ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

সমীরণ বিশ্বাস

বায়োচার ॥ নতুন দিগন্তের উন্মোচন

প্রকাশিত: ০৭:৩৫, ৬ জুলাই ২০১৮

বায়োচার ॥ নতুন দিগন্তের উন্মোচন

বায়োচার এক ধরনের চারকোল বা কয়লা যা পাইরোলাইসিস (সীমিত অক্সিজেনের উপস্থিতিতে বা অক্সিজেনবিহীন তাপের) পদ্ধতির সাহায্যে বিভিন্ন জৈব পদার্থ, যেমনÑ ধানের তুষ, কাঠের গুঁড়া, কাঠ, মুরগির বিষ্ঠা এমনকি নালা-নর্দমার বর্জ্য পদার্থ, আবর্জনা থেকে তৈরি করা হয়। বায়োচার পানি বিশুদ্ধকরণ এবং মাটির লবণাক্ততা কমাতে ভূমিকা রাখে। মাটির স্বাস্থ্যরক্ষায় বায়োচার একটি অদ্বিতীয় অনুষঙ্গ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, বায়োচার জমিতে একবার ব্যবহার করলেই দীর্ঘ সময় আর ব্যবহার করতে হয় না। বায়োচার কার্বনকে বছরের পর বছর মাটিতে ধরে রাখে, ফলে মাটির স্বাস্থ্যের স্থায়ী উন্নয়ন ঘটে। বায়োচার মাটিতে প্রায় ১০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। আর শতবর্ষ ধরে এটি মাটির উর্বরা শক্তি বৃদ্ধি করে নানাভাবে। কৃষিতে বায়োচারের ভূমিকা সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে কৃষি বিজ্ঞানেরও ক্রমাগত উন্নতি হচ্ছে। বায়োচার তার একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র। ক্ষুদ্র অংশ হওয়া সত্ত্বেও বায়োচার কৃষিজ পণ্য উৎপাদন থেকে শুরু করে পরিবেশের ভারসাম্য-রক্ষায় সমান ভূমিকা পালন করছে। বায়োচার ব্যবহারের ফলে মাটির উর্বরতা শক্তি, পানির ধারণ-ক্ষমতা, সারের কার্যকারিতা বৃদ্ধি পায়। বায়োচার মাটিতে গাছের খাদ্য উপাদানগুলোকে ধরে রাখে, মাটিতে লবণাক্ততা ও খরার প্রভাব এবং মাটির অম্লত্ব দূর করে। মাটিকে সংশোধন করে বায়োচার মাটিতে অবস্থানকারী ছোট-ছোট অণুজীবকে সক্রিয় করে তোলে। পরিবেশবান্ধব এই বায়োচার পদ্ধতি ব্যবহারে জমির ফলনও দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায়। বায়োচার ব্যবহারে রাসায়নিক সার ও পানি সেচ কম দিতে হয়; ফলে কৃষকের খরচ কমে যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য মাটিতে বায়োচার ব্যবহার করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের দিনাজপুরের নবাবগঞ্জে আবাদি জমিতে পরিবেশবান্ধব বায়োচার পদ্ধতি ব্যবহার করে ধানের চারা রোপণ করা হচ্ছে। বায়োচার আলু, সবজি চাষেও ব্যবহার করা হচ্ছে। কোথায় পাওয়া যাবে? কৃষক এবং কৃষাণদের এই সাফল্যের পেছনে রয়েছে বেসরকারী সংস্থা খ্রিস্টিয়ান কমিশন ফর ডেভেলপমেন্ট ইন বাংলাদেশ (সিসিডিবি)। যেখানে মাটিতে জৈব উপাদান থাকার কথা শতকরা ৫ ভাগ, সেখানে শিবালয়ের ১২ জন কৃষকের মাটি পরীক্ষা করে তা পাওয়া গেছে শতকরা এক ভাগ, কোথাও এক ভাগের কম আবার কোথাও এক ভাগের সামান্য কিছু বেশি (দুই ভাগের কম)। মাটির এই জীর্ণদশা ফিরিয়ে আনতে চিন্তা, চেতনা ও নিরলস পরিশ্রম দ্বারা সিসিডিবির ডেভেলপমেন্ট পলিসি এ্যাডভাইজার এবং বায়োচার প্রজেক্টের টিম লিডার এম মাহাবুবুল ইসলাম (কানাডিয়ান বিজ্ঞানী জুলিয়ানের সমন্বয়ে) উদ্ভাবন করেছেন ‘আখা’ (কৃষিবান্ধব চুলা)। এতে রান্নার পাশাপাশি উৎপাদিত হয় বায়োচার, যা পৃথিবীর আর কোন দেশে হয় না। আখা (গ্যাসোফায়ার) এমন একটি রান্নার চুলা, যাতে কাঠ, খড়-কুটা, ডাল-পাতা, ধানের তুষ, কাঠের গুঁড়া, কচুরিপানা, গোবর ইত্যাদি ব্যবহার করে পাইরোলাইসিস পদ্ধতিতে বায়োচার তৈরি করা হয়। ‘আখা’ বা বিশেষ ধরনের এক চুলায় পোড়ানো কাঠ-কয়লা নিয়ে গুঁড়া করে ক্ষেতে ছিটিয়ে দিতে হয়। বিশেষ ধরনের এই কাঠ কয়লা পোড়ানো চুলা এখন সিসিডিবি বিক্রি করে অল্প দামে। সিসিডিবির মার্কেট ফ্যাসিলিটেটর আবু সুফিয়ান জানান, তারা পাঁচশ’ টাকা মূল্যে আগ্রহীদের মাঝে তাদের আখা নামক বিশেষ চুল্লি বিক্রি করেন। আবার যে কোন সময় বিক্রিকৃত আখা তারা ফেরত নেয়। সেক্ষেত্রে ক্রেতাকে আখার মূল্য ফেরত দিয়ে দেয়া হয়। এই আখা ব্যবহার করলে শতকরা ৩০ ভাগ জ¦ালানি সাশ্রয়ী হবে ও ৯৫ ভাগ ধোঁয়ামুক্ত পরিবেশে রান্না করা যাবে। অভাবনীয় সাফল্য মানিকগঞ্জের ছোট কুষ্টিয়া গ্রামের আদর্শ কৃষক মো. খোরশেদ। গত মৌসুমে তিনি ৫৬ শতাংশ জমিতে বেগুন, বাঁধাকপি, ফুলকপি ও পেঁপে চাষ করেছিলেন। চাষের সময় বেগুনের ২ শতাংশ, বাঁধাকপির এক শতাংশ, ফুলকপির এক শতাংশ এবং পেঁপের এক শতাংশ জমিতে তিনি ব্যবহার করেছিলেন বায়োচার। তিনি জানান, বায়োচার ব্যবহৃত জমিতে সার ও কীটনাশক যেমন খুবই কম লেগেছে, তেমনি সেচও দিতে হয়েছে আগের চেয়ে প্রায় অর্ধেক। এ থেকে একদিকে যেমন উৎপাদন খরচ কমেছে, তেমনি ফসলও পেয়েছেন আগের তুলনায় বেশি। মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলায় বায়োচার ব্যবহার করে অভাবনীয় সাফল্যের দেখা পাচ্ছেন এই উপজেলার কৃষক এবং কৃষাণীরা। বায়োচার ব্যবহার করে কৃষক এবং কৃষাণীরা আগের তুলনায় এখন কম খরচে বেশি ফসল ঘরে তুলছেন এবং সফলতার মুখ দেখছেন। আখার গুণাবলী স¤পর্কে আমডালা গ্রামের আখা ও বায়োচার ব্যবহারকারী দলের আহ্বায়ক মনখুশি হালদার বলেন, ‘আখায় তাড়াতাড়ি রান্না হয়, খড়ি কম লাগে, একবার খড়ি সাজিয়ে দিলে রান্না হয়ে যায়, তাপ কম বেশি করা যায়, ধোঁয়া হয় না, হাঁড়ি-পাতিল কালি হয় না এবং যে জ¦ালানি পোড়ানো হয়, রান্না শেষে তার ৪ ভাগের এক ভাগ বায়োচার পাওয়া যায়।’ বায়োচার বিক্রি করে তার পরিবার আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে। বায়োচার উৎপাদনকারী ও ব্যবহারকারী স¤পর্কে সিসিডিবি, দশচিড়া, শিবালয়, বায়োচার প্রজেক্টের মার্কেট ফ্যাসিলিটেটর বলেন, ‘শিবালয় এলাকায় ৯টি গ্রামের ৩৭টি পরিবার রান্নার পাশাপাশি বায়োচার উৎপাদন করছেন এবং ৩টি নার্সারি, ২টি প্রাইভেট ফার্ম, ৪০ জন কৃষাণী ও ৩০ জন কৃষক উৎপাদিত বায়োচার ব্যবহার করছেন। এছাড়াও বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, শেরে বাংলা কৃষি বিশ^বিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু কৃষি বিশ^বিদ্যালয় ও হাজি দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয় বায়োচার নিয়ে গবেষণা করছে। বায়োচার স¤পর্কে শিবালয় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘মাঠ-পর্যায়ে বায়োচার ব্যবহার অত্যন্ত সার্থক ও সফলভাবে পরীক্ষিত হয়েছে। মাঠ-কর্মীদের মাধ্যমে আরও উন্নত পর্যায়ে এর বিস্তৃতি ঘটলে কৃষি উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করবে।’ আমাদের এই মাটির প্রাণ হচ্ছে জৈব পদার্থ। আর এই জৈব পদার্থের পরিমাণ আমাদের দেশের মাটি থেকে দিন-দিন ভয়ানকভাবে কমে যাচ্ছে! তাই মাটির দীর্ঘস্থায়ী স্বাস্থ্যরক্ষায় এবং মাটির জৈব পদার্থ বৃদ্ধিতে বায়োচার একটি অদ্বিতীয় অনুষঙ্গ। লেখক : কো-অর্ডিনেটর, কৃষি ও বীজ কর্মসূচী, সিসিডিবি
×