ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বিশ্বকাপ ট্রফির নকশার আদ্যোপান্ত

প্রকাশিত: ০৭:৪০, ৬ জুলাই ২০১৮

বিশ্বকাপ ট্রফির নকশার আদ্যোপান্ত

বিশ্বকাপ ফুটবলে বিজয়ী দল যে ট্রফি নিয়ে গোটা বিশ্বের মানুষের সামনে নিজেদের বীরত্বের জানান দেয়, সেটি কিন্তু সাদামাটা কোন ট্রফি নয়। এর নির্মাণ শৈলী এমনই অসাধারণ, যা যে কোন দেশের মানুষেরই বিশেষ করে ফুটবলারদের অন্তত একবারের জন্য হলেও হাতে তুলে নিতে ইচ্ছে করে। এ আকাক্সক্ষা চিরকালীন সৌন্দর্যের অনন্য প্রকাশ। তাইতো বিশ্বকাপ ফুটবল এত প্রতিদ্বন্দ্বীতায় জমজমাট হয়ে ওঠে। আর এ ট্রফির ¯্রষ্টাও যেন এক অসাধারণ জীবনের অধিকারী। যে ট্রফি তাকে দিয়েছে অতুলনীয় অমরত্ব। ১৯৩০ সালে বিশ্বকাপ ফুটবলের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে বিজয়ী দলকে যে ট্রফি দেয়া হয়, তার সৃষ্টি ৪০ বছর পরে। ১৯৭০ সালের জুলে রিমে কাপ। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ফিফা ঘোষণা করে নতুন নিয়ম। যেসব দল দু’বার শিরোপা জিতেছে, তাদের কেউ তৃতীয়বার বিজয়ী হলে চিরকালের জন্য সে দেশের অধিকারে চলে যাবে জুলে রিমে ট্রফি। স্থায়ীভাবে ট্রফি নিশ্চিত করতে ফাইনালের মাঠে নামে ইতালি ও ব্রাজিল। এর আগে ইতালি ১৯৩৪ ও ৩৮ সালে এবং ব্রাজিল ১৯৫৮ ও ৬২ বিজয়ী হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ব্রাজিল ৪-১ গোলে জিতে জুলে রিমে ট্রফি স্থায়ী করে নেয়। জুলে রিমে ট্রফির নকশাকার ছিলের ফ্রান্সের ভাস্কর আবেল লাফ্ললিওয়ের। এরপরই ফিফা নতুন ট্রফির খোঁজে নামে। আহ্বান করা হয় নতুন নকশা। এজন্য ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল জুরিখে ফিফা প্রেসিডেন্ট স্যার স্ট্যানলি রিউসের নেতৃত্বে একটি বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি আহ্বান করে নকশা প্রতিযোগিতার। ২৫টি দেশ থেকে মোট ৫৩ টি নকশা জমা পড়ে প্রতিযোগিতায়। অসাধারণ প্রতীকী সৌন্দর্য আর ফটোজেনিক হওয়ায় ফিফা কমিটি সিলভিও গাজানিকার নকশা করা ট্রফিটি নির্বাচিত করে। ১৯২১ সালে ইতালিতে জন্ম নেয়া সিলভিও গাজ্জানিকার জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে ফুটবল ক্লাবের বিখ্যাত শহর মিলানে। ইতালির লোম্বারডি রাজ্যের রাজধানী মিলানের বিভিন্ন আর্ট স্কুলে শিখতে শিখতে তিনি ভাস্কর হয়ে ওঠেন। প্রথম পদকের নকশা কৈশোরেই। পরের তিন দশক কাটে অলঙ্কার এবং স্কি ট্রফি নকশা করার মধ্য দিয়ে। এক সময় মিলানের বিখ্যাত ট্রফি নির্মাতা কোম্পানি বার্তোনির সৃজনশীল পরিচালক পদেও বসেছিলেন। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে গাজ্জানিগা জমা দেয়া নকশা অনুযায়ী সোনা দিয়ে ঢালাই করে ট্রফি বানিয়ে দিলে ফিফা তা আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে। ট্রফিটা সেরা পার্সা বা হারানো মোম নামে এক অদ্ভুত কৌশলে ঢালাই করা। এ কৌশলেই কয়েক হাজার বছর আগে ইতালিতে প্রাচীন কিছু বিখ্যাত ধাতব স্থাপত্য নির্মাণ করা হয়েছিল। ১৪.৫ ইঞ্চি লম্বা এই ট্রফি ১৮ ক্যারেট সোনা দিয়ে তৈরি হলেও ওজন মাত্র সাড়ে ৬ কেজি। এর ভিতরটা ফাঁপা। ধিকিধিকি আগুনের মতো চ্যাম্পিয়নের হাত দুটি দলের বাকি সব খেলোয়াড়ের হাত দ্বারা আবৃত। সূর্যের আলোয় পৃথিবীর বক্রতায় যার প্রতিফলন হয়। ট্রফিতে দুটি ভিন্ন রেখা ধীরে ধীরে দু’জন মানুষের আকার ধারণ করে। মানুষ দু’জন দুই নায়কের প্রতীক। কারণ, ফুটবল খেলা হয় দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে। জয়ের অভিলাষে দুটি ভিন্ন ইচ্ছাশক্তি একসঙ্গে কাজ করে, শক্তি, বেগ, সামর্থ্য, গতিশীলতা, দ্রুততা, গতি, সাফল্য, বিজয়। অর্থাৎ সবকিছু ছাপিয়ে বিশ্বকে জয় করার আলিঙ্গন। বিজয়ের আনন্দের দুর্নিবার বহির্প্রকাশ রয়েছে সে ট্রফিতে। বিশ্বকাপ ট্রফি তৈরির সুবাদে সিলভিও গাজ্জানিকা পৃথিবীর মানুষের কাছে ‘মিস্টার কাপ’ নামে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। বিশ্বকাপ ট্রফির হাত ধরে তিনি ১৯৭২ সালে করেন উয়েফা কাপের নকশা। বেসবল এবং ভলিবল বিশ্বকাপের ট্রফিও তার হাতে গড়া। এছাড়া, বাস্কেটবল, সাঁতার এবং স্কি বিশ্বকাপের মেডেলের নকশাও করেন তিনি। কিন্তু এসবের কোনটাই ঘূর্ণায়মান স্বর্ণনির্মিত বিশ্বকাপের চেয়ে আইকনিক হতে পারেনি। মজার বিষয় হল দুনিয়া জুড়ে তাক লাগানো বিশ্বকাপ ট্রফির নকশাকার এবং নির্মাতা হলেও গাজ্জানিগা কিন্তু এর দ্বারা একটি পয়সাও পাননি। কারণ ফিফার নকশা প্রতিযোগিতার নিয়মাবলীতে বিজয়ী নকশার ওপর নকশাকারের কোন অধিকার থাকবে না বলে উল্লেখ করা হয়েছিল। তাই গাজ্জানিগা কখনও নিজের বানানো ট্রফির ইমেজস্বত্ব থেকে কোন আয় করতে পারেননি। কিন্তু তারপরেও তিনি ইতিহাস খ্যাত সৃষ্টিকর্মের জন্য অমর হয়ে আছেন। নিজের সৃষ্টি প্রসঙ্গে গাজ্জানিগা ২০১১ সালে বিবিসিকে দেয়া সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, বিশ্বসেরা খেলোয়াড়রা এই ট্রফি স্পর্শ করতে পারে। জিততে পারে একবার। খুব ভাগ্যবান হলে দু’বার। কিন্তু ফিফা বিশ্বকাপ ট্রফি সবসময়ই আমার হয়ে থাকবে। আমিই সত্যিকারের বিজয়ী। ২০১৭ সালের ৩১ অক্টোবর সত্যিকারের বিজয়ী হিসেবে সিলভিও গাজ্জানিগা অনন্তলোকে পাড়ি জমান। কিন্তু রয়ে গেছে তার অমর সৃষ্টি। যতদিন বিশ্বকাপ ফুটবল থাকবে, এ ট্রফি থাকবে। ততদিনই মানুষ তাকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। শংকর লাল দাশ সূত্র ঃ ফিফাডটকম, বর্তমান
×