ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রতিযোগিতা কমিশন ॥ ‘প্রতিযোগিতা আইন ভঙ্গ করা দণ্ডনীয় অপরাধ’

প্রকাশিত: ০৪:৩৩, ৬ জুলাই ২০১৮

প্রতিযোগিতা কমিশন ॥ ‘প্রতিযোগিতা আইন ভঙ্গ করা দণ্ডনীয় অপরাধ’

সম্প্রতি আমার এক লেখায় ‘বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের’ কথা উল্লেখ করি। তা পাঠ করে আমার এই কলামের একজন পাঠক প্রশ্ন করেছে- এই সংগঠনটির কাজ কী? আমি তাকে বললাম, খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখতে। তা বলা সত্ত্বেও ভদ্রলোককে প্রতিযোগিতা কমিশনের সংক্ষিপ্ত একটি পরিচয় দিলাম। এর পরের প্রশ্ন, এটি কবে হয়েছে? এরপরের প্রশ্ন, কৈ এর তো কোন কাজ দেখি না... ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব প্রশ্নের জবাবে বার বার তাকে বলেছি খবরের কাগজের বিজ্ঞাপন দেখতে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে এই সংগঠনটি কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানান দিচ্ছে যে, তারা আছে। কথিত উদ্দেশ্য মোতাবেক তারা আছে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিযোগিতার পরিবেশ উৎসাহিত করতে। শুধু উৎসাহিত নয়, তা নিশ্চিত এবং বজায় রাখতেও তারা কাজ করে। প্রতিযোগিতা কমিশন চায় ব্যবসা-বাণিজ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতা হোক। তারা প্রতিযোগিতা বিরোধ কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করে বলে জানানো হচ্ছে। বিজ্ঞাপনের ভাষা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ‘বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন’ ব্যবসা-বাণিজ্যে ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশের বিরুদ্ধে। তারা ‘মনোপলি’ ওলিগপলি অবস্থা, জোটবদ্ধতা অথবা কর্তৃত্বময় অবস্থানের অপব্যবহারের বিরুদ্ধে। বিরুদ্ধে মানে এসব কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ করে। সবশেষে হলো আসল কথা। বিজ্ঞাপনে সতর্ক করে বলা হচ্ছে, প্রতিযোগিতা আইন ভঙ্গ করা দ-নীয় অপরাধ। অতএব সবাইকে তারা বলছে প্রতিযোগিতা আইন মেনে চলতে। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের বিজ্ঞাপন দেখে যে কোন পাঠকের দারুণভাবে আশ্বস্ত হওয়ার কথা। শত হোক দেশে একটি প্রতিষ্ঠান সরকার করেছে যার কাজ হচ্ছে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দেয়া। আমরা বাজার অর্থনীতির (মার্কেট ইকোনমি) দেশ। যেভাবেই হোক এই অর্থনীতিকেই আমরা বেছে নিয়েছি। এর ভিত্তি হচ্ছে প্রতিযোগিতা, মেধা, কর্মক্ষমতা ও গুণ। মার্কেট ইকোনমি এসব গুণের ওপর দাঁড়িয়ে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে এসব কথার কথা। আমাদের বাজার অর্থনীতি হয়ে যাচ্ছে যাচ্ছেতাই করার অধিকার। ক্রেতা সাধারণ, ভোক্তা সাধারণ এবং সাধারণ মানুষের কোন অধিকারই থাকছে না। কাঁচাবাজার, পাইকারি বাজার, শেয়ার বাজার, আমানতের বাজার, ব্যাংক বাজার, ভোগ্যপণ্যের বাজার থেকে বিমানের টিকেটের বাজার পর্যন্ত কোথাও ক্রেতাদের কোন স্বস্তি নেই। এই তো কয়েকদিন হলো পবিত্র ঈদের ছুটি শেষ হয়েছে। এই উপলক্ষে ট্রেন, বাস, লঞ্চ, বিমানের টিকিটের কী অবস্থা ছিল তা সকলেই জানেন। দেড়গুণ, দ্বিগুণ, তিনগুণ দামে মানুষকে টিকেট কাটতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রশ্ন এই যে বাস মালিক, লঞ্চ মালিক, বিমান মালিকরা যথেচ্ছ ব্যবহারটা করলেন তা কী প্রতিযোগিতার পরিবেশের মধ্যে পড়ে। দল বেঁধে তারা দাম বাড়ালেন সবকিছুর। কাঁচাবাজারে ঈদের আগে যে কাণ্ড প্রতিবছর ঘটে তার থেকে রেহাই পাওয়ার পথ কী? কয়েকদিন পরপরই খবরের কাগজে প্রতিবেদন ছাপা হয় ভোগ্যপণ্যের বাজারের অবস্থা কী? চাল, ডাল, নুন, তেল, সয়াবিন, পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ছোলা, চিনি ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার ধরতে গেলে সারা বছরই টালমাটাল থাকে। এই চিনির দাম বাড়তির দিকে, তো চালের দাম। এই পেঁয়াজের দাম বাড়তির দিকে তো ডালের দাম। এসব করে কিছু সংখ্যক ব্যবসায়ী কোটি কোটি টাকা কামাই করে নিচ্ছেন। শোনা যায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আমদানি ব্যবসা, বিতরণ ব্যবসা, পাইকারি ব্যবসা দিনে দিনে গুটিকয়েক ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের হাতে সীমিত হচ্ছে। চট্টগ্রামের কয়েকটি ‘বিজনেস হাউসই’ তা নিয়ন্ত্রণ করে। চিনির ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করে কয়েকটি হাউস। এসব কথা মুদি দোকানিরা আমাদের জানায় আর আমরা শুনি। প্রশ্ন এসব কর্মকা- প্রতিযোগিতাবিরোধী কর্মকা- কী-না। কিছু সংখ্যক হাউস দলবেঁধে পেঁয়াজের দাম বাড়ায়, সয়াবিনের দাম বাড়ায়, চালের দাম বাড়ায়। এসব খবর প্রায় প্রতিদিন দৈনিক কাগজে ছাপা হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের দায়িত্বের মধ্যে কী এসব পড়ে? আমি জানি না। দৃশ্যত এসব কর্মকা- প্রতিযোগিতাবিরোধী কর্মকা-। স্পষ্টতই এগুলো জোটবদ্ধতা, মনোপলি, অলিগপলির মধ্যে পড়ে। যদি পড়ে তাহলে এই অবস্থা অবসানের জন্য কমিশন কেন আইনী ব্যবস্থা নেবে না? সুদের হার নিয়ে ব্যাংকিং খাতে যেসব ঘটনা ঘটছে তা কী প্রতিযোগিতাবিরোধী কর্মকা- নয়। সবশেষ ঘটনার কথা বলি। গবর্নর সাহেব সভা করলেন বেসরকারী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে। তারপর করলেন সরকারী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সঙ্গে। নির্দেশ হচ্ছে সরকারী ব্যাংকগুলোকে তাদের টাকা আমানত হিসেবে রাখতে হবে বেসরকারী ব্যাংকে। এটা হচ্ছে আন্তঃব্যাংক আমানত। অর্থাৎ ইন্টার ব্যাংক ডিপোজিট। সুদের হার কত? ৬ শতাংশ। সব সরকারী ব্যাংক বেসরকারী ব্যাংককে একইহারে আমানত দেবে। তবেই তারা ৯ শতাংশ হারে ঋণ দেবে ব্যবসায়ীদেরকে। কমিশনকে প্রশ্ন, এসব কী প্রতিযোগিতা বিরোধী কর্মকা- নয়? ব্যাংকগুলো চলবে যার যার শক্তি মোতাবেক। ছোট-বড় ব্যাংক আছে। তাদের দক্ষতা ভিন্ন ভিন্ন। হতেই পারে কেউ আমানতের ওপর সুদ দেবে ৬ শতাংশ, কেউ ৭ শতাংশ, কেউ সাড়ে ছয় শতাংশ। আবার ঋণের ক্ষেত্রে হতে পারে কেউ ঋণ দেবে ৯ শতাংশ হারে, কেউ দেবে সাড়ে নয় শতাংশ হারে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ছোট-বড় নির্বিশেষে সবার জন্য একই রেট। এসব সিদ্ধান্ত করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে ব্যাংক দীর্ঘ ৩০-৩৫ বছর চেষ্টা করে ব্যাংকিং খাতে একটি প্রতিযোগিতার পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। এখন তারাই ‘প্রতিযোগিতা’ নষ্ট করছে। আরও মজার বিষয় একটা। সরকারী ব্যাংক, ‘তিনমাসী’ আমানত দেবে ৬ শতাংশ হারে। আবার ঐ হারেই সেই আমানত রাখবে বেসরকারী ব্যাংকে। এর অর্থ কী? সরকারী ব্যাংকের প্রশাসনিক খরচের কী হবে? ঐ টাকা কে দেবে? আরও কথা আছে। এক সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘আন্তঃব্যাংক’ আমানতকে নিরুৎসাহিত করত। নিরুৎসাহিত করত ‘কলমানি বাজারের’ ঋণ। কারণ এসব মাধ্যমে আমানত/ঋণ নেয়ার অর্থই হচ্ছে দুর্বলতা। যে ব্যাংক এই কর্মকা-ে জড়িত হয় ধরে নেয়া হয় তার ‘কাজ-কামে’ কোন গ-গোল আছে। এখন দেখা যাচ্ছে যে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকই তা উৎসাহিত করছে। বর্তমান গবর্নর সাহেব কী এসব বুঝেশুনে করছেন? সবচেয়ে বড় কথা, এসব কাজ কী প্রতিযোগিতার পরিবেশকে বিঘিœত করছে না? লেন্ডিং রেটই কমাতে হবেÑ এটা সবারই দাবি। এটা করার অনেক বিকল্পপথ আছে। সেসব পথ ব্যবহার না করে প্রতিযোগিতাবিরোধী কর্মকা-ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং সকল ব্যাংক জড়াচ্ছে কেন? তাও আমানতকারীদের ঠকিয়ে। ‘বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন’ যেহেতু সমানে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানান দিচ্ছে যে, তারা মাঠে আছে এবং যেহেতু তারা বলছে প্রতিযোগিতাবিরোধী কর্মকা- শাস্তিযোগ্য অপরাধ তাই উপরের বিষয়গুলো তাদের বিবেচনার জন্য তুলে ধরলাম। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, বাজার অর্থনীতির জন্য সুস্থ প্রতিযোগিতা দরকার। প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট হলে অকর্মণ্য, অপদার্থ প্রতিষ্ঠান-লোকজন অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। আর তা হলে পরিণামে- বাজার অর্থনীতিই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমতাবস্থায় ‘বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনকে’ বলব তাদের কার্যক্রম শুরু করতে। অন্তত আমরা ভোক্তারা যাতে বুঝতে পারি যে, তারা কাজ করছে। আর কিছুটা স্বস্তিও পেতে পারে দেশের মানুষ। আর এটা দরকার। কারণ, দেখা যাচ্ছে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ী সমস্ত ‘গ্রাউন্ড রুলস’ উপেক্ষা করে যাচ্ছেতাই করতে চাইছে। এটা দেশের জন্য শুভ হবে না। সরকারকেও বলব, প্রতিযোগিতার পরিবেশ রক্ষা করতে যাতে একচেটিয়া কারবারিদের হাত থেকে মানুষ রক্ষা পায়। মনে পড়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধপূর্ববর্তী ঘটনাগুলোর কথা। একচেটিয়া কারবারের বিরুদ্ধে আমরা ২৪ বছর সংগ্রাম করেছি, ২২ পরিবারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। আবার ঐ অবস্থায় যাতে না পড়তে হয় সেটা দেখার এখনই সময়। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×