ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আখাউড়া স্থলবন্দরে অচলাবস্থা

প্রকাশিত: ০৬:৪২, ৪ জুলাই ২০১৮

আখাউড়া স্থলবন্দরে অচলাবস্থা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ দেশের অন্যতম বৃহৎ ও রফতানিমুখী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দরে অচলাবস্থা বিরাজ করছে। এ বন্দরে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে রফতানির হার। এতে করে যে কোন মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে আগরতলায় পণ্য রফতানি কার্যক্রম। দেশের অন্যতম বৃহৎ ও রফতানিফমুখী স্থলবন্দর হচ্ছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর। এ বন্দর দিয়ে প্রতিদিন ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলায় মাছ, পাথর, সিমেন্ট, প্লাস্টিক, বর্জ্য তুলা, ভোজ্য তেল ও খাদ্য পণ্যসহ ৩০টিরও বেশি পণ্য রফতানি হয়ে থাকে। এ অবস্থায় বন্দর ও ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে দেশের অন্যান্য বন্দরের মতো আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়েও ভারতীয় কাপড়, প্রসাধনী, ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী ও মোটর যন্ত্রাংশসহ বাংলাদেশে চাহিদা সম্পন্ন সব ধরনের পণ্য আমদানির অনুমতি চান ব্যবসায়ীরা। গত কয়েক বছর ধরে ভারতের আগরতলার ব্যবসায়ীদের নানা অজুহাত ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে ২০ শতাংশে নেমে এসেছে আখাউড়া স্থলবন্দরের রফতানি কার্যক্রম। আগে প্রতিদিন গড়ে দেড় লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি করা হতো আর এখন ২০ থেকে ৩০ হাজার মার্কিন ডলারের পণ্য রফতানি হয়। সব মিলিয়ে বন্দরে অনেকটা অচলাবস্থা বিরাজ করছে। যে কোন সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে রফতানি কার্যক্রম। বন্দর সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার সঙ্গে পার্শ্ববর্তী রাজ্যগুলোর রেল যোগাযোগ চালু হওয়ার পর থেকেই ধস নেমেছে আখাউড়া স্থলবন্দরের রফতানি বাণিজ্যে। আগরতলার বড় ব্যবসায়ীরা নিজ দেশের অন্যান্য রাজ্য থেকে ট্রেনে করে কম দামে মালামাল নিয়ে আসছেন। তাই তারা বাংলাদেশী পণ্য আমদানি করছেন না। বন্দরের ব্যবসায়ী নেতারা জানান, ১৯৯৫ সালের পর থেকে আখাউড়া স্থল শুল্ক স্টেশন দিয়ে আগরতলায় পণ্য আমদানি-রফতানি হয়ে আসছে। ২০১০ সালের ১৩ আগস্ট এটি পূর্ণাঙ্গ বন্দর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পর আমদানি-রফতানি কার্যক্রম আগের চেয়ে অনেক বেশি সম্প্রসারিত হয়। তখন রড, সিমেন্ট, পাথর, প্লাস্টিক, কাঁচা মাছ ও শুঁটকিসহ আরও কয়েকটি পণ্য রফতানি করা হতো আগরতলায়। প্রতিদিন তিন শতাধিক পণ্যবোঝাই ট্রাক আগরতলায় প্রবেশ করত। এর মধ্যে পাথরের ট্রাকই ছিল সবচেয়ে বেশি। ২০১৫ সাল পর্যন্ত আখাউড়া স্থলবন্দরে প্রতিদিন এমন চিত্র দেখা গেলেও আগরতলায় রেল যোগাযোগ চালু হওয়ার পর থেকে এখন গড়ে প্রতিদিন ২০ থেকে ৩০টি পণ্য বোঝাই ট্রাক আগরতলায় ঢুকছে। বাংলাদেশ থেকে কম খরচে নিজ দেশের অন্যান্য রাজ্য থেকে পণ্য সরবরাহ করছেন সেখানকার ব্যবসায়ীরা। তাছাড়া ত্রিপুরা রাজ্যের সঙ্গে অন্যান্য রাজ্যের সড়ক পথেও উন্নয়ন হয়েছে। এর ফলে ভারতীয় বড় ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ থেকে পণ্য নিতে অনীহা প্রকাশ করছে। কেবল ছোট ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্য সরবরাহ করে টিকে আছেন বাংলাদেশী ব্যবসায়ীরা। এ দিকে মাছে ফরমালিন দেয়ার অজুহাতে মাঝখানে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে মাছ আমদানি বন্ধ করে দেয় আগরতলার ব্যবসায়ীরা। যদিও বাংলাদেশী ব্যবসায়ীদের দাবি ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের মাছে ফরমালিন পাওয়া গেছে। কিন্তু আগরতলার ব্যবসায়ীরা মিথ্যা অভিযোগ করে হঠাৎ করে বাংলাদেশ থেকে মাছ আমদানি বন্ধ করে দেয়। পরবর্তীতে কলকাতায় মাছের নমুনা পরীক্ষার শর্তে মাছ নেয়ার ঘোষণা দেয় তারা। তবে আগের চেয়ে অনেক কম পরিমাণে মাছ নিচ্ছে ব্যবসায়ীরা। এছাড়া গার্মেন্টস পণ্য ও মশারির কাপড় রফতানির ক্ষেত্রেও চেন্নাইয়ে পরীক্ষা করার অজুহাত দেখান আগরতলার ব্যবসায়ীরা। আখাউড়া স্থলবন্দরের আমদানি-রফতানিকারক এসোসিয়েশনের উপদেষ্টা হাসিবুল হাসান বলেন, আগে শ্রমিকদের কার্মচাঞ্চল্যে মুখরিত থাকত আখাউড়া স্থলবন্দর। কিন্তু এখন আর শ্রমিকদের মাঝে সেই কর্মচাঞ্চল্যতা নেই। রফতানি বাণিজ্যের হার কমে এসেছে। ছোট ব্যবসায়ীদের কারণে এখনও এ বন্দর দিয়ে আমরা কিছু পণ্য রফতানি করতে পারছি। যে কোন মুহূর্তে রফতানি কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যেতে পারে। আমদানি-রফতানিকারক এসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রাজিব উদ্দিন ভূইয়া বলেন, পাথর রফতানি কমে যাওয়ায় আমরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আগরতলার বড় ব্যবসায়ীরা এখন শিলং থেকে ট্রেনে করে খুব সহজে পাথর নিয়ে আসেন। যে কোন মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে রফতানি কার্যক্রম। বন্দর ও বন্দরের ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে হলে দেশের অন্যান্য বন্দরের মতো এ বন্দর দিয়েও চাহিদা সম্পন্ন পণ্য আমদানির অনুমতি দিতে হবে। আখাউড়া স্থলবন্দরের আমদানি-রফতানিকারক এসোসিয়েশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক রজিব উদ্দিন ভূইয়া বলেন, বন্দরের অবকাঠামো যা রয়েছে তা দিয়ে বন্দরের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম চালানো সম্ভব। তবে আরগরতলায় ব্যবসায়ীরা আগের মতো পণ্য না নেয়ায় রফতানি ২০ শতাংশে নেমে এসেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে অচল হয়ে পড়বে স্থলবন্দর ও ব্যবসায়ীরা। তাই বন্দর ও ব্যবসায়ীদের বাঁচাতে ভারত আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়েও আমাদের চাহিদা সম্পন্ন পণ্য আমদানির সুযোগ দিতে হবে। আমরা যদি আমদানি করতে পারি তাহলে তো সরকারও আমাদের কাছ থেকে রাজস্ব পাবে। বিষয়টি নিয়ে আমরা একাধিকবার সংশ্লিষ্ট দফতরে কথা বলেছি, চিঠি চালাচালিও হয়েছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। তারপরও এনবিআর থেকে আমরা কাক্সিক্ষত অনুমোদন পাচ্ছি না। আখাউড়া স্থলবন্দরের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (পরিদর্শক) আবদুল কাদের জিলানী বলেন, রফতানি কমে যাওয়ায় বন্দরের আয়ও কমে গেছে। গড়ে প্রতিদিন ২০/৩০টি পণ্যবোঝাই ট্রাক আগরতলায় ঢোকে এখন। প্রতিটি ছোট ট্রাক থেকে ১৭৯ টাকা ৪০ পয়সা ও বড় ট্রাক থেকে ২৩৯ টাকা ১৩ পয়সা মাশুল পেয়ে থাকে বন্দর কর্তৃপক্ষ। রফতানি কার্যক্রমের এ অবস্থা চলতে থাকলে স্থবির হয়ে পড়বে বন্দর। আবদুল কাদের জিলানী বলেন, ব্যবসায়ীদের চাহিদা মতো পণ্য আমদানির অনুমতি দেয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরে আমরাও কথা বলেছি চিঠি চালাচালি করেছি। এমনিতেই রফতানি কমে গেছে, ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানি না করতে পারলে বন্দরের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়বে। আশা করছি অচিরেই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে নিষিদ্ধ পণ্য ব্যতীত অন্য সকল পণ্য আমদানির অনুমতি দেয়া হবে। ব্যবসায়ীরা পণ্য আমদানি করতে পারলে সরকারও বিপুল পরিমাণ রাজস্ব পাবে। আখাউড়া স্থলবন্দর সূত্রে জানা গেছে, গত ২০১০ সালের ১৩ অক্টোবর আখাউড়া স্থলবন্দরের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান। এর আগে এটি স্থল শুল্ক স্টেশন ছিল। এ শুল্ক স্টেশনের মাধ্যমেই ভারতে পণ্য আমদানি-রফতানি কার্যক্রম পরিচালিত হতো। তবে পূর্ণাঙ্গ বন্দর ঘোষণার পর রফতানি কার্যক্রম বাড়লেও আমদানি আর বাড়েনি। স্থলবন্দরে একটি আধুনিক ওয়্যার হাউস, পণ্যবোঝাই ট্রাকের ওজন মাপার জন্য ওয়েব্রিজ এবং ট্রাক রাখার জন্য বিশাল ইয়ার্ড রয়েছে। তবে আমদানি কার্যক্রম না থাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে ওয়্যার হাউসটি। রফতানি কমে যাওয়ায় ইয়ার্ডেরও যথাযথ ব্যবহার হচ্ছে না। স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ মুহূর্তে কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের সংস্কার ছাড়া নতুন করে বন্দরের অবকাঠামোগত উন্নয়নের আর কোন প্রয়োজন নেই। তবে বন্দরে সোনালী ব্যাংকের একটি শাখা প্রয়োজন রয়েছে। যে শাখায় ভ্যাটের টাকা জমা দেয়াসহ বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় করতে পারবেন ব্যবসায়ীরা। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় সোনালী ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের কোনো শাখা না থাকায় কুমিল্লা কিংবা ঢাকায় যেতে হয় ব্যবসায়ীদের। এছাড়া বর্তমানে বন্দরের এখন যে অবকাঠামো রয়েছে তাতে করে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম চালানো সম্ভব।
×