ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বহাল তবিয়তে পাহাড়খেকোরা

চট্টগ্রামে পাহাড়ে ছোট ছোট ফাটল ॥ ধস আতঙ্ক

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ৬ জুলাই ২০১৮

চট্টগ্রামে পাহাড়ে ছোট ছোট ফাটল ॥ ধস আতঙ্ক

মাকসুদ আহমদ, চট্টগ্রাম অফিস ॥ চট্টগ্রামে গত তিন দিনের অতি বৃষ্টিতে পাহাড় ধসের আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বুধবার রেলের চীফ এস্টেট দফতরের পক্ষ থেকে মতিঝর্ণা এলাকায় মাইকিংয়ের পর অনেকে মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে অন্যত্র চলে গেলেও পাহাড় ছাড়তে নারাজ পাহাড়খেকোদের কেয়ারটেকারসহ অধিকাংশরাই। কারণ পাহাড়ের কোল ও চূড়ায় কম ভাড়ায় থাকার সুযোগ যেমন রয়েছে তেমনি পাহাড়খেকোরাও হতদরিদ্র শ্রেণীকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা লুটছে। ঝুঁকিপূর্ণ ১৩টি পাহাড়ে ফাটল আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। আকবরশাহ এলাকায় রেলের পাহাড়, মতিঝর্ণার টাঙ্কির পাহাড় ও বায়জিদ মিয়ার পাহাড়সহ বেশকিছু পাহাড়ে ছোটবড় ফাটল দেখা দিয়েছে। এসব পাহড়বাসী কেউ কেউ ঘর ছাড়তে শুরু করেছে। আবার পাহাড়খেকোদের কেয়ারটেকাররা মাটির বস্তা দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ আবাসগৃহ ঠেকানোর চেষ্টা করছে। অতি বৃষ্টির কারণে যে কোন মুহূর্তে পাহাড়ধসের আশঙ্কা করা হচ্ছে। এদিকে, টানা বৃষ্টির কারণে পাহাড়বাসীদের মধ্যে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। গত সোমবার থেকে বৃষ্টি মাত্রাতিরিক্ত। কারণ গত দুই দিনে অতিরিক্ত বৃষ্টির ফলে পাহাড়ের মাটি অনেকটা নরম হয়ে গেছে। এরমধ্যে গত মঙ্গলবার ১৩৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে বলে আবহাওয়া অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে। অভিযোগ রয়েছে, লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকা ছাড়াও রেলের পূর্বাঞ্চলের খুলশী থানাধীন আকবরশাহ মাজার এলাকায় প্রায় সাড়ে দশ একর ভূমি অবৈধ দখলদারদের দখলে রয়েছে। এরমধ্যে ৯০ শতাংশই পাহাড়ী ভূমি। আকবরশাহ এলাকায় এসব পাহাড়ী ভূমি দখলে নিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যানারে থাকা অসাধুরা পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ভাড়া ঘর নির্মাণ করেছে। ফলে পাহাড়ের পাদদেশে থাকা হত দরিদ্র শ্রেণীর উপর যে কোন মুহূর্তে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটতে পারে। সচিবালয়ে কর্মরত প্লানিং কমিশনের অফিস প্রধান মোহাম্মদ ছায়েদুজ্জামান ও তার ভাইয়েরা মিলে পরিবেশ ভবনের সামনে পাঁচ বছর আগে দুটি পাহাড় কেটে প্রায় সাবাড় করে দিলেও পরিবেশ অধিদফতর কোন পদক্ষেপ নেয়নি। পরিবেশের কর্মকর্তাদের মাসোহারা দিয়ে একই স্থানে পাহাড় কেটে ৫তলা দুটি ভবন তৈরি করছে আব্দুল মালেক সওদাগর। রেলের সিআরবির এস্টেট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, পাহাড়ের পাদদেশে থাকাদের ও রেলের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে গড়ে উঠা বস্তিগুলোকে সতর্কীকরণ নোটিস দেয়া হলেও তারা স্থান ত্যাগে অপারগ। এ বিষয়ে চট্টগ্রাম মহানগরী এলাকায় রেলের মালিকানাধীন লালখান বাজার, মতিঝর্ণা এলাকা, বাটালি হিল, আমবাগান, পাহাড়তলীর প্রধান সরঞ্জাম নিয়ন্ত্রক দফতরের বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে গড়ে উঠা বস্তি, পুলিশ বিট মোড়ের সেলস ডিপোর বাউন্ডারি ওয়াল ঘেঁষে গড়ে উঠা বস্তি, পাহাড়তলীর জেনারেল ইলেকট্রিক শপ ও জোড় ডেবার উত্তর পাশে গড়ে উঠা বস্তির লোকজনকে মৃত্যুঝুঁকি এড়াতে সরে যাওয়ার জন্য নোটিস দেয়া ও মাইকিং করা হয়েছে। কিন্তু কোন লাভ হচ্ছে না। পাহাড় ছাড়তে নারাজ তারা। এদিকে, টাইগারপাস ও মতিঝর্ণা এলাকায় থাকা রেলের পাহাড়ের পাদদেশে থাকারা অন্যত্র সরে যেতে নারাজ। পাহাড়ধসের আশঙ্কায় পূর্বাঞ্চলীয় রেলওয়ের পক্ষ থেকে ঝুঁকিপূর্ণদের সরিয়ে নেয়ার জন্য নানা পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা শেষ পর্যন্ত ভেস্তে গেছে। জেলা প্রশাসনের সহায়তায় ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে উচ্ছেদের পদক্ষেপ নেয়ার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন হবে কিনা তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। তাছাড়া গত কয়েক দিন ধরে রেল কর্তৃপক্ষ ঝুঁকিপূর্ণদের সরে যেতে বললেও অবৈধ দখলদাররা রেল ভূমি ছাড়তে নারাজ। এ বিষয়ে রেলের পূর্বাঞ্চলীয় চীফ এস্টেট অফিসার ইশরাত রেজা জনকণ্ঠকে জানান, প্রতিনিয়তই মাইকিং করা হচ্ছে রেলের পাহাড় থেকে সরে যাওয়ার জন্য। কারণ অতি বৃষ্টিতে পাহাড়ের মাটি নরম হয়ে যেমন ফাটল সৃষ্টি হতে পারে তেমনি পাহাড়ের মাটি ধসে মৃত্যুঝুঁকিও রয়েছে। গত মাসে আকবরশাহ এলাকায় রেলের পাহাড় থেকে ঝুঁকিপূর্ণদের শতাধিক বস্তিঘর উচ্ছেদও করা হয়েছে। এর পরও দমানো যাচ্ছেনা পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতঘর নির্মাণ। এদিকে, পাহাড়তলী জোড় ডেবার উত্তর পাশে, জাকির হোসেন রোড সংলগ্ন ঝাউতলা রেল লাইনের পাশে গড়ে উঠা বস্তি, শহীদ লেন আবাসিক এলাকার দেয়াল ঘেঁষে গড়ে উঠা বস্তি, বাটালি রোডের জামতলার বস্তি, জামতলা হাসপাতাল কলোনি এলাকায় বেশকিছু বস্তি গড়ে উঠেছে অবৈধ দখলদারের প্রভাবে। টাইগার পাস পুলিশ বক্সের উত্তর ও পূর্ব পাশে পাহাড়ের পাদদেশে এবং মাঝামাঝিতে গড়ে উঠা কাঁচা ঘর, তুলাতুলি ও ফয়স লেক এলাকার ১, ২ ও ৩ নং ঝিল এলাকায় পাহাড়ের কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে কাঁচা ও সেমি পাকা ঘর। এসব ঘরে বসবাস করছে শত শত পরিবার। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় এসব পরিবারের লোকজনকে কম ভাড়ায় থাকতে সহায়তা করছে বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যানারে থাকা ভূমিদস্যুরা। ফলে রেল ও জেলা প্রশাসন উচ্ছেদ অভিযানে গেলেও তাদের বাধার মুখে বিভিন্ন সময় ফিরে আসতে হচ্ছে। এদিকে, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত মাসে বায়জিদের মিয়ার পাহাড়, লালখান বাজারের মতিঝর্ণা ও আকবরশাহ এলাকার রেলের পাহাড় থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করলেও কোন লাভ হয়নি। আবারও গড়ে তুলেছে ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা। জেলা প্রশাসনের তালিকা অনুযায়ী নগরী ও আশপাশ এলাকায় থাকা ৩০ টি পাহাড়ের মধ্যে নগরীর ১৩টি পাহাড়ে প্রায় সাড়ে ৯শ’রও বেশি পরিবার রয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১২ সালের ২৭ জুন আওয়ামী লীগের সাইনবোর্ডে স্থানীয় ইয়াসিন গং কর্তৃক আকবরশাহ এলাকায় কর্তনকৃত পাহাড়ের মাটিধসে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ ঘটনায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ও রেলের পক্ষ থেকে মামলা দায়ের করা হলেও পরিবেশ অধিদফতরের উদাসীনতার কারণে ভূমিদস্যু বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে। ২০১১ সালের ১ জুলাই টাইগার পাস এলাকায় বাটালি হিলের প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর আগে ২০০৭ সালের ১২ জুন পাহাড়তলীতে জিইআর শপের দেয়াল ধসে লাগোয়া বস্তির ১২ জন মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
×