ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্রের ‘চম্পাবতী’

দুই সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতুতে এক বেদের মেয়ে

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ৫ জুলাই ২০১৮

দুই সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতুতে এক বেদের মেয়ে

অংশুমান ভৌমিক ॥ একই শহরের মধ্যে যে অনেক শহর থাকে, হেঁটে চলতে না শিখলে যে তার নাগাল পাওয়া যায় না একথা একজন বিশিষ্ট কবি লিখেছিলেন। শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্রের নতুন প্রযোজনা চম্পাবতী নিয়ে লিখতে বসে এই আপ্তবাক্য মাথায় ঘুরছে। কলকাতার লাগোয়া সল্টলেকে পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্রের পূর্বশ্রী প্রেক্ষাগৃহে নাটকটি মঞ্চস্থ হয়েছে ২৬ জুন। জলকাদা ঠেলে যারা প্রাচ্যের ‘পুবের নাট্যগাথা’ উৎসবের পঞ্চম সন্ধেয় হাজিরা দিয়েছিলেন হাতেগোনা কয়েকজন বাদ দিলে তাদের বেশির ভাগই ‘চম্পাবতী’ নিয়ে উচ্চবাচ্য করেননি। অথচ মাস চারেক আগে ঢাকায় এক অপূর্ব সমাবেশে জমায়েত হয়ে দেখেছি অগণিত দর্শক চেটেপুটে এ নাটকের রস নিচ্ছেন। দুই জমায়েতের রকমফের আছে। ঢাকায় তখন একুশের বইমেলা চলছে। সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের একপাশে কতক এরিনা থিয়েটারের ধাঁচে যে মুক্তমঞ্চ আছে সেখানে বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের উদ্যোগে চতুর্থ একুশে নাট্যোৎসব হচ্ছিল। ২২ ফেব্রুয়ারি সন্ধেবেলা যারা ‘চম্পাবতী’ দেখতে এসেছিলেন তাদের সঙ্গে সেগুনবাগিচা চত্বর বা মহিলা সমিতির তথাকথিত নাট্যমোদীদের আসমান-জমিন তফাত। নজর দিলে মালুম হচ্ছিল, একটু খবর করলে হলফ করে জানা যেত যে এই দর্শকদের বারো আনাই রাজধানী ঢাকার আনাচেকানাচে দিন আনেন দিন খান। বুকের পাঁজরে চোরা মফস্বল গুঁজে রেখে, ছেড়ে আসা গ্রামের ফিকে হয়ে আসা ছবি মনের মধ্যে পুষে রেখে নাগরিক বিনোদনের চোরাবালিতে ডুবে যান। লোকসংস্কৃতি আর নাগরিক সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতুর কিনারায় দিন গুজরান করা এই দর্শকের কাছে ‘চম্পাবতী’র মতো প্রযোজনার আবেদন অমোঘ। এই আবেদনের একদিকে আছে বিষয়, অন্যদিকে আঙ্গিক। লোকশ্রুতিতে ভর করে বেদের মেয়ে লিখেছিলেন জসীমউদ্দীন। কল্লোল যুগের ফসল হলেও অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের বেদে আর জসীমউদ্দীনের বেদের মেয়ের মধ্যে তফাত ছিল অনেক। বাইদানি চম্পাবতীকে মাঝখানে রেখে কৌমজীবনের যে ছবি লিখেছিলেন জসীমউদ্দীন তাতে নিম্নবর্গীয় জীবন-যাপনের আঁকাড়া চেহারা ফুটেছিল। এ জীবন পুরুষের দাপে নতজানু। নারীর তাপে শিহরিত। এ যাপনের গহীনে বয়ে চলে শ্রেণী বৈষম্যের আদিম ইতিহাস। অর্থ সচ্ছলতা কীর্তির মূলে থাকে কৌমক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ। বছর দশেক আগে এই গল্পকেই কাব্যনাট্যের চালে লিখেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। নাম দিয়েছিলেন ‘চম্পাবতী’। খোরশেদুল আলমের নির্দেশনায় শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্র এ নাটকের প্রথম মঞ্চায়ন করেছিল গেল বছর ২২ সেপ্টেম্বর, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপিরিমেন্টাল থিয়েটার হলে। খোরশেদুলের আগের যে নাটক অনেকে দেখেছেন সেই ‘বীরাঙ্গনার বয়ান’-এ আটপৌরে নাট্য আঙ্গিকের তালাশ ছিল। ‘চম্পাবতী’তে যাত্রার আদলকে কাছে টেনেছেন তিনি। পাশে পেয়েছেন শিশির রহমানকে, পল্লীর সুরকে আত্মস্থ করে নয়া আন্দাজে পরিবেশন করা যার কাছে জলভাত। দোয়েলের মতো কেয়াবাত গায়িকা উইংসের ধারে থাকায় হক সাহেবের বাণী পেখম মেলেছে। ঠান্ডু রায়হানের আলোর কেরামতি মুক্তমঞ্চে ফোটেনি। তবে আইরিন পারভিন লোপার পোশাক পরিকল্পনায় সাদামাটা ছাপা শাড়ির সঙ্গে মিশেছে ঘটিহাতা ব্লাউজ, বাইদানির বিনুনি করা হিলহিলে চুলের ঢল নেমেছে কোমর ছাপিয়ে। তন্ময়ের রূপসজ্জায় ফুটে উঠেছে বাংলার স্নেক কাল্টের রকমারি চিহ্নক। পপুলার কালচারে বিশেষ করে বেদের মেয়ে জোস্না গতের সিনেমায় সাপুড়ে সংস্কৃতির যে ছবি প্রতিষ্ঠা পেয়েছে বুদ্ধিমান খোরশেদুল তাকেই অবলম্বন করেছিলেন। বাইদানির ঠোঁট রাঙানো হয়েছিল টকটকে লালে। মোড়ল বউয়ের পানের বাটায় লেগেছিল ব্র্যান্ডেড বাসনকোসনের লালসাদা স্টিকার। কথায় আছে সাপের হাঁচি বেদের চেনে। এ নাটকে বেদের বাঁশি চেনে গৈগেরামের লোক। গোড়ায় চম্পাবতীকে (মাহিন) দেখে গ্রামের ছেলেমেয়েরা যখন গেয়ে ওঠে ‘বাইদানি গো বাইদানি / আমাগো বাড়ি যাইবানি’ তখন ওই ডাকের পারে লেগে থাকে খরিদদারির চোরা মতলব। গ্রামের মোড়ল (আলী নূর) যে বাইদানিকে দেখার জন্য ফুঁসে ওঠে, গায়ে ইরান দেশের আতর মাখে, তার মূলে থাকে সম্ভোগ প্রবৃত্তি। গায়ের জোরে গয়া বাইদাকে (মোস্তাক) কাত করে চম্পাবতীকে দখল করার পর মোড়ল বলে ‘চম্পাবতী দেহে তোমার রূপ ঝইরা পড়ে/তোমায় দেইখা খাজুর গাছেও রস টসটস করে’। চকচক করে ওঠে দর্শকের চোখ। সেজেগুজে মোড়লের মন ভোলাতে মোড়ল বউ (হৃদি) তৎপর হলে হাসির হররা ওঠে সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানে। মোড়ল বউ আর বাইদানির চোরাগোপ্তা আঁতাত হলে যৌন রাজনীতি তুঙ্গে ওঠে। তার মজা টের পায় সকলে। বৈষ্ণবীর (নাছরিন) গান বাইদানির ঘরে-বাইরের সঙ্কটকে নজরটান দেয়। হিন্দু-মুসলমানের তফাত রাখে না সহজিয়া মানবধর্ম। বাইদানির বিরহের ভেতর সীতা-শকুন্তলার হাহাকারকে গেঁথে দেন হক সাহেব। মোক্ষম সময়ে টেনে আনেন মনসামঙ্গলের অনুষঙ্গ। শেষাশেষি বাইদানির সঙ্গে বেহুলার প্রায় অভেদ রচনা হয়ে যায়। বাংলার সমন্বয়ী চেতনাকে সিধেসাধা মেজাজে উদ্যাপন করে চম্পাবতী। এমনিতে সূক্ষ্ম অনুভূতির বড় জায়গা নেই এ নাটকে। কুশীলবদের অভিব্যক্তি যত চড়া হয় তত হইহই করে ওঠে মুক্তমঞ্চের দর্শক। চম্পাবতীর সঙ্গে মোড়লের লড়াই উচ্ছ্বাসের বাঁধ ভেঙ্গে দেয়। সিঁড়ির ধাপিতে নয় মেঝেতে বসে থাকা ছেলেছোকরার দল চলে যায় আরও সামনে, একেবারে অভিনয়বেদীর ধারে। কেউ এমন হুলুস্থুল করে যে উর্দিধারীদের ছুটে আসতে হয়। চড়থাপ্পড় কষাতে হয়। এসবকে ধর্তব্যে না রেখে নাট্যানুষ্ঠান চালিয়ে যাবার জন্য যে পেশাদারিত্ব লাগে, যে চড়া সুর আগাগোড়া ধরে রাখতে হয়, তার ঘাটতি হয়নি সেদিন। আশপাশে মাইক্রোফোনের দাপট না থাকলে ওই এরিনা স্টেজের ন্যাচারাল এ্যাকাউস্টিকসকে তারা কাজে লাগাতে পারতেন কিনা জানি না। ঝুলন্ত মাউথপিসের কাছে এসে বলতে না পারলে অনেক কথা মাটি হচ্ছিল। পুষিয়ে দেয়া যাচ্ছিল শরীরী ভাষা দিয়ে। নায়িকা মাহিন তো কামাল করছিলেন। তাই কতক ন্যায্যভাবেই ৭০ মিনিটের নাটকের শেষে করতালির বন্যায় ভেসে গেছিলেন শব্দ নাট্যচর্চা কেন্দ্রের নাটুয়ার দল। বলতেই হয় যে সৈয়দ শামসুল হকের অন্যান্য নাটকের সাপেক্ষে ‘চম্পাবতী’র অবস্থান অন্য গ্রহাণুপুঞ্জে। তবে আঁকাড়া কৌমজীবনকে সহজ কাব্যভাষায় তুলে আনতে তার ওস্তাদি এখানেও বজায় ছিল। তাকে জনগণ মনের কাছে পৌঁছে দিতে যে বাজি লড়েছেন খোরশেদুল আলম, তাতে একদিকে যেমন জিত আছে, অন্যদিকে আছে হার। যেমন একদিকে থাকে গ্রাম, অন্যদিকে শহর। একদিকে থাকে প্রসেনিয়াম, অন্যদিকে উঠোন। একদিকে মাথা তোলে মধ্যবিত্তের উত্থানপর্ব, অন্যদিকে গুমরে মরে জাতীয় নাট্য আঙ্গিক। মাঝখানে সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতুর মতো দোল খায় ‘চম্পাবতী’ ।
×