ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

দিলরুবা কুহিনূর সুইটি

মেসি-রোনাল্ডোর ১৩ মজার মিল!

প্রকাশিত: ০৭:১৮, ৪ জুলাই ২০১৮

মেসি-রোনাল্ডোর ১৩ মজার মিল!

বর্তমান ফুটবল প্রজন্ম একটা ব্যাপারে ভীষণ গর্ববোধ করতে পারে একটা কথা ভেবে, তারা জন্মগ্রহণ করেছে বিশ^সেরা দুই ফুটবলার লিওনেল মেসি এবং ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর সময়ে। আলফ্রেড ডি স্টেফানো, ফেরেঙ্ক পুসকাস, পেলে, ডিয়েগো ম্যারাডোনা ... এভাবেই সর্বকালের সেরা ফুটবলারের ক্রমটা চলছিল যগ যুগ ধরে। কিন্তু ম্যারাডোনা বিদায়ের পর অনেকেই দৃশ্যপটে আবির্ভূত হলেও কেউ সে কাতারে যেতে পারেননি। তবে বেশ খানিকটা সময় পরে দৃশ্যপট এলেন। তবে একজন নন, দুজন! মেসি এবং রোনাল্ডো। বছর দশেক ধরে দুজনের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই বিদ্যমান। সহসাই এ প্রতিযোগিতা থামার নয়। বরং আরও কমপক্ষে বছর চারেক দেখা যাবার সমূহ সম্ভাবনা। এই দুজন ক্লাব ফুটবলে যতটা অভাবনীয় সাফল্য লাভ করেছেন, জাতীয় দলের হয়ে ততটা নন। অবশ্য অনেক ফুটবলবোদ্ধাই মনে করেন গ্রেট ফুটবলারদের বিশ^কাপ জিততেই হবে, এমন কোন কথা নেই। তবে একটা ব্যাপারে মেসির চেয়ে এগিয়ে রোনাল্ডো। যেখানে মেসি চারবার কোপা আমেরিকা কাপের ফাইনাল খেলে একবারও শিরোপা জিততে পারেননি, সেখানে রোনাল্ডো দুবার ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল খেলে একবার শিরোপাজয়ের স্বাদ পেয়েছেন (২০১৬)। স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের সুপারস্টার পর্তুগালের ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন বার্সেলোনার ডায়মন্ড আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। চলমান রাশিয়া বিশ^কাপ থেকে দুজনের দেশই কি না বিদায় নিল রাতে, চার ঘণ্টা আগে-পরে! মেসি-রোনাল্ডোর মধ্যে কত মিল দেখুন। দুজনেই প্রথাগত ফরোয়ার্ড নন। দুজনেই জাতীয় দল এবং ক্লাব দলের হয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা। দুজনেই জিতেছেন পাঁচবার করে ব্যালন ডি’অর। দুজনেই খেলেন একই দেশের লীগে। দুজনেই ত্রিশোর্ধ। দুজনেই জাতীয় দলের অধিনায়ক। দুজনেই খেলেছেন চারটি বিশ্বকাপ। দুজনেই একবারও জেতেননি বিশ্বকাপ। দুজনেই এবারের বিশ্বকাপে গোল করেছেন। দুজনেই এবার একটি করে পেনাল্টি মিস করেছেন। দুজনেই এবারের বিশ্বকাপে নিজ দলের চতুর্থ খেলায় কোন গোল পাননি। দুজনের দলই এবারের বিশ্বকাপে বিদায় নিয়েছে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকে এবং একই রাতে ...! ২০০৬ আসরে মাত্র ১৯ বছর বয়সে আর্জেন্টিনার হয়ে বিশ্বকাপ-অভিষেক হয় মেসির। সেবার কোয়ার্টার ফাইনালে জার্মানির কাছে টাইব্রেকারে হেরে বিদায় নিয়েছিল আর্জেন্টিনা। কোচ জোসে পেকারম্যান কেন যে ওই ম্যাচে মেসিকে মাঠেই নামালেন না, সেটা রহস্য হয়ে আছে আজও। ২০১০ বিশ্বকাপ। এবার কোচ কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনা। তিনি পেকারম্যানের মতো ভুল করেননি। তবে তাতেও লাভ হয়নি। কাকতালীয়ভাবে এবারও সেই কোয়ার্টার ফাইনাল থেকেই একই প্রতিপক্ষ জার্মানির কাছে হেরেই বিদায় নিতে হয় লা আলবিসেলিস্তেদের। ২০১৪ বিশ্বকাপ। এই আসরে মেসি অধিনায়ক। এবার ফাইনালে ওঠে আর্জেন্টিনা। প্রতিপক্ষ? সেই জার্মানি! যে জার্মানির কাছে ১৯৯০ আসরের ফাইনালে ১-০ গোলে হেরেছিল ডিয়েগো ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা, সেই জার্মানির কাছেই একই ব্যবধানে ২০১৪ আসরের ফাইনালে হারে মেসির আর্জেন্টিনা। আসরের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার পেয়েও হৃদয়ে রক্তক্ষরণ থামেনি মেসির। এবারের ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপে সুযোগ পেয়েছিলেন আরেকবার। কিন্তু থমকে যেতে হলো নকআউট পর্বেই, প্রতিপক্ষ ফ্রান্স। একই কথা প্রযোজ্য রোনাল্ডোর ক্ষেত্রেও। ২০০৬ সালে ২১ বছর বয়সে বিশ্বকাপে অভিষেক হয় তার। সেবার পর্তুগাল অসাধারণ খেলে সেমিফাইনাল পর্যন্ত উঠে যায়। কিন্তু জিদানের ফ্রান্সের কাছে হেরে গিয়ে ফাইনালে ওঠার স্বপ্নভঙ্গ হয় রোনাল্ডোদের। ২০১০ আসরে দ্বিতীয় রাউন্ডেই থেমে যায় তাদের যাত্রা। এবার হারে স্পেনের কাছে। ২০১৪ আসরে অবস্থা আরও খারাপ। এবার পাততাড়ি গোটাতে হয় প্রথম রাউন্ড থেকেই। পয়েন্ট সমান হলেও গোল পার্থক্যে পিছিয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে। এবার ২০১৮ আসরেও একই চিত্র। এবার বিদায় ঘটে দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই, প্রতিপক্ষ উরুগুয়ে। এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপ থেকে বিদায় নেয়ার পর মেসির প্রতিক্রিয়া ছিল এরকম, ‘আমরা তিন বছরের মধ্যে তিনটি ফাইনাল খেলেছি (একটি বিশ্বকাপ এবং দুটি কোপা আমেরিকার ফাইনাল), কিন্তু প্রতিবারই আমরা ব্যর্থ হয়েছি। এটাই বাস্তবতা, আমরা এবারও পারিনি।’ আর্জেন্টাইন ফুটবল ফ্যানরা যতই মেসিকে দোষ দিক না কেন, বাস্তবতা হচ্ছেÑ মেসি ছাড়া আর্জেন্টিনা একেবারেই অসহায় দল। মেসি খেলেননি, এমন ম্যাচগুলোতে আর্জেন্টিনার জয়ের হার খুবই খারাপ। এছাড়া পরিসংখ্যান বলেÑ মেসি গোল করেছেন, এমন ম্যাচে আর্জেন্টিনা কখনই হারেনি। আর্জেন্টিনা যখন এবারের বিশ্বকাপের মূলপর্বে না ওঠার চরম হুমকিতে ছিল, তখন মেসিই ইকুয়েডরের বিরুদ্ধে অবিশ্বাস্য-অসাধারণ হ্যাটট্রিক করে দলকে মূলপর্বের টিকেট পাইয়ে দেন। নইলে ১৯৭০ সালের মতো এবারও হয়ত মূলপর্বে খেলতে পারত না আর্জেন্টিনা। এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপে নাইজেরিয়ার বিরদ্ধে বাঁচা-মরার ম্যাচে দলকে জেতানোর থেকে প্রথম গোলটি আসে তার পা থেকেই। একই কথা প্রযোজ্য রোনাল্ডোর বেলাতেও। পর্তুগাল বরাবরই রোনাল্ডো-নির্ভর দল। রোনাল্ডো গোল করলে তার দল হারে হারে না, এটা পুরনো সত্য। ইউসেবিও এবং লুসি ফিগো পারেননি পর্তুগালকে সোনালি বিশ্বকাপ ট্রফি এনে দিতে। সেই দায়িত্বটা নিজের কাঁধে নিয়ে সফল হবার আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন রোনাল্ডো। এবার প্রথম গ্রুপ ম্যাচেই স্পেনের বিরুদ্ধে দুর্দান্ত হ্যাটট্রিক করে জানান দেন (ম্যাচটি ড্র হয়)Ñ পর্তুগাল রেসে আছে। পরের ম্যাচেও মরক্কোর সঙ্গে এক গোল করে দলকে জয় এনে দেন। শেষ গ্রুপ ম্যাচে ইরানের সঙ্গে পেনাল্টি মিস করলেও দল ড্র করে দ্বিতীয় রাউন্ডে নাম লেখায়। সেখানে কঠিন প্রতিপক্ষ উরুগুয়ে। কিন্তু প্রথমার্ধে এক গোলে পিছিয়ে পড়ে ‘দ্য নেভিগেটর্স’ খ্যাত পর্তুগাল। দ্বিতীয়ার্ধে খেলা শুরুর আগে মাঠে নামার আগে টানেলে সতীর্থদের নিয়ে গোল হয়ে সংক্ষিপ্ত এক ‘টিম মিটিং’ করেন অধিনায়ক রোনাল্ডো। সতীর্থর উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন। তার প্রভাবেই ১০ মিনিটের মধ্যেই দারুণভাবে সমতায় ফেরে পর্তুগাল। কিন্তু তারপরও আরেকটি গোল হজম করে আর শেষরক্ষা করতে পারেনি পর্তুগাল। অশ্রুজলে বিদায় নিতে হয় রোনাল্ডোকে। আরেকবার। প্রশ্ন উঠেছে, মেসি-রোনাল্ডোকে কি পরের ২০২২ কাতার বিশ্বকাপেও দেখা যাবে? যদি খেলেনও, তাহলে বয়স কিন্তু একটা ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে দাঁড়াবে। কেননা তখন বয়স হবে মেসির ৩৫, রোনাল্ডোর ৩৭। তন কি ফর্ম-ফিটনেস কথা বলবে তাদের পক্ষে? যদিও মেসি বলেছেন, বিশ্বকাপ না জিতলেও তিনি জাতীয় দলের হয়ে খেলা চালিয়ে যাবেন। আর রোনাল্ডো তো আগেই ঘোষণা দিয়েছেন তিনি ৪১ বছর পর্যন্ত খেলবেন। তবে এখানে আরেকটা প্রশ্ন এসেই যায়। তা হলো, ফর্ম-ফিটনেস-বয়স পক্ষে থাকার পরও এই দুই তারকা ফুটবলার যেখানে এবারও বিশ্বকাপ জিততে পারেননি, সেখানে চার বছর পর আর কতটা বা কিভাবে সফল হবেন? ইতিহাস বলে, অতীতে অনেক গ্রেট ফুটবলারই ছিলেন, যারা কখনও বিশ্বকাপ জিততে পারেননি। তালিকাটা শুনুন : আর্জেন্টিনার আলফ্রেড ডি স্টেফানো, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা; ব্রাজিলের লিওনিদাস, জিকো, সক্রোটিস, কারেকা, রবিনহো; হাঙ্গেরির ফেরেঙ্ক পুসকাস, নেদারল্যান্ডের ইয়োহান ক্রুইফ, রুড গুলিট, ফ্রাঙ্ক রাইকার্ড, মার্কো ভ্যান বাস্তেন, ওয়েসলি ¯েœইডার, সোভিয়েত ইউনিয়নের লেভ ইয়াসিন, ইউক্রেনের আন্দ্রেই শেভচেঙ্কো, লাইবেরিয়ার জর্জ উইয়াহ্, ইংল্যান্ডের গ্যারি লিনেকার, পল গ্যাসকোয়েন, ডেভিড বেকহাম, ওয়েইন রুনি; আয়ারল্যান্ডের জর্জ বেস্ট, ইতালির পাওলো মালদিনি, ফ্রাঙ্কো বারেসি, রবার্তো ব্যাজিও, আলেজান্দ্রো দেল পিয়েরো, ফ্রান্সের মিশেল প্লাতিনি, এরিক কাঁতোয়া, পর্তুগালের ইউসেবিও, লুইস ফিগো; জার্মানির অলিভার কান, মাইকেল বালাক, উরুগুয়ের এ্যাঞ্জো ফ্রান্সিসকলি, ডিয়েগো ফোরলান, স্পেনের রাউল গঞ্জালেস, চিলির সালাস, জামারানো, কলম্বিয়ার কার্লোস ভালদেরামাসহ আরও অনেকেই। শেষ পর্যন্ত ‘এলএম টেন’ মেসি এবং ‘সিআর সেভেন’ রোনাল্ডো কি তাদের সঙ্গেই যোগ দেবেন? সেটা জানা যাবে চার বছর পর।
×