ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাত্র ১৯ বছর বয়সেই মহাতারকাদের কাতারে!

প্রকাশিত: ০৭:১৭, ৪ জুলাই ২০১৮

মাত্র ১৯ বছর বয়সেই মহাতারকাদের কাতারে!

এখুনি কিংবদন্তি পেলের ছায়া দেখতে পাচ্ছেন তার মধ্যে অনেকে। কারণ, মাত্র ১৯ বছর বয়সে জাগিয়ে তুলেছেন ৬০ বছর আগের ইতিহাস। ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি পেলের কম বয়সে গোলের রেকর্ড স্পর্শ করেছেন কিলিয়ান এমবাপে। এখন তিনি ফ্রান্স ফুটবল দলের অন্যতম চালিকাশক্তি। আক্রমণভাগের অন্যতম যোদ্ধা এমবাপে। ফরাসি এ তরুণ ফরোয়ার্ড নকআউট পর্বের প্রথম ম্যাচেই দলকে জিতিয়েছেন জোড়া গোল করে। শক্তিশালী আর্জেন্টিনার বিপক্ষে দুই গোল করে বিশ্বকাপের ইতিহাসে এত কম বয়সে জোড়া গোলের প্রথম নজির স্থাপন করে এখন প্রশংসায় ভাসছেন তিনি। অনেকেই তাকে তুলনা করছেন কিংবদন্তি পেলের সঙ্গে। ১৯৫৮ সালে পেলেই একমাত্র টিনেজার হিসেবে নকআউট পর্বে জোড়া গোলের কৃতিত্ব দেখিয়েছিলেন। তাই স্বাভাবিকভাবেই পেলের পাশে পৌঁছে গেছেন তিনি। তাই পেলেও এই তরুণকে শুভকামনা জানিয়েছেন এভং অভিনন্দিত করেছেন। বিষয়টি বেশ উপভোগ্য এবং সন্তুষ্টিই দিচ্ছে এমবাপেকে। কিন্তু তিনি দাবি করেছেন পেলে ভিন্ন পর্যায়ের এবং তার সঙ্গে তুলনা করাটা হবে অতিরঞ্জন। প্রথমবার ১৯৯৮ সালে বিশ্বকাপ ফাইনালে ওঠে ফ্রান্স। সেবার নিজেদের মাটিতে সোনালি সাফল্য পেয়েছে তারা। ঘরের মাটিতে একমাত্র বিশ্বকাপ যখন জিতল ফরাসীরা, তখনও পৃথিবীর আলোতেই আসেননি এমবাপে। বিশ্বকাপ বছরের মাঝেই শেষ হয়ে গেছে, তবে ফ্রান্সের ফুটবল আরও গতি পেয়েছে, অনুপ্রেরণা পেয়েছে। দেশজুড়ে শুরু হওয়া ফুটবলের জোয়ারে ১৯৯৮ সালের ২০ ডিসেম্বর এমবাপের জন্ম হয় রাজধানী প্যারিসে। রাজধানী প্যারিসের উত্তর-পূর্ব শহরলীতে বেড়ে ওঠার সময় ফুটবলে দক্ষতা অর্জন করতে শুরু করেন তিনি। সে সময় তিনি খেলতেন এএস বন্ডি ক্লাবে। এমবাপে খেলা শুরুর পর হু হু করে জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে এই ক্লাবের। একই সঙ্গে অল্পবয়সী ছেলেরাও ভিড়তে শুরু করে এই ক্লাবে খেলার জন্য। তাদের স্বপ্ন যে তারাও এমবাপের মতো ফুটবলার হবেন। তার বয়স যখন ১২ থেকে ১৫ তখন তিনি বিখ্যাত ক্লেয়ারফন্টেইন একাডেমিতে ফুটবল খেলা শিখেছেন। মাত্র তিন মাস আগে পর্যন্তও এমবাপের পিতা উইলফ্রেড ছিলেন এএস বন্ডি ক্লাবের পরিচালকদের একজন। তিনি ক্যামেরুন থেকে এসেছিলে ফ্রান্সে। এমবাপের পিতা এই ক্লাবের সঙ্গে ২৫ বছরেরও বেশি সময় জড়িত ছিলেন। যে বছর জন্ম হলো এমবাপে জুনিয়রের, সে বছরই জুলাইয়ে প্রথমবার বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়ার উৎসব করেছেন দিদিয়ের দেশম। এখন তিনি কোচ, আর দলের সেই উদ্ভাসিত সাফল্য দেখতে না পাওয়া এমবাপেই এখন ফ্রান্সের অন্যতম ভরসা। অথচ তার এই উত্থানে খুব বেশি সময় লাগেনি। মাত্র তিন বছর আগে হাই স্কুল শেষ করে দুই বছরের কম সময়ের মধ্যে হয়ে উঠলেন একজন পেশাদার ফুটবলার, ফ্রান্স জাতীয় দলের অন্যতম নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড়। ১০ নম্বর জার্সিধারী এ তরুণকে এখন অনেকেই মহাতারকাদের কাতারে রাখছেন। সেটার প্রমাণ দিয়েছেন বলেই না এমনটি আলোচনা চলছে সর্বত্র। দ্বিতীয় রাউন্ডে ১৯ বছর বয়সী এ স্ট্রাইকারের জোড়া গোলে আর্জেন্টিনাকে হারিয়ে কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছে ফ্রান্স। ২০০৬ বিশ্বকাপে মাত্র ৭ বছর বয়সে অবশ্য রানার্সআপ হতে দেখেছেন, এরপর গত বিশ্বকাপে আরেকটি বড় সাফল্য হিসেবে কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে দেখেছেন। আবারও দল গতবারের সাফল্যকে ছুঁয়ে ফেলেছে। সেটা দুইবার এমবাপে লক্ষ্যভেদ করেছেন বলেই সম্ভব হয়েছে। এই জোড়া গোলে ব্রাজিলের কিংবদন্তি পেলের কৃতিত্ব স্পর্শ করেছেন এমবাপে। ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপে সুইডেনের বিপক্ষে জোড়া গোল করেছিলেন ১৮ বছর বয়সী পেলে। ব্রাজিলের এ সর্বকালের সেরা তারকা ৫৫ ও ৯০ মিনিটে দলের তৃতীয় ও পঞ্চম গোল করেছিলেন। তাতে প্রথমবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় ব্রাজিল। পেলের কীর্তির পর কেটে গেছে ৬০ বছর, এবার তার এই কৃতিত্ব গড়লেন ফ্রান্সের তারকা স্ট্রাইকার। এত কম বয়সে আর কেউ জোড়া গোল করতে পারেননি বিশ্বকাপে। ৬৪ ও ৬৮ মিনিটে দারুণ দুটি গোলে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে বিশ্বকাপে প্রথমবার (৪-৩ ব্যবধানে) জয় নিশ্চিত করেছেন এমবাপে। পেলে সেবার দলকে চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন। এমবাপের এখনও অনেক পরীক্ষা দিতে হবে সেই অবস্থানে যেতে হলে। এ কারণেই গোলের রেকর্ডে পেলের পাশে বসার পর বিনয়ী এমবাপে বলেছেন, ‘আমি খুব খুশি। পেলের পর দ্বিতীয় তরুণ (নকআউট পর্বে এক ম্যাচে জোড়া গোল) হিসেবে এটা করতে পেরে আনন্দে উদ্বেলিত আমি। কিন্তু একটা কথা বলা দরকার- পেলে অন্য মানের, কিন্তু তাদের মতো জায়গায় থাকতে পেরে ভাল লাগছে। তিনি ভিন্ন পর্যায়ের, আমার মনে হয় তার মতো মহান খেলোয়াড়ের সঙ্গে এখন তুলনা করাটা হবে অতিরঞ্জন।’ কিংবদন্তি পেলেও দেখেছেন এমবাপেকে। তিনিও টুইট করেছেন,‘অভিনন্দন এমবাপে, এত কম বয়সে বিশ্বকাপে দুই গোল তোমাকে মহাতারকাদের সঙ্গী করেছে।’ চারদিকে এখন বন্দনা তাকে নিয়ে। গণমাধ্যমগুলোও বসে নেই, এমবাপের দুরন্ত নৈপুণ্য চোখ ঝলসে দিয়েছে ফুটবলপ্রেমীদের। ব্রিটিশ পত্রিকা সানডে টাইমস লিখেছে, ‘মেসির ওপরেও একজন বিশ্বমানের মহাতারকা জন্ম নিয়েছে বিশ্বকাপে!’ ফরাসির ক্রীড়া দৈনিক এল’ইকুইপে লিখেছে, ‘এই ম্যাচের মেসি ছিলেন তিনি!’ গোল দেয়ার পর উচ্ছ্বসিত এমবাপের ছবিতে ক্যাপশন দিয়ে আরও লিখেছে, ‘তিনি তার মেধা বিশ্বকে প্রদর্শন করেছেন এবং লিওনেল মেসিকে ম্লান করে দিয়েছেন।’ প্রতিপক্ষ দলের থেকেও প্রশংসা পেয়েছেন তিনি। আর্জেন্টাইন কোচ জর্জ সাম্পাওলি ম্যাচ শেষে বলেছেন, ‘যখন এমবাপের মতো এমন এক খেলোয়াড়কে আপনি পাবেন তখন তাকে থামানো কঠিন। আর যদি সেটি তার দিন হয় তাহলে আরও মুশকিল।’ নিজ দলের সবার মুখে মুখেই প্রশংসা এমবাপের। বিশ্বকাপ দিয়ে নজরটা আরও ভালভাবে কাড়তে পেরে উচ্ছ্বসিত পিএসজি স্ট্রাইকার এমবাপে বলেন, ‘আমি আগেও বলেছি, সবসময় বলি- বিশ্বকাপে শীর্ষ মানের সব খেলোয়াড় আছে। তাই আপনি কী পারেন এবং সামর্থ্য কী সেটা দেখিয়ে দেয়ার সুযোগ এটা। এই সুযোগ কাজে লাগাতে বিশ্বকাপের চেয়ে ভাল জায়গা আর নেই।’ এবার রাশিয়া বিশ্বকাপে একঝাঁক তরুণ উদীয়মান তারকা নিয়ে দল গড়েছে ফ্রান্স। এর মধ্যে নিশ্চিতভাবেই সবার নজরের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন এমবাপে। কারণটা ক্লাব পর্যায়ে তার ব্যাপক দামী ও সকলের আগ্রহের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠা। সবচেয়ে কম বয়সে ফরাসী লীগ ওয়ানে তার অভিষেক হয় (১৬ বছর ৩৪৭ দিন) মোনাকোর হয়ে। মোনাকোর হয়ে এর আগে রেকর্ডটি ছিল থিয়েরি অঁরির। ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৬, ফ্রেঞ্চ লীগ ওয়ানে মোনাকোর হয়ে পেশাদার ক্যারিয়ারের প্রথম গোল করেন ১৭ বছর ৬২ দিন বয়সে ট্রোয়েসের বিপক্ষে। মোনাকোর ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ গোলদাতা হোন অঁরির রেকর্ড ভেঙ্গে। পরের মাসেই ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো পেশাদার চুক্তির সুযোগ পান তিনি। তিন বছরের চুক্তিতে তাকে ২০১৯ পর্যন্ত মোনাকে চুক্তিবদ্ধ করে। পরের বছরই তিনি মোনাকোকে ১৭ বছর পর প্রথম শিরোপা জিতিয়ে দেন। এ কারণেই তার পারিশ্রমিক বেড়ে যায় হু হু করে। অন্যতম প্রতিপক্ষ প্যারিস সেইন্ট জার্মেই (পিএসজি) তাকে ধার হিসেবে ছিনিয়ে নেয় ১৮০ মিলিয়ন ইউরোর বিনিময়ে। ক্লাব বদলের ইতিহাসে ব্রাজিলের নেইমারের পর তিনি দ্বিতীয় সর্বাধিক পারিশ্রমিক পাওয়া খেলোয়াড় বর্তমানে। এবার ফরাসী লীগে দারুণ আলো ছড়িয়েছেন তিনি। অন্যতম উদীয়মান তারকা হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করতে পেরেছেন। বিশ্বকাপেও তাই তার দিকে দৃষ্টি ছিল সবার। প্রথম ম্যাচে অবশ্য অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে গোল পাননি। কিন্তু দ্বিতীয় ম্যাচে পেরুর বিপক্ষে তার করা গোলেই জয় ছিনিয়ে নেয় ফ্রান্স। ওই গোলের মাধ্যমে তিনি ফ্রান্সের পক্ষে বিশ্বকাপে সর্বকনিষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে গোল দেয়ার কীর্তি গড়েন। আর আর্জেন্টিনার বিপক্ষে জোড়া গোল করে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন।
×