ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নিয়ামত হোসেন

প্রকাশিত: ০৪:৩৮, ৬ জুলাই ২০১৮

নিয়ামত হোসেন

প্রবীণ সাংবাদিক নিয়ামত হোসেন আজ আমাদের মাঝে নেই। মহাপ্রস্থানের ঘণ্টা বাজলেই সবাইকে চলে যেতে হয়। তাকেও যেতে হয়েছে। কর্মজীবনের শেষ ২৪ বছর কাটিয়েছেন দৈনিক জনকণ্ঠের বিশাল ভবনে। পেশাগত জীবনের ব্যস্ততম সময় শুরু হয়েছে তারও আগে। ১৯৪১ সালের ১৫ জানুয়ারি জন্ম নেয়া এই খ্যাতিমান সাংবাদিকের কর্মজীবনের সূচনা হয় মার্কিন সংস্থা ফ্রাঙ্কলিন বুক প্রোগ্রামসে। তবে সোভিয়েত ইউনিয়ন দূতাবাসে নিজেকে সম্পৃক্ত করা জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ কাল পর্ব। কারণ জনকণ্ঠ অফিসে সেই সময়ের স্মৃতিচারণ তাকে অতীতের এক সুবর্ণ অধ্যায়ে নিয়ে যেত। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে নাকি স্মরণ শক্তির দৌর্বল্য সব মানুষকেই স্মৃতি বিভ্রাটের পর্যায়ে নিয়ে যায়। নিয়ামত ভাইয়ের বেলায় ছিল তা একেবারেই ব্যতিক্রম। ফেলে আসা কর্মজীবনকে স্মরণ চেতনায় অম্লান করাই শুধু নয় তার চেয়েও বেশি রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের কবিতার লাইন হুবুহু বলে দেয়া। সত্তরোর্ধ ব্যক্তির স্মৃতিশক্তির এমন প্রখরতা সত্যিই বিমুগ্ধ হওয়ার মতোই। ১৯৬৪ থেকে ’৯১ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন দূতাবাসে তথ্য বিভাগের সম্পাদক-অনুবাদকের কাজ করেছেন নিরলস প্রেরণায়। ২৭ বছর কোন দিকে তাকানোর সময়ই হয়নি। সেই মধুর স্মৃতিচয়ন তাকে আনন্দে বিহ্বল যেমন করত একইভাবে সেই সময়ের সামাজিক পরিম-লের হরেক রকম উত্থান পতনের জ্বালাময়ী ইতিহাসও তাঁর স্মরণ চেতনায় গাঁথা হয়েছিল। সেই ঐতিহ্যিক ক্রমবিবর্তনের ধারা যেমন গণমানুষকে উদ্বেলিত করেছিল পাশাপাশি শাসন-শোষণের নিপীড়ন ও স্মৃতির মিনারে জ্বলজ্বল করে ভাসত। ১৯৬৬ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত স্বাধিকার আন্দোলনের একজন বিদগ্ধ দর্শক নিয়ামত ভাই নিজেকে সেই চেতনায় সমৃদ্ধও করেছেন। ১৯৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রাম যেমন সর্ববাঙালীর জীবনে এক মহিমান্বিত পর্ব সেই বোধ তাঁকেও তাড়িত করেছে জীবনব্যাপী। বিজয় নিশান ওড়ানো থেকে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনকে মনে করে উল্লসিত যেমন হতেন পাশাপাশি বিষণœতায় ভেঙ্গে পড়তেন ’৭৫-এর রক্তাক্ত অধ্যায়কে স্মরণে এনে। এক সময় কচিকাঁচা ছেলেমেয়েদের নিয়ে গড়ে ওঠা শিশু-কিশোর সংগঠন খেলাঘরের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেছেন। সেই গল্পও তাঁর মুখে কতবার যে শুনেছি ভাবলেও এখন কষ্ট হয়। লেখক, কলামিস্ট এবং কবি হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি সাংবাদিকতার জীবনের এক অনবদ্য অধ্যায়। ১৯৯৪ সালে যোগ দিয়ে দৈনিক জনকণ্ঠে তার শেষ কর্মজীবনের প্রায় ২৪ বছর কাটান। সহকারী সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ পাওয়া এই নিবেদিত সাংবাদিক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সিনিয়র সহকারী সম্পাদকের মর্যাদায় অভিষিক্ত ছিলেন। অবিভক্ত বাংলার চব্বিশ পরগনায় জন্ম নেয়া নিয়ামত ভাই তাঁর শৈশব-কৈশোরের স্মৃতি ও রোমান্থন করতেন। স্মৃতিবিজড়িত মুহূর্তগুলো তাকে পেছনের দিকেও টানতে দেখেছি। বর্তমান সমাজের অবক্ষয়, মৌলবাদের উত্থান, ধর্মীয় বিদ্বেষকে কখনও মানতে পারতেন না। মানুষ হিসেবে মানুষকে মূল্যায়ন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। রবীন্দ্র-নজরুল আর সুকান্তের মতো কালজয়ী কবি-সাহিত্যিকরা তাকে প্রতিনিয়তই উদ্দীপ্ত করতেন। অবলীলাক্রমে অকুণ্ঠ চিত্তে তাদের কবিতা কিভাবে যে বলতে পারতেন ভাবলে শ্রদ্ধায় অভিভূত হতে হয়। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে কত জ্ঞানী-গুণীর সাহচর্য পেয়েছেন সেটাও মানস চেতনায় উজ্জ্বল হয়ে আছে। বিশেষ করে খেলাঘরের প্রতিষ্ঠাতা সংগঠক রোকনুজ্জামান খান দাদা ভাইয়ের সম্পর্কে অনেক অজানা কথা তার মুখ থেকে শুনেছি। আর নিয়ামত ভাই নিজেই তো ছিলেন খেলাঘরের অন্যতম বিশিষ্ট সংগঠক যাকে কোন পদমর্যাদায় আসীন না করেও সংগঠনের শীর্ষে স্থান দেয়া যায়। যদিও তিনি খেলাঘরের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বহুদিন। কবি হিসেবে নিজস্ব মৌলিক রচনা তো ছিলই আবার অগ্রজ বিখ্যাত কবিদের কবিতার প্যারোডি লিখতেও পছন্দ করতেন। লিখেছেনও। এ সম্পর্কে নিয়ামত ভাইয়ের নিজের কিছু বক্তব্য ছিল। তিনি মনে করতেন কবিরা সৃজন-চেতনায় আবিষ্ট হয়ে যা সৃষ্টি করেন তাকে যদি অন্য কেউ আলাদাভাবে উপস্থাপন করে সমকালীন সমাজ এবং চেতনাকে ভিন্ন আঙ্গিকে তুলে ধরে নতুন করে পাঠককে নব আনন্দে ভরিয়ে তুলতে পারে। সাহিত্যের বিস্তৃত আঙ্গিনায় এর দামও কোন অংশে কম নয়। ২০১৬ সাল থেকে নিয়ামত ভাইকে একেবারে কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে বিস্তৃত এবং সমৃদ্ধ কর্মজগত মানুষকে শুধু জ্ঞান-বিজ্ঞানেই আধুনিক করে না বরং চেতনার উৎকর্ষতাকেও অনেকখানি এগিয়ে দেয়। ফলে ক্রমবর্ধমান তথ্যপ্রযুক্তিতে অতখানি অগ্রগামী না হয়েও নতুন সময়কে ধরার উপযোগী মনন ক্ষেত্র কতখানি বিকশিত আর উন্মুক্ত ছিল তা সত্যিই অবাক হওয়ার ব্যাপার। চাকরি জীবনের শেষ সময়টুকু কেটেছে একান্ত সুহৃদ সহকর্মীদের সান্নিধ্যে। একমাত্র ছেলে বিদেশে অবস্থানরত। স্ত্রীকেও হারিয়েছেন প্রায় বছর কয়েক আগে। একেবারে নিঃসঙ্গ জীবন বলতে যা বোঝায়। প্রতিদিনই অফিসে আসতেন। ছুটি কাটানোর তাগিদ ছিল না। শরীরটাও যে কখনও খারাপ থাকত তা কিন্তু নয়। চোখে দেখতেন কম। পড়তে কষ্ট হতো। সম্পাদকীয় সম্পাদনা করতে অন্যের সাহায্য নিতেন। ব্রিফ করতেন খুব ভাল। সম্পাদকীয়ের জন্য শিরোনাম নির্ধারণ করতেন ঠা-া মাথায়, ভেবে চিন্তে। শরীরটা বিকল হতে লাগল জুন মাসে। মাঝে মধ্যে অফিসে আসতেন কখনও বা আসতে পারতেন না। একজন বয়োবৃদ্ধ অভিজ্ঞ সাংবাদিক নিয়ামত ভাই কর্মজীবনের ক্রান্তিলগ্নে যতখানি পেরেছেন জনকণ্ঠকে সময় এবং শ্রম দিতে কার্পণ্য করেননি। আমরা সহকর্মীরা তার এই চলে যাওয়াকে মেনে নিতে কষ্ট হলেও মানতে হয়েছে। ভাবতে পারি না যে মানুষটা সব সময় আমাদের সঙ্গে ছিলেন তার বসার জায়গাটা একেবারে শূন্য। সেখানে তিনি আর কখনও এসে বসবেন না। বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কত পরামর্শ, প্রয়োজনীয় বিষয়ে তার মতামত নিতে হয়েছে বরাবরই। তিনি আমাদের সব সময়ই সহযোগিতা করছেন আমরাও তাকে তার মর্যাদা দিতে কার্পণ্য করিনি। যেখানে গেছেন সেই স্থানে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তাকে ভাল রাখুক। তাঁর আত্মা অশেষ শান্তি লাভ করুক। জীবন প্রদীপ নিভে যাওয়া একজন পারলৌকিক মানুষ যখন জগতের সমস্ত দায় চুকিয়ে অন্য কোন স্থানে তার জন্য শুধু সম্মান, শ্রদ্ধা আর মমতা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না।
×