ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অংশীদারী নির্ভর

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৪ জুলাই ২০১৮

বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক অংশীদারী নির্ভর

২৮ জুন (২০১৮) ডিপ্লোমেটিক করেসপনডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ডিকাব) আয়োজিত অনুষ্ঠানে খুলনা ও গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অনিয়ম ও পুলিশ হয়রানি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত দেশটির রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাট। মার্শা বার্নিকাট বলেছেন, ‘বাংলাদেশ সরকার একটি অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যেই নির্বাচনে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটবে। আমরা দেখতে চাই সরকার তার অঙ্গীকার পূরণ করবে। আগামী জাতীয় নির্বাচনগুলোতে ভোটাররা যাতে নির্বিঘেœ ভোট দিতে পারেন, তার ব্যবস্থা করার আহ্বানও ছিল তাঁর কণ্ঠে। মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা স্টিফেনস ব্লুম বার্নিকাটের এদেশে অবস্থানের মেয়াদ প্রায় শেষের দিকে। ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ১৫তম রাষ্ট্রদূত হিসেবে ড্যান মজিনার স্থলাভিষিক্ত মার্শা বার্নিকাট ২০১৫ সালের ২৬ জানুয়ারি এদেশে আসেন। পেশাদার কূটনীতিক বার্নিকাট বাংলাদেশে আসার আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের মানব সম্পদ বিষয়ক ব্যুরোতে উপ-সহকারী সচিব পদে দায়িত্বে ছিলেন। ২৭ বছরের কূটনৈতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন বার্নিকাট দক্ষিণ এশিয়া নিয়েও কাজ করেছেন। ঢাকায় এসে বার্নিকাট স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে নাক গলাতে তিনি ঢাকায় আসেননি। ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্ক আরও ‘গভীর ও বিস্তৃত’ করতেই তিনি মনোযোগী। তাঁর মতে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে কোন দলেরই পক্ষ নেয় না। বাংলাদেশের সঙ্কটের সমাধান বাংলাদেশকেই করতে হবে। এর আগে বার্নিকাট অনেক ইস্যুতেই বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন। এজন্য তাঁর ওই মন্তব্য আমাদের দেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ফলাফল বলা যেতে পারে। ইতোমধ্যে আরও কিছু সংস্থা ও সংগঠন নির্বাচন মনিটরিং করে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। অর্থাৎ বার্নিকাটের একটি মন্তব্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের চরম অবনতির কোন সম্ভাবনা নেই। বরং তাদের সঙ্গে আমাদের কূটনৈতিক সম্পর্কের পরিসর অনেক বিস্তৃত। ॥ দুই ॥ দেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় চার মাস পর ১৯৭২ সালের ৪ এপ্রিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিতে তৎকালীন মার্কিন সরকারের অভ্যন্তরে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকলেও মার্কিন জনগণ, কংগ্রেস ও সিনেট স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। কূটনৈতিক স্বীকৃতি পাওয়ার পর পরই যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠন ও উন্নয়নের জন্য মার্কিন সাহায্য পেতে শুরু করে। ১৯৭২ সালের মে মাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়, যার অধীনে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ ৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সাহায্য বিভিন্ন পর্যায়ে পেতে শুরু করে। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন। ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও প্রধানমন্ত্রী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে ৪৫ মিনিটের এক মুখোমুখি আলাপ-আলোচনা হয়, যা সরকারী পর্যায়ে প্রথম শীর্ষ বৈঠক হিসেবে মার্কিন-বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত। যদিও ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্ক ভিন্নতর পরিপ্রেক্ষিতে আবির্ভূত হয়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হবার পর পুনরায় আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক নতুন দিগন্তে উপনীত হতে শুরু করে। তাঁর আমলে ২০০০ সালের মার্চ মাসে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটনের বাংলাদেশ সফর ছিল ঐতিহাসিক, যা প্রথমবারের মতো একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফর। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসীন হওয়ার সময় বাংলাদেশে মার্কিন সাহায্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ১১০ মিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালের মার্কিন বাজেটে বাংলাদেশে সাহায্য কর্মসূচী বরাদ্দকরণে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ অগ্রাধিকার কর্মসূচী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে (ইউ এস এইড জাস্টিফিকেশন)। বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্কে অর্থনৈতিক সাহায্যের পাশাপাশি মানবাধিকার ও গণতন্ত্রায়ণের বিষয়টি বেশ জোরালোভাবে প্রাধান্য পায়। দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার অন্যতম প্রধান মিত্র এখন বাংলাদেশ। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক নিরাপত্তা, জঙ্গিবাদ বিরোধী ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রসঙ্গে এ দুই রাষ্ট্র বেশকিছু সহায়তামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। ট্রাম্পের আগে ওবামা প্রশাসনের আন্তর্জাতিক উন্নয়নমূলক পদক্ষেপ, খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য উন্নয়ন এবং পরিবেশ উন্নয়নমূলক বেশকিছু কাজে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান সহযোগী ছিল। ২০১২ সালে দুই রাষ্ট্রের মধ্যে একটি কৌশলগত চুক্তি হয়। বার্নিকাট ২০১৫ সালে এ সম্পর্ককে ‘স্পন্দনশীল, বহুমুখী, এবং অপরিহার্য’ বলে আখ্যায়িত করেন। ২০১৬ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নে কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু করে বাংলাদেশ। আর ওয়াশিংটনের অনুরোধে এরই মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ হিসেবে কসভোকে স্বীকৃতি দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ঘিরে ট্রাম্পের নীতি পরিবর্তন হলেও দক্ষিণ এশিয়া সম্পর্কে মার্কিন অবস্থান পাল্টায়নি। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ২১ কোটি ডলার আর্থিক সহায়তা পেয়েছিল। ট্রাম্পের পররাষ্ট্র দফতর তা কমিয়ে ২০১৮ সালের জন্য বাংলাদেশকে ১৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার আর্থিক সহায়তা দেয়ার প্রস্তাব করেছে। প্রস্তাবিত বাজেটে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সচল রাখার জন্য নতুন করে ৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার বরাদ্দ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এদিকে জঙ্গীবাদ দমনে অ্যান্টি-টেরোরিজম অ্যাসিসট্যান্স হিসেবে বাংলাদেশকে ৩০ লাখ ডলার বরাদ্দের প্রস্তাব করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। ॥ তিন ॥ যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্র ও আমেরিকান জনগণের এবং বাংলাদেশ ও বাংলাদেশী জনগণের কল্যাণ বয়ে এনেছে এবং বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার প্রসার ঘটিয়েছে। ২০১৫ সালে বার্নিকাট বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের সম্পর্ক গতিশীল, বহুমুখী এবং অপরিহার্য। সেই সময় তিনি আরও বলেছিলেন, বাংলাদেশ দৃঢ় গণতন্ত্রের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। দু’দেশের জনগণ কূটনৈতিক সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন নীতি হলো রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের প্রতি গুরুত্বারোপ। ইসলামিক রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে বাংলাদেশকে উদারচেতা হিসেবেই তারা দেখে থাকে। ২০১৮ সালে জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ হওয়ায় বার্নিকাট বাংলাদেশের প্রশংসা করেন। ২০১৬ সালের নবেম্বরে ট্রাম্পের নির্বাচনী বিজয়ের পর বার্নিকাট বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সরকার পরিবর্তন হলেও সম্পর্কের পরিবর্তন হবে না। অর্থাৎ বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির বিরাজমান বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে কোন পরিবর্তন আসেনি। ২০১৮ সালের মার্চ মাসে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নিরাপত্তা উপদেষ্টা লিসা কার্টিস এদেশে এসেছিলেন। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য এবং সহিংসতামুক্ত নির্বাচন দেখতে চায়। তাঁর মতে, বাংলাদেশের স্বার্থেই এমন নির্বাচন হতে হবে। এ বিষয়ে মিয়ানমারের ওপর ওয়াশিংটনের কঠিন চাপ রয়েছে। অর্থাৎ রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সহযোগিতা পাচ্ছে বাংলাদেশ। ২০১৬ সালে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেছিলেন, সাইবার অপরাধ, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ মোকাবেলা, গণতন্ত্র এবং টেকসই উন্নয়নকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ-আমেরিকা একসঙ্গে কাজ করছে। এ চারটি বিষয়েই আমরা ঘনিষ্ঠ মিত্র এবং একসঙ্গে কাজ চলছে। আমেরিকা ও বাংলাদেশ রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক বিষয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। বলা চলে উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক চমৎকার। বার্নিকাটের দেয়া তথ্য থেকে আমরা জানতে পেরেছি, যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭২ সাল থেকে ফিড দ্য ফিউচারের আওতায় বাংলাদেশের খাদ্য নিরাপত্তায় কাজ করে যাচ্ছে। রাষ্ট্রদূত নিজেই এদেশের বর্তমান সরকারের জঙ্গীবাদ সম্পর্কে জিরো টলারেন্স নীতির প্রশংসা করেছেন। ॥ চার ॥ বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা ফোরাম চুক্তি (টিকফা) রয়েছে। বাংলাদেশের বৃহত্তম রফতানি বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগকারী রাষ্ট্রও যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কৌশলগত সামরিক মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ বিশ্বের বৃহত্তম অবদানকারী রাষ্ট্র। বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণের অন্যতম সমর্থক যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পরের বছর বার্নিকাট বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হয়ে এসে মিডিয়ার সামনে বলেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ সম্পর্ক অংশীদারি নির্ভর। এ সম্পর্ক অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে ভাল। তিনি জানেন এ দেশের মানুষ গণতান্ত্রিক উপায়ে শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধানে সক্ষম। বার্নিকাট দেখতে চেয়েছেন, একটি মধ্যম আয়ের বাংলাদেশ, যে দেশ হবে নিরাপদ ও সমৃদ্ধ। আমরা তাঁর সেই প্রত্যাশাকে সাধুবাদ জানাই। লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ এবং পরিচালক, জনসংযোগ, তথ্য ও প্রকাশনা দফতর, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×