ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

চক্রের সাত সদস্য গ্রেফতার

ওরা দিনে দর্জি, সেলসম্যান মুহুরি, ট্যাক্সিচালক- রাতে ডাকাত, ছিনতাইকারী

প্রকাশিত: ০৫:৫৪, ৬ জুলাই ২০১৮

ওরা দিনে দর্জি, সেলসম্যান মুহুরি, ট্যাক্সিচালক- রাতে ডাকাত, ছিনতাইকারী

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ওদের প্রধান টার্গেট লেনদেনকালে বিভিন্ন ব্যাংক, বিকাশসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টাকা ছিনতাই করা। কেউ লেনদেনকারীকে অনুসরণ করে, কেউ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সামনে দাঁড়িয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। এরপর ব্যাংকে টাকা জমা দিতে গেলেই ব্যাংকের নিচেই সংঘবদ্ধ হয়ে গুলি ছোড়ে আতঙ্ক তৈরির মাধ্যমে টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। এরা পেশায় কেউ দর্জি, সেলসম্যান, পোশাককর্মী, মুহুরি, জমির দালাল বা ট্যাক্সিক্যাব চালক। পেশা ভিন্ন হলেও দিনশেষে সবাই সংঘবদ্ধ ডাকাত ও ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য। এ রকম চক্রের সাত সদস্যকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। গ্রেফতাররা হচ্ছে সাগর বাড়ৈ (৩৫), রুবেল (৩৫), মোঃ বাবুল ওরফে বাবু (৩৬), মোঃ আনোয়ার হোসেন (৩৫), স্বপন মাহমুদ (৪৯), ইউসুফ আলী (২৮) ও আনোয়ার হোসেন (২৮)। বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কাওরানবাজারে র‌্যারের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব-১ এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর মোঃ রাকিবুজ্জামান। মেজর মোঃ রাকিবুজ্জামান জানান, বিভিন্ন পেশায় জড়িত সংঘবদ্ধ সাতজন এর আগে গত ১৩ মে গাজীপুর জেলার চান্দনা চৌরাস্তা এলাকার উনিশে টাওয়ারের নিচে রবি ও বিকাশের এজেন্টের ১৫ লাখ টাকা ছিনতাই করে চাঞ্চল্য ছড়ায়। এর পর ছায়া তদন্তে নেমে তাদের সন্ধান পায় র‌্যাব। বুধবার গভীররাতে রাজধানীর উত্তরা থেকে সংঘবদ্ধ চক্রের ওই সাত সদস্যকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১ এর সদস্যরা। এ সময় তাদের কাছ থেকে তিনটি বিদেশী অস্ত্র ও ১৬ রাউন্ড গুলি জব্দ করা হয়। র‌্যাব-১ এর কোম্পানি কমান্ডার জানান, গত ১৩ মে গাজীপুর চান্দনা চৌরাস্তার উনিশে টাওয়ারের নিচে ছিনতাইকারীরা রবি ও বিকাশের এজেন্ট মোঃ আসাদুর রহমান আসাদ (২৮) এবং ইকবাল হোসেনের (৩৯) ১৫ লাখ টাকা নিয়ে পালিয়ে যায়। এ সময় একই প্রতিষ্ঠানের সুমন মল্লিক নামের এক কর্মী আহত হয়। চান্দনা চৌরাস্তা গ্রেটওয়াল হাউজিং সোসাইটির নিজ প্রতিষ্ঠান জমাদ্দার এন্টারপ্রাইজ নামক প্রতিষ্ঠানের হিসাবরক্ষক পদে মোঃ আসাদুর রহমান আসাদ ও সহকারী হিসাবরক্ষক পদে ইকবাল হোসেন এবং স্টোর ম্যানেজার পদে সুমন মল্লিক নিয়োজিত। জমাদ্দার এন্টারপ্রাইজের একটি রবি ও বিকাশ এজেন্টভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। প্রকাশ্য দিবালোকে গুলি করে এ ধরনের ছিনতাইয়ের ঘটনা সারাদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। ছিনতাইকারীদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনতে র‌্যাব তাৎক্ষণিক ছায়া তদন্ত শুরু করে। র‌্যাবের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে জানা গেছে, উত্তরার বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে টাকা ছিনতাই করার উদ্দেশ্যে একত্রিত হয়েছে চক্রটি। ওই খবরে র‌্যাবের একটি দল সেখানে অভিযান চালিয়ে ওই সাতজনকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতাররা সংঘবদ্ধ ছিনতাই ও ডাকাত দলের সদস্য। তারা দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন জায়গায় ডাকাতি ও ছিনতাই করে আসছিল। তিনি বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ছিনতাইকারী চক্রটির প্রধান সাগর ও তার অন্যান্য সহযোগী গত ১৩ মে গাজীপুর জেলার চান্দনা চৌরাস্তার উনিশে টাওয়ারের নিচে রবি ও বিকাশের দুই এজেন্টকে গুলি করে ১৫ লাখ টাকা ছিনতাই কাজের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে। গ্রেফতার সাগর জানায়, তারা এক সপ্তাহ ধরে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই করার জন্য প্রস্তুতি নিলেও বিভিন্ন কারণে সফল হতে পারেনি। র‌্যাব জানায়, সাগর পেশায় একজন মুহুরি। সে ২০০০ সাল হতে এই পেশায় নিয়োজিত। ২০১৩ সালে সাগরের জনৈক বেনজামিনের সঙ্গে পরিচয় হয়। পরবর্তীতে বেনজামিনের মাধ্যমে জনৈক আনোয়ারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। সে ছিনতাইচক্রে যোগ দেয়। ২০১৭ সালে আনোয়ার আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে গুলি বিনিময়ে নিহত হলে সাগর ছিনতাই চক্রটির নেতৃত্ব দেয়। সাগর এর আগে ডাকাতি ও ছিনতাই মামলায় দুবার জেল খাটে। প্রথমবার সাত মাস। দ্বিতীয়বার দুই মাস কারাবাস শেষে জামিনে বেরিয়ে আসে। জেলে থাকাকালীন গ্রেফতার সাগরের সঙ্গে ছিনতাই চক্রের অপর সদস্য আনোয়ার ও কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। সাগর তাদের তার চক্রে যোগদানের কথা জানায়। জেল হতে বের হয়ে আসামি সাগর অনেক ছিনতাই কাজে অংশ নেয়। সব কাজে সে নেতৃত্ব দেয়। অপরদিকে গ্রেফতারকৃত রুবেল পেশায় একজন দর্জি। রাজধানীর নিউমার্কেটের গাউছিয়ায় দর্জির কাজ করে। ২০১৭ সালে আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে গুলিবিনিময়ে নিহত ছিনতাই চক্রের সদস্য আনোয়ারের মাধ্যমে রুবেল এ চক্রে যোগ দেয়। সাগর ও রুবেল যোগসাজশে অবৈধ অস্ত্র ও গুলি ক্রয় করে ছিনতাই কাজে ব্যবহার করে বলে স্বীকার করে। এক্ষেত্রে অস্ত্র সরবরাহকারী ছিনতাই করা অর্থের দ্বিগুণ টাকা নেয় বলে সে জানায়। গ্রেফতারদের মধ্যে বাবুল পেশায় একজন সেলসম্যান। সে নিউমার্কেটের চাঁদনী চকে একটি দোকানে কাজ করে। কাজের সূত্র ধরে একই মার্কেটে কর্মরত রুবেলের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। বাবুলের বিরুদ্ধে আশুলিয়া ও সাভারে একাধিক ছিনতাই ও ডাকাতির মামলা থাকায় হাইকোর্টের মুহুরি সাগরের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে তার। সাগর ও রুবেলের মাধ্যমেই সে ছিনতাই চক্রে যোগ দেয়। বাবু ডাকাতি ও ছিনতাই মামলায় মোট ১৭ মাস কারাভোগ করে বলে স্বীকার করে সে। আরেক গ্রেফতারকৃত আনোয়ার হোসেন পেশায় একজন গাড়িচালক। সে ২০০৫ সালে ঢাকায় আসে। সে বিমানবন্দর এলাকায় ভাড়ায় ট্যাক্সিক্যাব চালায়। মাদক ব্যবসার দায়ে একবার জেলে যায়। সেখানে তার ছিনতাইকারী ও ডাকাত চক্রের হোতা সাগরের সঙ্গে পরিচয় হয়। দুই মাস পর জেল থেকে বের হয়ে আনোয়ার ও সাগরের সঙ্গে ওই ছিনতাইচক্রে যোগ দেয়। নিয়মিত ছিনতাই কাজে অংশ নেয় তারা। গ্রেফতারকৃত স্বপন মাহমুদ পেশায় একজন জমির দালাল। ১৯৮৮ সালে আসামি স্বপন ঢাকায় আসে। বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানিতে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত চাকরি করে। পরবর্তীতে সে সৌদি আরব যায়। প্রতারণার শিকার হয়ে ৪ মাস পর দেশে ফিরে আসে। সে ২০১৬ সালে সাগর, বাবু ও রুবেলের সঙ্গে ডাকাতি ও ছিনতাই মামলায় গ্রেফতার হয়। সে ছিনতাই চক্রটির টার্গেট সংগ্রহকারীর কাজ করত বলে স্বীকার করে। গ্রেফতারকৃত ইউসুফ আলী পেশায় একজন পোশাককর্মী। ২০০৮ সালে সে ঢাকায় আসে। সাভারে একটি সোয়েটার গার্মেন্টসে দীর্ঘদিন শ্রমিকের কাজ করে। পরবর্তীতে সে সহকারী ঠিকাদারের কাজ শুরু করে। কাজের সূত্র ধরে ২০১৭ সালে আশুলিয়ায় পুলিশের সঙ্গে গুলি বিনিময়ে নিহত আনোয়ারের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। তার মাধ্যমে বেশি উপার্জনের লোভে এই চক্রের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। অন্যদিকে গ্রেফতারকৃত আনোয়ার হোসেন পেশায় একজন গার্মেন্টসকর্মী। ২০১০ সালের দিকে সে নিজ জেলা নীলফামারীতে সোয়েটার ফ্যাক্টরি খোলে। ২০১৩ সালে বিভিন্ন কারণে তার ফ্যাক্টরি ৮-৯ মাস বন্ধ থাকায় সে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আবারও সে ঢাকায় চলে আসে ও আবারও সাভারের একটি সোয়েটার কারখানায় চাকরি নেয়। চাকরির সূত্র ধরে ইউসুফের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। ইউসুফের মাধ্যমেই আনোয়ার ও সাগরের সঙ্গে পরিচয় হয়। তাদের মাধ্যমে সে ছিনতাই চক্রে যোগ দেয়। বিভিন্ন পেশার এই ছিনতাইকারী ও ডাকাত দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট থানায় মামলা হয়েছে বলে জানান র‌্যাব-১ এর কোম্পানি কমান্ডার মেজর মোঃ রাকিবুজ্জামান।
×