ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

প্রত্যেক ডিভোর্সে বাচ্চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের সবার অনুভূতি এক

প্রকাশিত: ০৫:১০, ৫ জুলাই ২০১৮

 প্রত্যেক ডিভোর্সে বাচ্চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাদের সবার অনুভূতি এক

স্টাফ রিপোর্টার ॥ প্রত্যেক ডিভোর্সে বাচ্চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের সবার অনুভূতি একই রকম। আপনারা হলেন উচ্চ শিক্ষিত, আপনারাই হতে পারেন সমাজের উদাহরণ। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন মানুষের কাছে কী বার্তা গেছে? আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। মা-বাবার মধ্যে বিচ্ছেদ হওয়া পরিবারের সন্তানরা মিলন চায়, তারা কখনও বিচ্ছেদ কামনা করে না। এমনি দুই সন্তান ধ্রুব এবং লুব্ধকও তার মা-বাবার মিলন চায়। তারা হলো সমাজের সবচেয়ে বড় উদাহরণ। তালাকের পর দুই সন্তানকে নিজ হেফাজতে নেয়ার নির্দেশনা চেয়ে করা এক মায়ের আবেদনের রুল শুনানিতে বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি মোঃ খায়রুল আলমের হাইকোর্ট বেঞ্চ এমন মন্তব্য করেন। একইসঙ্গে তালাক হয়ে যাওয়ার পরও দুই শিশু সাদমান ধ্রুব (১২) ও সাদমান লুব্ধক (৯)-এর কথা বিবেচনা করে বাবা মেহেদী হাসান ও মা কামরুন্নাহার মল্লিকা আবার এক হতে চান কি না এবং এ ব্যাপারে কী কী অগ্রগতি হয়েছে সে বিষয়ে জানাতে ১ আগস্ট পর্যন্ত সময় দিয়েছেন আদালত। আদালতে শিশুদের মা কামরুন্নাহার মল্লিকার পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল। তার সঙ্গে ছিলেন একেএম রিয়াদ সলিমুল্লাহ। অন্যদিকে বাবা মেহেদী হাসানের পক্ষে শুনানি করেন ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল। আদালতের আদেশের পর আইনজীবী ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজ (বুধবার) আদালতে শিশু দুটিসহ বাবা-মা উপস্থিত ছিলেন। আদালত আমাদের কাছ থেকে শুনে দুজনের পারিবারিক ও দাম্পত্য জীবন পুনরুদ্ধারের জন্য আবারও সময় দিয়েছেন। এ বিষয়ে আগামী ১ আগস্ট পরবর্তী তারিখ রেখেছেন।’ ডিভোর্স হওয়ার পরে আবার নতুন করে দাম্পত্য জীবন ফিরে পেতে আইনের কোন বাধা আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে কাজল বলেন, ‘এখানে আইনগত কোন বাধা নেই। আইনী কোন বাধা থাকলে তো আমরা এ বিষয়টি নিয়ে আদালতে যেতাম না। এখানের দুজনের পারস্পরিক সদিচ্ছা, সম্মতি ও তাদের উপলব্ধি হলেই কলহ মিটে যাবে। তাদের পরস্পরের মধ্যে সমঝোতা হলেই হবে।’ আইনজীবী তাপস কান্তি বল বলেন, ‘বাবা ও মা নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান দূরত্ব পূরণ করে তাদের সন্তানের জন্য কতটা এগিয়ে আসতে পারবেন সেটাই এখন আদালত দেখবে। এটা দেখে আদালত পরবর্তী আদেশ দেবে। আদালত আজ (বুধবার) বলেছে, এ সময়ের মধ্যে বাবা অবশ্যই মায়ের বাড়িতে গিয়ে সন্তানদের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। সন্তানদের নিয়ে যেখানে ইচ্ছা ঘুরতে পারবেন।’ আদালত থেকে বেরিয়ে সন্তানের বাবা মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি। আশা করছি আগের অবস্থায় ফিরতে পারব।’ মা কামরুন্নাহার মল্লিকা বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি। আশা করছি পারব। সন্তানদের জন্য হলেও সম্পর্ক উন্নয়ন করতে হবে।’ ২০০২ সালে রাজশাহীর মেয়ে কামরুন্নাহার মল্লিকা এবং মাগুরার ছেলে মেহেদী হাসান বিয়ে করেন। ওই দম্পতির দুই ছেলে রয়েছে। বড় ছেলে সালিম সাদমান ধ্রুবর বয়স ১২ বছর ও ছোট ছেলে সাদিক সাদমান লুব্ধকের বয়স ৯ বছর। দাম্পত্য কলহের জেরে ২০১৭ সালের ১২ মে তাদের মধ্যে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর থেকে শিশু দুটি বাবার তত্ত্বাবধানে তার ফুফুর কাছে থেকে লেখাপড়া করছে। ধ্রুব চতুর্থ শ্রেণীতে ও লুব্ধক দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ে। মল্লিকা পেশায় স্কুল শিক্ষিকা আর মেহেদী বেসরকারী ব্যাংকের কর্মকর্তা। তারা দুই সন্তানের বাবা-মা। তবে একপর্যায়ে এসে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। গত বছরের মে মাসে নোটিসের মাধ্যমে বিয়ে বিচ্ছেদের প্রক্রিয়া শুরু করেন তারা। তবে এর কিছুদিন আগে দুই সন্তানকে মাগুরায় গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দেন মেহেদী। বড় ছেলের বয়স এখন ১২ আর ছোট ছেলের ৯ বছর। বোনের তত্ত্বাবধানে মাগুরা জেলা শহরের একটি স্কুলে সন্তানদের ভর্তি করিয়ে দেন মেহেদী। এর মধ্যে দুই সন্তানের দেখা পাননি মা মল্লিকা। শেষ পর্যন্ত সন্তানদের নিজ হেফাজতে নেয়ার জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন মল্লিকা। এ আবেদনের পর গত ২৯ মে শিশু দুটিকে হাইকোর্টে হাজির করতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ ও বাবা মেহেদীকে নির্দেশ দেন। ২৫ জুন তাদের হাজির করতে বলা হয়। ২৫ জুন হাজির হলে দীর্ঘদিন পর মুখোমুখি হওয়ায় সন্তান ও মায়ের কান্নায় এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিচারপতি, আইনজীবী ও উপস্থিত সাংবাদিকদেরও চোখে জল নেমে আসে। একপর্যায়ে আদালতের জিজ্ঞাসার জবাবে বড় ছেলে বললেন-‘আমরা আর কিছু চাই না। বাবা-মাকে একত্রে দেখতে চাই।’ বড় ছেলের এমন বক্তব্যের পর বাবা-মাকে নিয়ে খাস কামরায় কথা বলেন আদালত। পরে আদেশে আদালত বলেন, আপাতত শিশু সন্তান দুটি মায়ের হেফাজতে থাকবে। তবে এই সময়ে পিতা শিশু দুটির দেখাশোনা করার অবারিত সুযোগ পাবেন। পরে আদালত ৪ জুলাই পরবর্তী দিন ঠিক করে শিশু দুটিকে হাজির করার নির্দেশ দিয়ে বিষয়টি মুলতবি করেন। বুধবার শুনানিকালে হাইকোর্টের সিনিয়র বিচারপতি জে বি এম হাসান ওই দম্পতির উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা উচ্চ শিক্ষিত। আপনারা সব কিছু বোঝেন। সন্তানদের জন্য হলেও আপনাদের ফিরে আসা উচিত। আপনারা হবেন সমাজের উদাহরণ।’ শুনানির শুরুতে হাইকোর্ট জানতে চায় পরিস্থিতির কোন উন্নতি হয়েছে কি না? জবাবে মেহেদী হাসানের আইনজীবী তাপস কান্তি বল আদালতকে বলেন, ‘হ্যাঁ কিছুটা উন্নতি হয়েছে। মা ছুটি নিয়ে বাচ্চাদের সঙ্গে ঘুরেছেন। বাবাও বাচ্চাদের সময় দিয়েছেন। কিন্তু এর মধ্যে একটি সমস্যাও দেখা দিয়েছে। ছোট বাচ্চাটি তার বাবাকে একদিন রাতে থেকে যাওয়ার আবদার জানালে বাবা রাজি হন। কিন্তু মা রাজি হননি। রাত একটায় বৃষ্টির মধ্যে বাবাকে বের হয়ে যেতে হয়েছে।’ পারিবারিক সমস্যার কারণে ব্যাংকে অভিযোগ দেয়ায় ২০১৬ সালে ডিসেম্বরে বাবা মেহেদী হাসানের চাকরি চলে যায়। পারিবারিক এই বিষয়টি স্মরণ করে দিয়ে এ সময় আদালত বলে, ‘এই ঘটনা মিডিয়ায় কিভাবে গিয়েছে দেখেছেন? জনগণ সেটাকে কিভাবে দেখছেন? এটা একটি স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সময় ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল বলেন, বাবা সারেন্ডার (আত্মসমর্পণ) করেছেন, বাচ্চারা যেভাবে চাইবেন বাবা তাই করবেন।’ বিচারপতি বলেন, ‘এটাকে কি পরিস্থিতির উন্নতি মনে করেন?’ ব্যারিস্টার তাপস বলেন, ‘কিছু তো উন্নতি হয়েছে।’ এ সময় মা কামরুন্নাহার মল্লিকার পক্ষের আইনজীবী রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘এটা পুরোপুরি পারিবারিক ইস্যু। দুইজনের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নে আরও কিছু সময় লাগবে।’ বিচারপতি জে বি এম হাসান বলেন, ‘ঠিক। এটা তো রাতারাতি উন্নতি হবে না।’ ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল বলেন, ‘বাচ্চা দুটি এরই মধ্যে ঢাকার স্কুলে ভর্তি হয়েছে। বাচ্চারা খুশি যে, প্রতিদিন মা স্কুলে তাদের আনা নেয়া করছেন।’ হাইকোর্টের বিচারপতি বলেন, ‘ঠিক আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বাচ্চাদের অভিপ্রায় উপেক্ষা করে স্কুলে ভর্তি করলে হবে না।’ এ সময় আইনজীবী কাজল বলেন, ‘এই ঘটনা গণমাধ্যমে আসার পর যেখানে গিয়েছি সেখানে সকলেই বলেছে তোমরা পুণ্যের কাজ করেছ। এ ঘটনায় আদালতের প্রতি মানুষের উচ্চাকাক্সক্ষা বেড়ে গেছে। কোর্ট সমঝোতার জন্য সময় দিয়েছেন। এটা সর্বমহলে বার্তা দিয়েছে। শিশুদের কল্যাণ বিবেচনায় পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে হবে। তবে উভয়পক্ষকে মনে রাখতে হবে, আদালতের নমনীয়তায় যদি তারা অন্যকিছু ভেবে থাকেন তাহলে সেটা ঠিক হবে না। মনে রাখতে হবে আদালতের হাত খাটো না। বাচ্চাদের মঙ্গল চিন্তা করে আদালত যে কোন আদেশ দিতে পারেন।’ তখন বিচারপতি বলেন, ‘শুধু এ বিষয় না, প্রত্যেক ডিভোর্সে বাচ্চারা ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তাদের সবার অনুভূতি একইরকম। হয়ত এ দুটি বাচ্চা আজকে আমাদের সঙ্গে অনুভূতি প্রকাশ করার সুযোগ পেয়েছে। সারাদেশের ডিভোর্সি দম্পতির সব বাচ্চারই অনুভূতি এক, তবে তারা সেটা বলতে পারে না। এই বাবা-মা শুনলেও অন্য বাচ্চাদের বাবা-মা এসব অনুভূতি কানে নেন না।’ এরপর বিচারপতি শিশু ও বাবা-মা দুজনের কথা শোনেন। বিচারপতি শিশুদের উদ্দেশে করে বলেন, তোমরা কে কোন দল সমর্থন কর। জবাবে বড় শিশু বলে, ব্রাজিল। ছোটটি বলে- আমি আর্জেন্টিনা। বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে আদালত বলে, আপনারা দুজনই শিক্ষিত সর্বোচ্চ ডিগ্রীধারী। নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন মানুষের কাছে কী বার্তা গেছে? আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে সবাই। তখন ব্যারিস্টার তাপস কান্তি বল বলেন, মা ছুটি নিয়ে বাচ্চাদের নিয়ে ঘুরছে। বাবারও ইচ্ছা শিশুদের নিয়ে ঘুরতে। আদালত বলেন, বাবাও ঘুরতে পারবেন। এরপর আদালত পরবর্তী আদেশের জন্য ১ আগস্ট দিন ঠিক করেন। এ সময় আদালত বলেন, সমঝোতা প্রক্রিয়ার উন্নতি হয়েছে। আরও উন্নতির জন্য দু’পক্ষই সময় চেয়েছেন। সময় দেয়া হলো।
×