এমনিতে রাশিয়া পর্যটকদের দেশ নয়। অন্তত ইউরোপের আর সব দেশের মতো তো নয়ই। বিশ্বকাপ উপলক্ষে দেশটির মানুষ এখন বিরল অভিজ্ঞতার মুখোমুখি। হোটেল, মোটেল, রেস্তরাঁয়, বাস, ট্রাম সর্বত্রই বিচিত্র সব চেহারা আর বেশভূষার মানুষে ঠাসা। সেখানে যেমন আছেন ইউরোপ, আমেরিকার মানুষ, আছেন এশিয়ান, মধ্যপ্রাচ্যেরও। কারও গায়ের রং সাদা, কারও আবার কাল, নয়ত বা তামাটে। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান, মুসলমান মিলেমিশে একাকার। রাশানদের ইংরেজী জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কারণে খেলা দেখতে আসা হাজার হাজার ভিনদেশী বিভিন্ন রকমের সমস্যায় পড়ছেন, এমন খবর এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে। এত কিছুর মধ্য দিয়েও স্থানীয়দের আতিথেয়তায়, ব্যবহারে মুগ্ধ সবাই।
আসর শুরুর আগেই বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ক্ষমতাধর ব্যক্তি রাশিয়া প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন বলেছিলে, অতিথিদের মন জয় করার বিচারে বিশ্বকাপ জিততে চায় তার দেশ। আয়োজনের মধ্যপথেই যেন সেটি সত্যি বলে প্রমাণিত হচ্ছে। মাঠের ফুটবলেও দারুণ সাফল্য দেখাচ্ছে রাশিয়া। সবার আগে নিশ্চিত করেছে দ্বিতীয় পর্বের টিকেট। কলম্বিয়া থেকে খেলা দেখতে রাজধানী মস্কোয় ঘাঁটি গাড়া এক সমর্থক বলচিলেন,‘সত্যি শহরটা দারুণ। অনেকে অনেক কিছু বলেছিলেন, কিন্তু এখানে এসে চমৎকার অভিজ্ঞতা হলো। মানুষগুলোই দারুণ। আমি আবারও এখানে আসতে চাইব।’ এক বেলজিয়াম সমর্থক বলছিলেন, ‘আমাকে সবাই ক্রেজী ফ্যান বলে ডাকছেন, এটা আমি বেশ উপভোগ করছি।’ বিদেশীদের এই উপস্থতিতি উপভোগ করলেও স্থানীয়রা কিন্তু মধুর বিড়ম্বনায় পড়ছেন। এই যেমন শীতল দেশ রাশিয়ায় বিয়ারের টান পড়ে গেছে! পানীয় হিসেবে বিয়ারের কদর সর্বজনবিদিত।
বিশেষত বৈশ্বিক ক্রীড়া আসরগুলোতে বিয়ারের চাহিদা প্রচুর পরিমাণ বেড়ে যায়। গ্যালারিতেও উল্লাসরত দর্শকদের হাতে খুব সহজেই চোখে পড়ে বিয়ারভর্তি বড় বড় মগ কিংবা বোতল। রাশিয়ায় চলছে বিশ্ব ফুটবলের সবচেয়ে বড় আসর। সেই রাশিয়াতেই ফুটবল দর্শকদের শুকনো গলায় খেলা দেখতে হতে পারে! কারণ বিভিন্ন দেশ থেকে আগত ফুটবল সমর্থকরা রাশিয়ার সব বিয়ার খেয়ে ফেলেছেন! দেশটির পানশালাগুলো পড়েছে চরম বিয়ার শঙ্কটে! সরবারহ কম থাকায় এবং বিদেশ থেকে অভ্যাগতরা অতিরিক্ত পান করায় মস্কোর বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট এবং পানশালায় একেবারেই বিয়ার নেই। বিয়ারের অভাবে রাশিয়ায় আশা লাখ লাখ বিদেশী রাশিয়ার গ্রীষ্মকে উপভোগ করতে পারছেন না। রাশিয়ায় আগতদের তৃষ্ণা আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে। কারণ কবে নাগাদ এই সঙ্কট মিটবে পানশালাগুলো তা জানাতে পারছে না।
সেন্ট্রাল মস্কোর একটি পানশালার স্বত্বাধিকারীকে প্রশ্ন করা হয়েছিল বিয়ারের এতো চাহিদার কারণ সম্পর্কে। তিনি বলেন, ‘সবাই শুধু বিয়ার চায় আর কিছু চায় না। মস্কোতে এখন প্রচুর মানুষ। তারা সবাই পান করছেন। কারণ এটা গরম এবং এটা ফুটবল।’ পানশালার মালিক জানিয়েছেন তিনি বড় রকমের বিয়ার সঙ্কটে পড়েছেন। তারা প্রতি ২৪ ঘণ্টায় মাত্র একবার বিয়ারের সরবরাহ পাচ্ছেন! গত এক দশকে রাশিয়ায় বিয়ারের বিক্রি এমনিতেই এক তৃতীয়াংশ কমে গেছে। কারণ বিয়ারের ওপরে এ্যালকোহলপ্রেমী দেশটিতে প্রচুর পরিমাণে শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে দেশটিতে বিয়ারের বিক্রি এবং বিজ্ঞাপনের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। বিশ্বকাপে দেশটিতে বিয়ারের চাহিদা এত ব্যাপক হবে তা আগাম আন্দাজে ব্যর্থ হয়েছিলেন দেশটির বিয়ার উৎপাদকরা। দেশটির প্রধান বিয়ার উৎপাদক বালটিকা জানিয়েছে তারা নষ্ট হওয়ার শঙ্কায় অতিরিক্ত বিয়ার উৎপাদনের ঝুঁকি নেননি। রাশিয়ার জনপ্রিয়তম পানীয় ভদকা।
প্রতিবছর রাশিয়ানরা গড়ে ২০ লিটারের অধিক ভদকা পান করেন। পৃথিবীর শীতলতম দেশটির নাগরিকদের বরাবরই অধিক এ্যালকোহল যুক্ত পানীয়ের প্রতি আগ্রহ রয়েছে। তবে বিশ্বকাপে ভিনদেশী মুসলিমদের কথা মাথায় রেখে অস্থায়ী এ্যালকোহলমুক্ত রেস্টুরেন্টও চালু করা হয়। ওদিকে মাঠের ফুটবলেও চমক দেখিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে এসেছে আয়োজক রাশিয়া। অথচ বাছাই খেলতে হলে বিশ্বকাপে হয়তো খেলাই সম্ভব হতোনা! কারণ, এবার বিশ্বকাপে সবচেয়ে নিচু র্যাঙ্কিংয়ের দল রাশিয়া। আয়োজক হিসেবে সরাসরি খেলার সুযোগ পেয়েছে এমন এক বিশ্বকাপ মঞ্চে যেখানে কোন ফুটবল বোদ্ধার ভবিষ্যদ্বাণী কিংবা আভাস ফলছেনা। সে কারণেই একে একে বিশ্বকাপের ফেবারিট গত আসরের চ্যাম্পিয়ন জার্মানি, রানার্সআপ আর্জেন্টিনা এবং ২০১০ চ্যাম্পিয়ন স্পেন ও ২০১৬ সালের ইউরো চ্যাম্পিয়ন পর্তুগালের মতো দলগুলোর বিদায় ঘণ্টা বেজেছে। কিন্তু যেই রাশিয়াকে দুর্বলতম এবং শুধুমাত্র অংশগ্রহণকারী দল ভাবা হয়েছিল তারাই পেয়েছে নিজেদের ইতিহাসে সেরা সাফল্য। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে যাওয়ার পর ফুটবলে ভগ্নদশায় পতিত হওয়া রাশিয়া দলটি এবারই প্রথম বিশ্বকাপের শেষ আটে উঠেছে। অন্যতম ফেবারিট স্পেনকে টাইব্রেকারে হারিয়ে দিয়ে এই অভাবিতসাফল্য পাওয়ার মূলমন্ত্র ম্যাচ শুরুর আগে কোচ স্তানিস্লাভ চেরচেসভের কাছে দেশের প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের ফোন করে জানানো শুভকামনা। এ কারণেই ফুটবল পরাশক্তি স্পেনের পতন ঘটেছে, মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে হয়েছে রুশ বিপ্লব। এমনটাই মনে করছেন সবাই!
বল দখলে রাখা, সর্বাধিক সময় ও দূরত্ব বল নিয়ে পরস্পরের মধ্যে আদান-প্রদাণ, নিখুঁত পাস সম্পন্ন করা, গোলে শট নেয়া সবকিছুতেই এগিয়েছিল অন্যতম ফেবারিট স্পেন। কিন্তু ম্যাচে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে ও প্রতিপক্ষের রক্ষণদূর্গ চিড়ে দিতে না পারলে যা হয়, সেটাই হয়েছে। ২০১০ সালের চ্যাম্পিয়নরা এবারও আগেভাগেই বিদায় নিয়েছে বিশ্বকাপ মঞ্চ থেকে। গত আসরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিয়েছিল স্পেন। এবার তাদের শেষ ষোলো থেকে বিদায় করে নিজেদের ফুটবল ইতিহাসের সেরা সাফল্য পেয়েছে চমক দেখানো দল রাশিয়া। অংশগ্রহণকারী ৩২ দলের মধ্যে এবার র্যাঙ্কিংয়ে সবচেয়ে পিছিয়ে রাশিয়ার অবস্থান ৭০ নম্বরে। খুব সম্ভব বাছাই পর্ব খেলতে হলে এই মঞ্চেই হয়তো ঠাঁই পাওয়া হতোনা তাদের। কিন্তু এখন তারা বুঝিয়ে দিল কোনক্রমেই অন্য দলগুলোর চেয়ে নৈপুণ্যে পিছিয়ে নেই রাশিয়া। ১৯৬৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন হিসেবে নিজেদের সেরা সাফল্য ছিল চতুর্থ স্থানে থেকে বিশ্বকাপ শেষ করা। ৭ বার সোভিয়েত ইউনিয়ন হিসেবে খেলেছে তারা। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে ১৯৯৪ সালে রাশিয়া প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মোট তিন বিশ্বকাপ খেলে গ্রুপ পর্ব থেকেই একেবারে নাজেহাল অবস্থায় বিদায় নিতে হয়েছিল। কিন্তু দাপটের সঙ্গে দ্বিতীয় রাউন্ডে পা রাখা রাশিয়া শেষ ষোলোয় প্রথমবার পা রেখেছে।
যদিও ম্যাচের শুরুতেই একটি আত্মঘাতী গোলে লুঝনিকি স্টেডিয়ামে নৈঃশব্দ নেমে এসেছিল, যেন বোঝা হয়ে সবার বুকে চেপে বসেছিল অন্তরাত্মার মৃত্যু! তবে প্রথমার্ধের শেষদিকে আরতেম জিউবা পেনাল্টিতে গোল করে সমতা আনার পর আর স্প্যানিশদের কোন আক্রমণকেই সফলহতে দেয়নি ১১ জন রুশ বিপ্লবী। অজ¯্র আক্রমণ দক্ষতার সঙ্গে ঠেকিয়েছে নির্ধারিত ৯০ মিনিটের পরও অতিরিক্ত ৩০ মিনিট। টাইব্রেকার নামের ভাগ্যপরীক্ষাটি ¯œায়ুর ওপরে প্রচ- এক চাপ, সেই সঙ্গে প্রত্যাশার চাপের মধ্যে আছে দর্শকদের কামনা, চিৎকার, সমর্থনের বিষয়টি। সেখানেই অভিজ্ঞতম স্পেনের স্বপ্নের অপমৃত্যু। পুরো রাশিয়াতে তখন ফেবারিট স্পেন যেন এতিম! রাশিয়ার খেলোয়াড়দের সাহস বাড়িয়েছে দর্শকদের পূর্ণ সমর্থন, শক্তি জুগিয়েছে নিখুঁত শটে। চারটি শটের সবগুলোই লক্ষ্যভেদ করেছে রাশিয়া, আর ৫টির মধ্যে দুটিই পারেনি স্পেন। বিদায় করে দিয়েছে তাদের বিশ্বকাপ আয়োজক রাশিয়া। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, ‘ম্যাচের আগেই দুপুরের কাছাকাছি সময়ে প্রেসিডেন্ট কল করেছিলেন কোচকে এবং তাকে শুভ কামনা জানিয়েছিলেন। পুতিন সে সময় বলেছেন যে চেরচেসভের নেতৃত্বে আমাদের ছেলেরা ইতোমধ্যেই অসম্ভব সাধন করেছে গ্রুপ পর্ব থেকে উঠে এসে। স্পেনের বিপক্ষে ম্যাচে যেটাই হোক দেশের কেউ এই দলটিকে অন্যভাবে বিচার করবে না।’