মোরসালিন মিজান ॥ ফুটবলের প্রতি বাঙালীর যে ভালবাসা, না, নতুন কিছু নয়। এই প্রেম পুরনো। চিরচেনা। এর পরও ফিফা বিশ্বকাপ শুরু হলে অপার বিস্ময় নিয়ে চারপাশে তাকাতে হয়। বিপুল বিশাল আসরে বাংলাদেশ নেই। তাতে কী? অন্য যে দেশের খেলা ভাললাগে, সে দেশের সমর্থনে নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছে বাঙালী। স্বাগতিক দেশ রাশিয়ায় গিয়ে নিজ নিজ দলের পক্ষে মাঠে নামার কোন সুযোগ নেই। তবে বাকি সবই যেন করে দেখাতে প্রস্তুত সমর্থকগোষ্ঠী।
পছন্দের দলের পতাকা ওড়ানোর মধ্য দিয়ে শুরুটা হয়েছিল। এখনও সারা দেশের প্রতি প্রান্তে ওড়ছে ব্রাজিল কিংবা আর্জেন্টিনার পতাকা। পর্তুগাল জার্মানীসহ অন্য অনেক দেশের পতাকাও চোখে পড়ছে। খেলায় জেতার পর বের করা হচ্ছে আনন্দ মিছিল। মিছিলে বহন করা হচ্ছে দীর্ঘ পতাকা। যানবাহনেও স্বস্ব দলের প্রচার। ব্যক্তিগত গাড়িতে, গণপরিবহনে উড়ছে পতাকা। পতাকার রঙে সাজানো হয়েছে বাড়িঘরও। রাজধানী ঢাকা ও এর আশপাশে এমন একাধিক বাড়ি রয়েছে যেগুলোর খবর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কল্যাণে সারা দুনিয়া জানে। সমর্থকদের গায়েও প্রিয় দলের জার্সি উঠেছে। এসব জার্সি পরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করছেন ফুটবলপ্রেমী শিক্ষার্থীরা। এমনকি বহু সমর্থককে খেলার মাঠের পোশাক পরে অফিস করতে দেখা যাচ্ছে। খেলা চলাকালীন সময় একটু পর পর বাসা বাড়ির ভেতর থেকে উল্লাস ধ্বনি ভেসে আসছে। শোনা যাচ্ছে ‘গোল’ ‘গোল’ চিৎকার। হর্ষধ্বনি।
তবে আলাদা করে বলতে হয় বড় পর্দায় বিশ্বকাপ দেখার কথা। বড় পর্দায় বহু মানুষের সঙ্গে খেলা দেখা। এই দেখার অন্যরকম আনন্দ। শহর ঢাকার অলিতে গলিতে মাঠে উদ্যানে ফাঁকা জায়াগায় সাইটস্ক্রিন স্থাপন করা হয়েছে। সাইটস্ক্রিনের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে খেলা দেখছেন ফুটবলপ্রেমী দর্শক। টিএসসি, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বর, ধানম-ি ৪ নম্বর মাঠ, বরীন্দ্র সরোবর, খিলগাঁও উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, শাহজাহানপুর ঝিল মসজিদ সংলগ্ন খোলা জায়গা, উত্তরার ৪ ও ১২ নম্বর সেক্টরের মাঠ, মগবাজার টিএন্ডটি কলোনি, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার প্রধান ফটকসহ নানা জায়গায় বড় পর্দায় খেলা দেখানো হচ্ছে।
বাংলাদেশের অধিকাংশ সমর্থক আর্জেন্টিনা ও ব্রাজিলের। গত সোমবার ছিল ব্রাজিলের খেলা। দলটির সমর্থক আছে বাংলাদেশের প্রায় সব গ্রামে গঞ্জে। পাড়া মহল্লায়। শহর ঢাকাতেও অসংখ্য নেইমার ভক্ত। তাদের অনেককেই এদিন হলুদ রঙের জার্সি পরে ঘর থেকে বের হতে দেখা যায়। রাত ৮টায় খেলা। অথচ সকাল থেকেই প্রস্তুত ছিলেন সমর্থকরা। খেলা শুরুর আগে আগে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ অনেক সড়ক ফাঁকা হয়ে যায়। তারও আগে বাসায় গিয়ে খেলা দেখার জন্য ছোটাছুটি ছিল লক্ষ্য করার মতো। নকআউট পর্ব বলে কথা, যত বড় দলই হোক না কেন, সামান্য ভুলেই বিশ্বকাপ থেকে ছিটকে পরার আশঙ্কা থাকে। এ কারণে ব্রাজিল-মেক্সিকো ম্যাচ নিয়ে ছিল টানটান উত্তেজনা।
খেলা চলাকালীন সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় প্রবেশ করেতেই চোখ ছানাবড়া। মানুষ আর মানুষ শুধু। খোলা জায়গায় স্থাপন করা বড় পর্দায় চোখ সবার। একটি সাইটস্ক্রিন স্থাপন করা হয় টিএসসিতে। সামান্য দূরে স্বোপার্জিত স্বাধীনতা চত্বরে অন্যটি। দূর থেকে মনে হচ্ছিল বড় কোন তারকা শিল্পীর কনসার্ট চলছে। আসলে তা নয়। ফুটবল। এখানে কথা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আরিফের সঙ্গে। তিনি বলেন, হলের টেলিভিশনে খেলা দেখার ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এখানে এসে দেখার মজা বলে বোঝানো যাবে না। মাঠে বসে খেলা দেখার আনন্দ পাচ্ছি বলতে পারেন।
একই সময় সলিমুল্লাহ হলের বাইরে খোলা জায়গায় খেলা দেখানো হচ্ছিল। সেখানেও তিল ধারনের জায়গা ছিল না। হলের ছাত্ররা মনে হচ্ছিল সবাই নেমে এসেছেন। শহীদ নামের এক শিক্ষার্থী বললেন, আমি জন্মের পর থেকে ব্রাজিলের সমর্থক। এখানে যারা খেলা দেখছেন প্রায় সবাই এই দলের। এখন মনে হচ্ছে ব্রাজিল ছাড়া আর কোন দলের সমর্থক নেই বাংলাদেশে। এই ফিলটা পেতেই বড় পর্দায় খেলা দেখা বলে জানান তিনি।
ইস্টার্ন প্লাজার সামনে একটি বড় টিভি স্ক্রিন লাগানো আছে। স্থায়ী টিভি স্ক্রিনে দেখানো হচ্ছে বিশ্বকাপের প্রতিটি খেলা। সেখানে গিয়ে সত্যি নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছিল না। বড় রাস্তার দুই পাশে শত শত মানুষ। ব্যবসায়ী, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, দোকানের কর্মচারী, রিক্সা চালক কে নেই! যেন বড় রাজনৈতিক দলের সমাবেশ চলছে। আসলে ব্রাজিল- মেক্সিকো ম্যাচ। এই ম্যাচে দুই গোলের জয় পায় নেইমারের দল। আর তার পর গোটা শহর জুড়ে উৎসব। উদ্যাপন। এমন উৎসব উদ্যাপন যে, দেখে মনে হয়েছে এই শহরের মানুষের মতো সুখী আর কেউ নেই। এখন ব্রাজিল সমর্থকদের সামনের পানে চোখ। ফাইনাল পর্যন্ত যেতে পারবে কি? কাপ জেতা হবে ষষ্ঠবারের মতো? আবেগ উত্তেজনা, হ্যাঁ, চরমে।
তবে বেদনায় ভাসিয়েছে আর্জেন্টিনা। বলা হয়ে থাকে, ম্যারাডোনার দেশের সমর্থকই বেশি বাংলাদেশে। সেই ’৮৬ সালের পর আর তারা বিশ্বকাপ জয় করতে পারেনি। এর পরও পাশে থেকেছে বাংলাদেশী সমর্থকরা। এবারও নাওয়া খাওয়া ভুলে প্রিয় দলের সমর্থন দিয়ে যাচ্ছিলেন তারা। কিন্তু মেসিরা নকআউট পর্বে ফ্রান্সের সঙ্গে হেরে বিদায় নেয়ায় আবারও বেদনায় নীল সমর্থকরা। কেউ কেউ খেলা দেখা ছেড়ে দিয়েছেন। গুটিয়ে নিয়েছেন নিজেকে। বাকিদের অনেকেই আবার চির প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের বিপরীতে অবস্থান নিয়েছেন। ব্রাজিলের বিরুদ্ধে যে দলই খেলছে সে দলের সমর্থক হয়ে দুঃখ ভোলার চেষ্টা করছেন তারা!
১৫ জুলাই ফাইনালের মধ্য দিয়ে শেষ হবে ফিফা বিশ্বকাপ ২০১৮। সে পর্যন্ত বাঙালীর এই আবেগ উত্তেজনা বাড়বে বৈ কমবে না। কিন্তু একটা প্রশ্ন থেকেই যায়, নিজ দেশের ফুটবল নিয়ে কবে মাতার সুযোগ পাব আমরা? কোনদিন কি আসবে এমন সুদিন? আহা, যদি আসতো, তবে এই ফুটবলপ্রেম আরও পূর্ণতা পেত। শতগুণ বেড়ে যেত উৎসব আনন্দ। কোনদিন কি আসবে এমন সুদিন?