ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আপন আলোয় পথচলা

প্রকাশিত: ০৭:৩৭, ৬ জুলাই ২০১৮

আপন আলোয় পথচলা

আইভি জামান। বাংলাদেশের ভাস্কর্য শিল্পে অন্যতম নাম। বালাদেশ জাতীয় জাদুঘরের উদ্যোগে নলিনীকান্ত ভট্টশালী গ্যালারিতে চতুর্থবারের মতো অনুষ্ঠিত হচ্ছে তার একক প্রদর্শনী । সম্প্রতি অপরাজিতার সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তার শিল্প ভাবনা, জীবনের নানা দিক। সাক্ষাতকার নিয়েছেন- পপি দেবী থাপা অপরাজিতা : আপনার জন্ম ও বেড়ে ওঠা.. আইভি জামান : জন্ম বগুড়া শহরে ১৯৫৮ সালে। বাবা ডাঃ এমদাদুল হক তরফদার ছিলেন একজন চিকিৎসা বিজ্ঞানী। মা রওশনারা তরফদার গৃহিণী ও সমাজসেবী। পাঁচ বোনের মধ্যে আমি তৃতীয়। শৈশব ও কৈশরে কেটেছে বগুড়া শহরেই। করতোয়া নদীর পাড় ঘেসে। তখন শহরটা ছিল শান্ত। লোকজনও ছিল কম। এত অট্টালিকা ছিল না। ধান ক্ষেত, নীল আকাশ, ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে দূরে দিগন্ত দেখা যেত। সবকিছু মিলিয়ে ছবির মতন। এখনও আমি সেই ছবি খুঁজতে যাই ঠিকই, কিন্তু তা আর পাই না। অপরাজিতা : আপনার স্কুল জীবন এবং উচ্চতর শিক্ষা; আইভি জামান : আমি ১৯৭৩ সালে বগুড়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করি। এরপর ঢাকা আর্ট কলেজে ভর্তি হই। যেটি বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের চারুকলা অনুষদ। এখান থেকেই ১৯৭৯ সালে খাতিমান ভাস্কর অধাপক আব্দুর রাজ্জাকের তত্ত্বাবধানে ভাস্কর্য বিষয়ে পাঁচ বছরের ¯œাতক ডিগ্রি লাভ করি। এরপর ১৯৮৮-৮৯ সালে ভারতের শান্তি নিকেতনের কলাভবনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের প্রখাত অধ্যাপক সর্বরী রায় চৌধুরীর অধীনে ভাস্কর্যের উপর ফরেন ক্যাচুয়াল ডিস্টিংশনসহ কোর্স সম্পন্ন করি। এছাড়া ভাস্কর্য শিল্পের উপর কোরিয়াসহ অনান্য দেশে ওয়ার্কশপ করি। অপরাজিতা : এ পর্যন্ত আপনার ভাস্কর্য শিল্পের প্রদর্শনী; আইভি জামান : দেশে ও বিদেশে এ পর্যন্ত আমি চল্লিশের অধিক গ্রুপ প্রদর্শনী করেছি। তিনটি একক প্রদর্শনী হযেছে। এবার চতুর্থ বারের মতো বালাদেশ জাতীয় জাদুঘরের উদ্যোগে নলিনীকান্ত ভট্টশালী গল্যারিতে একক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। অপরাজিতা : আপনার নির্মিত ভাস্কর্যগুলো কোথায় কোথায় স্থাপিত হয়েছে? আইভি জামান : কোরিয়ার কিমচিয়ন সিটির জিক জি ভাস্কর্য পার্কে, ভারতের শান্তি নিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, বালাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বালাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলো, রংপুরের পায়রাবন্দে অবস্থিত বেগম রোকেয়া কমপ্লেক্স, এশিয়াটিক সোসাইটি অব বালাদেশসহ দেশ বিদেশের অনেক স্থানে। অপরাজিতা : একজন ভাস্কর্য শিল্পী হওয়ার পেছনে উৎসাহের কারণ কি ছিল? আইভি জামান : নিজের একান্ত ইচ্ছা এবং বাবার সহযোগিতা, সাপোর্ট, এরপর স্বামী এবং শিক্ষক খ্যাতিমান ভাস্কর হামিদুজ্জামান খানের সহযোগিতা। আমি খুব ছোটবেলায় আমার চারপাশের পরিবেশ প্রকৃতি থেকে আঁকতে শিখেছি। শিশু বয়সে স্কুলের গণিত খাতার পেছনে ছবি আঁকতাম। স্কুলে পড়ালেখা শেষে স্কুলে বসেই খাতার পেছনে ছবি আঁকতাম। এসব দেখে ম্যাডাম একদিন আমায় বকা দিলেন এব বাবাকে আসার জন্য বললেন। সেদিন তিনি বাবাকে বলেছিলেন, ‘আপনার মেয়ে তো সারাক্ষণ ছবি আঁকে, ওকে আর্ট কলেজে ভর্তি করে দিন।’ তখন বাবা বিষয়টি খেয়াল করলেন। আমি ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় জানতে পারলাম আর্ট নিয়ে পড়া যায়। তারপর পড়ার উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসা। অপরাজিতা : ভাস্কর্য শিল্পে এলেন কেন? আইভি জামান : আমার পড়ার বিষয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে আমার স্বামী এব শিক্ষক হামিদুজ্জামান খানের বিশেষ সহযোগিতা ছিল। তিনি মনে করেছিলেন আমি এ বিষয়ে ভাল করব। তবে আমার সাবসিডিয়ারি বিষয় ছিল চিত্রশিল্প। অপরাজিতা : কোন বিষয়ের উপর কাজ করে বেশি আনন্দ পান? আইভি জামান : অবশ্যই ভাস্কর্য। কারন এর প্রসেসটা আমার জানা আছে। আমি যে কাজটি করব মনে তার একটা শেপ ঠিক করি। এরপর সেটা কাগজে ড্রয়িং করি। পরে তা কম্পিউটারে বড় করি। এরপর নির্ধারণ করি কাজটি আমি পাথর নাকি অন্য কোন ধাতব পদার্থ দিয়ে করব। অপরাজিতা : ভাস্কর্য শিল্পে আমাদের দেশের বর্তমান অবস্থান; আইভি জামান : আমাদের অনেক ছেলে-মেয়ে এ বিষয়ে পড়াশোনা করছে। তারা ভালই করছে। আসলে কাজ করার জন্য জায়গা কম। আমি মনে করি আমাদের পেইন্টারদের মতো অনেক বেশি কাজ করা উচিত। তাহলে ছেলে-মেয়েরা বেশি কাজ করতে পারবে। বিশেষ করে মেয়েরা আরও কাজের সুযোগ পাবে। অপরাজিতা : আমাদের দেশে মহিলা ভাস্কর্য শিল্পীর সংখ্যা হাতেগোনা দুই একজন। এর পেছনে কি প্রতিবন্ধকতা কাজ করে বলে আপনি মনে করেন। আইভি জামান : প্রথম প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে জায়গার অভাব। এরপর পারিবারিক সহযোগিতার অভাব। সংসার জীবনে স্বামী যদি একই বিষয়ের, মানসিকতার না হয় তাহলে সে, এ কাজ পছন্দ করবে না। যেমন আমি আমার কাজের প্রয়োজনে লোহার দোকানেও চলে যাই কিন্তু সব মেয়েরা হয়ত সেটা পারে না। এর জন্য সামাজিক প্রতিবন্ধকতাও দায়ী। অপরাজিতা : আপনার শিল্পে কোন কোন বিষয়গুলো উঠে এসেছে? আইভি জামান : আমি নারীদের উপর অনেক কাজ করেছি। গৌতম বুদ্ধকে নিয়ে, মানুষ নিয়ে কাজ করেছি। মানুষকে বলা হয় জীবন্ত ভাস্কর্য। দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র যেমন, আমি যখন একটি চুড়ি দেখি তখন তার মধে ভাস্কর্য দেখি। ভাবি যদি এটাকে বড় করা যায় তাহলে কেমন হয়। কোন জিনিসকে প্রয়োজনের উর্ধে যখন ভাবি এটা ভাস্কর্য হতে পারে তখন সেটা পিক করি। এবং এটার নান্দনিক রূপ দেয়ার চেষ্টা করি। প্রকৃতিতেও অনেক ভাস্কর্য আছে। আমার ভাস্কর্যের অনেক বিষয়ই প্রকৃতি থেকে নেয়া। প্রকৃতিই আমার ক্লাস রুম। যেমনÑ ক্লাস রুম ছিল চারুকলা আর শান্তিনিকেতন। আমি প্রকৃতি থেকে নেই, তবে হুবহু না। আমি প্রকৃতি থেকে এর নির্যাসটা নিয়ে আমার মতো করে একটা বলিষ্ঠ ফর্মের চিন্তা করি। অপরাজিতা : পেশাগত জীবনে আপনি[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশ একজন শিক্ষক, শিক্ষকতার পাশাপাশি শিল্পের জন্য এতটা সময় কিভাবে পান? আইভি জামান : আমি টিভি দেখি না। মার্কেটে যাই খুবই কম। স্কুলে যখন অবসর থাকি তখন আমি ড্রয়িং করি। একটা বিষয় মাথায় এলো তার ছোট করে একটা ছবি আঁকলাম। এভাবে আঁকতে আঁকতে একদিন খাতাটা ভরে যায়। সব ছবির মধ্যে অধিক পছন্দেরটা বাছাই করি। একদিন হামিদুজ্জামানকে দেখাই কোনটা ভাল। এভাবেই চলে কাজের প্রক্রিয়া। আমার মনপ্রাণ কাজের মধ্যেই থাকে। অপরাজিতা : স্পেস ও ম্যাচের বিষয়টি আপনার শিল্পকর্মে কিভাবে উঠে এসেছে? আইভি জামান : আমাদের চারপাশের যে শূন্য অবস্থান, সেই শূন্যের মধ্যে শেপ দিয়ে ওই জায়গাটিকে আমি দখল করি। তখন আমার ভাললাগে। একজন পেইন্টার যেমন বৃষ্টির সময় প্রকৃতির একটা রূপ দেখে তেমনি আমি ফর্ম দেখি। অপরাজিতা : আপনি শিল্পে বিভিন্ন ধাতব পদার্থের ব্যবহার করেছেন এর কারণ? আইভি জামান : ভাস্কর্যটি যাতে ভঙ্গুর না হয়। এটাকে বলিষ্ঠ বোঝাতে, এর মধ্যকার শক্তিকে বোঝাতে ধাতব পদার্থের ব্যবহার করেছি অপরাজিতা : খোদাইকৃত মানব অথবা প্রাণীর বাইরে আপনার শিল্পে বিষয়টি উঠে এসেছে ভিন্নভাবে। যদি ব্যাখ্যা করতেন। আইভি জামান : পূর্বে হুবহু ভাস্কর্য ছিল। এব তা খুবই নিখুঁতভাবে করা হতো। আমরা এখন ওইরূপ থেকে বেড়িয়ে এসেছি। আমি হুবহু করি না। আধুনিক ভাস্কর্যের গতির সঙ্গে এগোচ্ছি। আমার ভাস্কর্য লাইন প্লে করে। অপরাজিতা : আমাদের দেশে ভাস্কর্য শিল্পের বর্তমান অবস্থা; আইভি জামান : আমাদের দেশ ভাস্কর্যে অনেক এগিয়ে। আমি চাই আরও এক ঝাঁক নতুন শিল্পী বেড়িয়ে আসুক। প্রতেকে তার নিজেস্ব চিন্তা ধারায় ভাস্কর্য চর্চা করুক। অপরাজিতা : আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় ভাস্কর্য শিল্পীর মূল্যায়ন হচ্ছে কি? আইভি জামান : আগের চেয়ে এখন মূল্যায়ন হচ্ছে বেশি। তবে পেয়িটি এর মতো অতটা না। আমরা আশাবাদী। অপরাজিতা : ভাস্কর্য শিল্পী হয়ে উঠতে কোন প্রতিবন্ধকতা... আইভি জামান : নিজের ভেতরে যদি আত্মবিশ্বাস থাকে, সে ক্ষেত্রে কোন বাধাই বাধা মনে হয় না। যদি কাজ করার ইচ্ছা থাকে আর উদ্দেশ্য সৎ হয় তাহলে করা সম্ভব। কাজ যদি আমি করি তবে বাধা দেয়ার কেউ নেই। অপরাজিতা : শৈল্পিক জগতে উঠে আসার ক্ষেত্রে একজন নারী কি পুরুষের সমমর্যদা পাচ্ছে? আইভি জামান : অবশ্যই। আমরা যদি নিজেরাই নিজেদের বাধা মনে করি, নারী ভেবে পিছিয়ে থাকি তাহলে আমাদের থেমে থাকার কারণ আমরাই হব। আমি মনে করি আমি একজন মানুষ। পুরুষেরা যেটা পারে আমিও তা পারি। অপরাজিতা : ভাস্কর্য শিল্পে বালাদেশকে কেমন দেখতে চান? আইভি জামান : সব অফিস, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদালয়ে, বড় বড় বিল্ডিংয়ের সামনে ভাস্কর্য থাকবে। সরকারী প্লানিং এ ভাস্কর্যের জন জায়গা থাকবে। আমি পূর্ণ ভাস্কর্য উদ্যান দেখতে চাই। যে উদ্যানে আমাদের সমস্ত ভাস্কররা কাজ করবে।
×