতিহাসের জয়যাত্রার শেষ মনজিল নয়, ধনতন্ত্রের পরবর্তী স্টেশন মাত্র।’ সোভিয়েতের সাম্প্রতিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে আইয়ুবের উল্লিখিত বিবেচনা আমাদের কাছে এখনও তাৎপর্যপূর্ণ নিঃসন্দেহে; যদিও এই প্রবন্ধটি সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার প্রায় চার দশক আগে আগে লেখা হয়েছিল। সাহিত্যিকের সমাজচেতনা এ প্রবন্ধে আইয়ুব সমাজের চরম সঙ্কটকালে বা অন্যায়ের মুখোমুখি হয়ে সাহিত্যিক যে নির্লিপ্ত থাকতে পারে না, তা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু দলীয় রাজনীতির সঙ্কীর্ণ াবস্থানে সাহিত্যকে আবদ্ধ করার বিষয়ে তিনি ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন। এতে যে, সাহিত্যের প্রাণময় বিকাশ রুদ্ধ হয়Ñ তা তিনি উপলব্ধিতে এনেছেন। তবে তিনি সাহিত্যিকের জীবন ও মন সমাজের নানা নিবিড় সূত্রে যে সম্পর্কিত, তা উপলব্ধিতে এনে সমাজের জীবনপ্রবাহ, তার গভীর তলবাহী নানা ¯্র্েরাত ও ধারার সংঘাত, আসন্ন বিপ্লবের ‘আবর্ত’ থেকে সাহিত্যিক বিচ্ছিন্ন হতে পারেন না বলেই তিনি মত ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেনÑ ‘মহৎ সাহিত্য তাকেই বলা চলে যা একাধারে সমসাময়িক এবং শাশ্বত, যুগধর্মী এবং যুগান্তকারী।’ এ প্রবন্ধে তিনি অতীত আশ্রিত সময়কে অনুকরণ করে যারা বর্তমান যুগের গতি প্রবাহকে বন্ধ করতে চান তাদের সম্পর্কে উচ্চারণ করেছেন, উল্লেখযোগ্য মন্তব্যÑ ‘হিন্দু ও মুসলিম সভ্যতা আপন আপন দেশ-কাল-পাত্রের মধ্যেই নিশ্চয়ই মহৎ গৌরবের অধিকারী ছিল। ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে তাদের অবদান কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্বীকার্য এবং শ্রদ্ধাপূর্ণ চিত্তে স্মরণীয়। কিন্তু আজকের দিনের অর্থনৈতিক রাষ্ট্রিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ তার অখ- পুনরাবির্ভাব এবং গোঁড়ামির মধ্যে তার দৃঢ় প্রতিষ্ঠা শুধু ইতিহাসের গতিরোধ নয়, তার শোচনীয় পশ্চাৎগতি। ফ্যাসিস্ট তামাসিকতার অভিযানকে ঠেকাতে কিংবা এগিয়ে দেয়াতে সাহিত্যিক ও ভাবুকের ভূমিকা যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে তাতে সন্দেহ নেই।’ মার্কসবাদী সাহিত্য আন্দোলনÑসাহিত্য বিষয়ের সীমানাকে অনেক প্রসারিত করেছে ও সমাজের বৃহত্তর অংশকে সাহিত্যে প্রবেশ অধিকার দিয়েছেÑ তা তিনি মেনে নিয়েছেন। বিশেষত, কথাসাহিত্য সমৃদ্ধ হয়েছেÑ মার্কসবাদী আন্দোলনের ফলে। তা গুরুত্ব সহকারে তিনি মনে করেছেন। মার্কসবাদী সমাজচেতনার সাহিত্যিক ও সামাজিক মূল্য স্থায়ী বলেই তিনি ভুলতে চান না। এ প্রবন্ধে তিনি বার বার উচ্চারণ করেছেন যে, সাহিত্যিক যেন বাইরের চাপে তার সৃজনশীলতাকে নিয়ন্ত্রণ না করেন। সমাজবাদী পরিকল্পনায় ব্যক্তিস্বাধীনতা এ প্রবন্ধটি হুমায়ুন কবির রচিত ‘ঝবরবহপব, উবসড়পৎধপু ধহফ ওংষধস ধহফ ড়ঃযবৎ ঊংংধুং’ বইয়ের সমালোচনা। এই আলোচনায় মূলত আইয়ুব গণতন্ত্রের কয়েকটি দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। অধিকার ও কর্তব্য গণতান্ত্রিক সমাজে পরস্পর যুক্ত বিষয়। গণতান্ত্রিক সমাজ যদি নাগরিকের অধিকার স্বীকার না করে, তা হলে নাগরিকের কাছ থেকে কর্তব্য আশা করা উচিত নয়। ব্যক্তির স্বাধীনতা কতটুকু কিভাবে স্বীকার করতে হবে তা তিনি আলোচনা করেছেন এ প্রবন্ধে। তিনি সমাজের মৌলিক চাহিদাসমূহ পূরণে গুরুত্ব দিয়েছেন, এ কারণে যেÑ তা না হলে সুষ্ঠুভাবে গণতান্ত্রিক সমাজের বিকাশ সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক সমাজে বহু মত ও পথ থাকবে ঠিকই, কিন্তু সেগুলো ব্যাপক বিচ্ছিন্নতায় থেকে সামাজিক ঐক্য বিনষ্ট করতে পারে, তা তিনি ভাবার বিষয় বলে মনে করেছেন। গণতান্ত্রিক সমাজের ‘ঐকমত্য’ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বলেই তিনি ভাবেন। কেবলমাত্র, শাসনবিধি ও অর্থনীতির ওপরই প্রতিষ্ঠিত নয় গণতন্ত্র, এর ভিত্তি আরও গভীরে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। তিনি বিশেষ করে জোর দিয়েছেন যে, ‘একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন, অন্যদিকে সংখ্যালঘিষ্ঠের সম্মানÑএই যুগল স্তম্ভের ওপর গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা।’ তিনি আরও উল্লেখ করেছেনÑ‘গণতন্ত্র কার্যক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের মত ও রুচি অনুযায়ী চলার নীতি স্বীকার করে; কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন লাভের ফলেই কোন মত সত্য এবং রুচিবরেণ্য বলে প্রতিপন্ন হয়ে যায় না। কাজেই সংখ্যালঘিষ্ঠ দলকেও প্রমাণ করবার বা বিপরীত পক্ষকে দিয়ে মানিয়ে নেয়ার সর্বদাই সুযোগ দিতে হবে যে তাদের মতই সত্য এবং তাদের আদর্শই শ্রেয়।’ বর্তমানে বাংলাদেশে গণতন্ত্র নির্মাণে আইয়ুবের উল্লিখিত দিকসমূহ গুরুত্বসহ বিবেচিত হওয়া উচিত। এই ক’টি দিক যদি বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবাই তৎপর হোন, তাহলে এ দেশে গণতন্ত্রের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হবে, নইলে নয়। মধ্যযুগীয় অন্ধকারকে ঠেকানোর জন্যই আইয়ুবের এসব মন্তব্যের কাছে আমাদের ফিরে যেতে হবে। হিন্দী, ইংরেজী ও মাতৃভাষা এবং হিন্দীর দাবি এই দুটি প্রবন্ধে আইয়ুব ভারতের মতো বহু ভাষাভাষী দেশের রাষ্ট্রভাষা কী হবে তা আলোচনা করেছেন, এক্ষেত্রে হিন্দীর দাবি কতটুকু যুক্তিসঙ্গত তা আলোচনা করেছেন। ভারতে ভাষা সমস্যা বহু বিস্তৃত অবস্থানে রয়েছে, যার ফলে বিষয়টি অবশ্যই জটিল গ্রন্থিতে সম্পর্কিত হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে বাংলা ভাষার বিকাশে এতটা সমস্যা নেই। বাংলা ভাষা বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষেরই ভাষা, সে কারণে এই ভাষাকে অবহেলায় নিয়ে পশ্চাৎ অবস্থায় ফেলে রাখা ঠিক নয় বলেই মনে হয়। বাংলা ভাষার স¤া¢বনার সঙ্গে সঙ্গে এদেশের মানুষের জীবনের সম্ভাবনা বিকশিত হতে পারে। আইয়ুবের উচ্চারণে বলবোÑ ‘বাঙালী পাঠককে বুঝিয়ে বলার দরকার নেই যে, সর্বস্তরের শিক্ষা মাতৃভাষাতে না হলে চিত্তের পূর্ণ উন্মেষ এবং বিদ্যার সম্যক আত্তীকরণ সম্ভব নয়।’ আমি তোমায় ভালবাসি এই প্রবন্ধটি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ৭ এপ্রিল ’৭১-এ লেখা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে আইয়ুব বিবেকতাড়িত হয়ে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে সংহতি প্রকাশের জন্য এ লেখাটি লিখেছিলেন। এই লেখাটি বাংলাদেশের মুক্তি ও ইতিহাস সম্পর্কে পাঠককে সত্যের দিগন্তে নিয়ে যেতে পারে। কেননা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে বিভিন্ন সময়ে বিকৃতির পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হয়েছে, এদেশের পত্রপত্রিকায় বিভিন্ন ধরনের মনগড়া উদ্দেশ্যমূলক লেখাও প্রকাশিত হয়েছে। এমন অবস্থায় এই প্রবন্ধটি পাঠককে খানিকটা সত্যমূলক বক্তব্য ও ইতিহাসের মুখোমুখি করতে পারবে। তিনি লিখেছেনÑ ‘২৬ মার্চ রাতে ঢাকা শহরে প্রথম হামলার সবচেয়ে হিং¯্র আঘাত পড়ল প্রখ্যাত অধ্যাপক ও সাহিত্যিকদের ওপর এবং দেশপ্রেমে নিবেদিতপ্রাণ ছাত্রদের ওপর। চূড়ান্ত বর্বরতা সন্দেহ নেই, কিন্তু দেখা যাচ্ছে ওই বর্বরদের মগজে কিছু বুদ্ধি ছিল, যেমন চিতাবাঘের মগজেও থাকে। তারা খোঁজখবর নিয়ে ঠিকই জানতে পেরেছিলেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মূলে ছিল ওখানকার জ্ঞানী, ¯্রষ্টা ও ছাত্রদের জাগ্রত বুদ্ধি এবং উদ্দীপনাময় শক্তি।’ ২৪ বছর বাংলাদেশ যে পাকিস্তানের কলোনি ছিল তা তিনি উল্লেখ করে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের পেছনে যুক্তিনির্ভর প্রেরণার কথা উল্লেখ করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে মনুষ্যত্বের উদ্বোধন বলে আইয়ুব মনে করেছেন। তিনি শুধু দু-একজনের মধ্যে মনুষ্য বোধের উন্মেষ লক্ষ্য করেননি, লাল লাখ মানুষের মধ্যে তা দেখেছেন। আর মানুষ হওয়ার মন্ত্র দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যমূলক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে বার বার। সেই সময়ে মুজিবের কী ভূমিকা ছিল তা কালিক সত্যতায় এই প্রবন্ধের মাধ্যমে যাচাই করে নেয়া যায়। সাহিত্যের চরম ও উপকরণ মূল্য এ সময় নির্জনতাবিলাসী শিল্পীদের সময় নয় বলে তিনি মত প্রকাশ করেছেনÑ এ প্রবন্ধে। সমাজের ভাঙ্গা-গড়ার শিল্পীকেও সম্পর্কিত হতে হয়। মার্কসবাদ যে মানুষের শ্রেয়বোধের কাছে একটি গভীর আবেদন রেখেছে তা তিনি স্বীকার করেছেন। পাশাপাশি সমাজ বিকাশে সাহিত্যের রয়েছে নিজস্ব স্বকীয় অবস্থান। এই অবস্থানকে আইয়ুব কখনও খাটো করে দেখেননি। সাহিত্যকে বিশেষ মর্যাদায় যুক্ত করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার উর্ধে সাহিত্যিক গতিময়তা কামনা করেছেন। এই গ্রন্থেÑ ‘বিশুদ্ধ ও ফলিত সাহিত্য’, ‘বন্ধুবরেষু’, ‘শান্তি কোথায় মোর তরে’ শিরোনামের তিনটি প্রবন্ধ রয়েছে, আর রয়েছে বিকাশ চক্রবর্তী লিখিত সয়ীদ আইয়ুব ও ট্রাজিক চেতনা-নামক একটি প্রবন্ধ। এসব প্রবন্ধেও লেখক তার মূল চিন্তা-চেতনা ও বিবেচনা অনেকটা ঐক্য সুরে গেঁথেছেন। ‘শান্তি কোথায় মোর তরে’ নামক প্রবন্ধে আইয়ুব রবীন্দ্রনাথের ট্রাজিক চেতনাকে বিশ্লেষণ করেছেন। ‘আবু সয়ীদ আইয়ুব ও ট্রাজিক চেতনা’ নামক বিকাশ চক্রবর্তীর প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে প্রবন্ধটি আইয়ুব লিখেছেন। বিকাশ চক্রবর্তীর প্রবন্ধটি এই গ্রন্থে থাকার ফলে ‘ট্রাজিক’ বিষয়ে আলোচনার পরিধি বিস্তৃত হয়েছে, যা পাঠকের জন্য বিশেষ কাজ দেবে বলে মনে করি। আইয়ুবের এই গ্রন্থটির কয়েকটি লেখা আমাদের এই সময়ের আলোড়িত পরিবর্তনমুখী সামাজিক অবস্থানের সামনা সামনি দাঁড়ানো পাঠককে দিকনির্দেশনা দিতে পারে আজও। আমাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য যে পথ আমরা নির্মাণ করবÑ সেই পথ নির্মাণে আইয়ুবের এই গ্রন্থ বিশেষভাবে সহযোগীর ভূমিকা পালন করতে পারে। এখানে এই গ্রন্থের বিশেষ তাৎপর্য।
×