ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নাগরিকত্ব ছাড়া মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় না রোহিঙ্গারা

প্রকাশিত: ০৫:০৮, ৫ জুলাই ২০১৮

 নাগরিকত্ব ছাড়া মিয়ানমারে ফিরে যেতে চায় না রোহিঙ্গারা

মোয়াজ্জেমুল হক/এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা ইস্যু দিন দিন জটিল রূপ নিচ্ছে। এছাড়া এ ইস্যুতে জাতিসংঘের দুই সংস্থার সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের স্বাক্ষরিত সমঝোতা চুক্তি ফাঁস হয়ে প্রকৃত তথ্য জানার পর আশ্রিত রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, ওই দুই চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও জাতিগত স্বীকৃতির বিষয়টি সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত হয়ে আছে। উখিয়া টেকনাফ অঞ্চলে আশ্রিত বার লক্ষাধিক রোহিঙ্গার মধ্যে বড় একটি অংশ এখন তাদের জাতিগত স্বীকৃতি ও নাগরিকত্বের ইস্যুতে একাট্টা হয়েছে। আর এদের যুগপৎভাবে ইন্ধন ও উস্কানি দিচ্ছে ইসলামী ব্যানারের নামেসহ কয়েকটি এনজিও। এগুলোর মধ্যে বেশকিছু অনিবন্ধিত অবৈধভাবে এসব এনজিও নিজস্ব ফায়দা হাসিল করার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের সহায়তায় নেমেছে বলে জানান দিয়ে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যুতে জাতিসংঘ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা চুক্তির গোপন খসড়াটি ফেসবুকে ফাঁস হওয়ার পর এ নিয়ে রোহিঙ্গা শিবিরগুলোতে রীতিমত হৈ চৈ পড়ে গেছে। এসব চুক্তির বিষয়বস্তুতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও জাতিগত স্বীকৃতির বিষয়টি স্পষ্ট না থাকায় আরাকান বিদ্রোহী গ্রুপের সঙ্গে জড়িতরাও ব্যাপকভাবে উস্কানি দিতে শুরু করেছে। সহসা নিজ দেশে ফিরে না যাওয়ার জন্য সাধারণ রোহিঙ্গাদের আন্দোলনমুখী করে তোলার চেষ্টা চলছে। সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, গত সোমবার উখিয়ায় আশ্রিত রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনকালে জাতিসংঘ মহাসচিবকে জানানো হয়েছে তারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে ফেরত যেতে চায়। মানুষের মতো বাঁচতে চায়। তারা নাগরিক অধিকার ফিরে পেতে চায়। মিয়ানমার থেকে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের মুখ থেকে ভয়াবহ নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার বিবরণ শুনেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তনিও গুতেরেস ও বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। ওই সময় রোহিঙ্গারা জানিয়েছিল, নাগরিক হিসেবে পূর্ণ অধিকার ছাড়া মিয়ানমার কখনও রোহিঙ্গাদের জন্য নিরাপদ হবে না। তাই তারা মৌলিক সকল অধিকার নিয়েই নিজ দেশে ফিরে যেতে চায় বিশেষ করে নাগরিকত্বের অধিকার ছাড়া তারা মিয়ানমারে ফিরতে চায় না। ক্যাম্পে আশ্রিত রোহিঙ্গা নেতাদের বিভিন্ন সূত্রে জানানো হয়েছে, নানামুখী বর্বরতা নিপীড়নের মুখে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে অবস্থান নেয়া ১২ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাতের দুঃখ দুর্দশার চিত্র জাতিসংঘের মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট দেখে গেছেন, শুনে গেছেন অমানবিকতার হিংস্র ছোবলের নানা বর্ণনা। রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতারা জাতিসংঘ মহাসচিব ও বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, মিয়ানমার সরকার তাদেরকে পূর্ণ নাগরিকত্ব প্রদান, জায়গা-জমি, ভিটেবাড়ি ফিরিয়ে দিলে সহসাই স্বদেশে ফিরে যেতে তারা প্রস্তুত। নাগরিকত্ব ছাড়াও স্বাধীনভাবে চলাফেরা ও কর্মের নিশ্চয়তাসহ সকল অধিকার প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত তারা মিয়ানমারে ফিরতে নারাজ। তবে মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের মধ্যে যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে, তাতে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্বের দাবি উপেক্ষিত হয়েছে বলে জানিয়েছে রোহিঙ্গা নেতারা। তাই তারা এ পরিস্থিতিতে স্বদেশে ফিরে যেতে চায় না। সূত্র আরও জানায়, বুধবার সকাল থেকে টেকনাফ ও উখিয়ার আশ্রিত ক্যাম্পে মাঝিদের কাছে মুঠোফোন ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে সম্প্রতি মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তির খবর আরও বিকৃত করে প্রচার করা হয়েছে। অতি বর্ষণের মধ্যেও এ খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ে রোহিঙ্গাদের মাঝে। আরাকান বিদ্রোহী গ্রুপ রোহিঙ্গা জঙ্গীদের তরফ থেকে যে কোন মুহূর্তে আন্দোলনের ডাক দিলে প্রস্তুত থাকতেও রোহিঙ্গাদের জানানো হয়েছে বলে সূত্রটি দাবি করেছে। তবে কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আফরুজুল হক টুটুল বুধবার জনকণ্ঠকে বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মাঝিদের সঙ্গে জেলা পুলিশের যোগাযোগ রয়েছে। স্বার্থ হাসিল করার জন্য যারা অপপ্রচার চালাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সজাগ রয়েছে। ক্যাম্পে শৃঙ্খলা রক্ষায় তৎপর রাখা হয়েছে আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের। সূত্র জানিয়েছে, রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গারা ঢালাওভাবে অনুপ্রবেশ করার পর আরাকান বিদ্রোহী গ্রুপ ক্যাডারদের (পুরনো রোহিঙ্গা জঙ্গী) ক্যাম্পভিত্তিক তৎপরতা বেড়ে গেছে। তারা কতিপয় ইসলামী এনজিওর পক্ষে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণের নামে অবাধে যাতায়াত করছে আশ্রিত ক্যাম্পে। বেশির ভাগ সরকার দলীয় একজন এমপির (চট্টগ্রাম) পরিচালনাধীন একটি এনজিওর নাম ভাঙ্গিয়ে গত ১০ মাস ধরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যাওয়া আসা করে চলছে। সহসায় স্বদেশে ফিরে না যেতে উস্কানি দেয়া হচ্ছে রোহিঙ্গাদের। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, ১২৬টি এনজিও রোহিঙ্গাদের সেবায় দায়িত্ব পালন করছে। এদের মধ্যে কয়েকটি ইসলামী এনজিও রয়েছে। অনেকে কাজ শেষ করে তাদের দায়িত্ব গুটিয়ে নিচ্ছে। সরকার নির্ধারিত ছাড়া নিয়মবহির্ভূত কোন কাজে এনজিও কর্মীরা জড়িত থাকলে তদন্ত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এদিকে সীমান্তের ওপারের সূত্রগুলো জানিয়েছে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে জাতিসংঘের দুই সংস্থার সঙ্গে স্বাক্ষরিত সমঝোতা চুক্তির গোপন খসড়াটি কে বা কারা ফেসবুকে ফাঁস করেছে তা জানার চেষ্টা করছে মিয়ানমার সরকার। এ নথি কি জাতিসংঘ সংশ্লিষ্ট কেউ ফাঁস করেছে কিংবা কূটনীতিকদের কেউ এ কাজ করেছেন নাকি সাংবাদিকরা তা ফাঁস করেছেন; তা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে। মিয়ানমারের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের মুখপাত্র উ জ হতেকে উদ্ধৃত করে দেশটির সংবাদমাধ্যম ইরাবতি খবরটি জানিয়েছে। গত বছরের ২৫ আগস্ট রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার পর পূর্ব-পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। জাতিগত নিধন থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয় প্রায় ৭ লাখ রোহিঙ্গা। মিয়ানমার শুরু থেকেই রোহিঙ্গাদের বাঙালী মুসলিম আখ্যা দিয়ে নাগরিকত্ব অস্বীকার করে আসছে। তবে এবারের ঘটনায় আন্তর্জাতিক চাপ জোরালো হওয়ার একপর্যায়ে প্রত্যাবাসন চুক্তিতে বাধ্য হয় মিয়ানমার। তবে সেই চুক্তির আওতায় এখনও একজন রোহিঙ্গাকেও ফিরিয়ে নেয়নি মিয়ানমার। এর মধ্যেই গত ৬ জুন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রশ্নে মিয়ানমারের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে জাতিসংঘ। তবে সেখানেও নাগরিকত্ব প্রশ্নটি উপেক্ষিত। জাতিসংঘ ও মিয়ানমারের মধ্যে স্বাক্ষরিত সমঝোতা স্মারক নিয়ে বিস্তারিত প্রকাশ না করা হলেও গত ২৯ জুন তা অনলাইনে ফাঁস হয়। ‘ইয়াঙ্গুন ইনফরমার’ নামের একটি ফেসবুক পেজে ৮ জুন স্বাক্ষরিত ওই সমঝোতা চুক্তির কয়েকটি নথি ফাঁস করা হয়। দাবি করা হয়, এগুলোতে চুক্তির বিস্তারিত আছে। পরদিন (৩০ জুন) ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। ওই নথি পর্যালোচনা করে সংবাদ মাধ্যমটি জানায়, খসড়া চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের জাতিগত স্বীকৃতি মেলেনি। উপেক্ষিত হয়েছে তাদের নাগরিকত্বের দাবি।
×