ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রস্তাবিত ইসলামী সেন্টার সম্পর্কে ভুল ধারণা দূর করা দরকার

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ৪ জুলাই ২০১৮

প্রস্তাবিত ইসলামী সেন্টার সম্পর্কে ভুল ধারণা দূর করা দরকার

হাসিনা সরকার বাংলাদেশে বিপুল অর্থ ব্যয়ে ইসলামিক সেন্টার নামে পাঁচশোর মতো আধুনিক মসজিদ কমপ্লেক্স তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কথা ছিল সৌদি আরবের অর্থায়নে এই মডার্নাইজড সেন্টারগুলো স্থাপিত হবে। এই অর্থায়ন না হলেও সরকার নিজস্ব অর্থে এটা করবে- এই খবর প্রচারিত হওয়ার পর বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়-এমনকি সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়ের সেক্যুলার ও প্রগতিশীল অংশের মধ্যেও উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রীস্টান ঐক্যপরিষদের লন্ডনে বসবাসকারী কয়েকজন বিশিষ্ট সমর্র্থক সম্প্রতি আমার কাছে এসেছিলেন। তাদের প্রশ্ন, সরকারের এই উদ্যোগে রাষ্ট্রের সেক্যুলার চরিত্র ক্ষুণœ হবে কিনা। মৌলবাদ উৎসাহিত হবে কিনা? তাদের বলেছি আমি যতটা বুঝেছি, ধর্মান্ধতা ও উগ্র মৌলবাদ ঠেকানোর জন্যই সরকার এ উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। বঙ্গবন্ধুর সরকারকে উৎখাতের পর বিএনপি-জামায়াতের দীর্ঘ শাসনামলে ধর্মের নামে যেভাবে ধর্মান্ধতা ও অন্ধ কুসংস্কারকে প্রশ্রয় দেয়া হয়েছে তাতে আমাদের সমাজ ও রাজনীতিতে সেক্যুলার কালচারের বদলে ধর্মান্ধতার কালচার জাঁকিয়ে বসেছে। অধিকাংশ মসজিদ ও মাদ্রাসা জামায়াতীদের কবলে চলে গেছে এবং তাতে ধর্মের নামে ওয়াহাবিজম চর্চা করা হচ্ছে। সন্ত্রাসী ও জঙ্গী তৈরির আড্ডায় পরিণত করা হয়েছে। দেশে কওমি মাদ্রাসা ও খারেজি মাদ্রাসার সংখ্যা এত বেড়েছে যে, তার উপর সরকারের কোন নিয়ন্ত্রণ নেই। তাদের কারিকুলামও অনেকটাই এখনও মধ্যযুগীয়। তাতে আধুনিক শিক্ষিত নাগরিক তৈরির সুযোগ কম। ধর্মান্ধতার শিক্ষা আসল ধর্মীয় শিক্ষাকে স্থানচ্যুত করেছে। দেশ অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হচ্ছে। কিন্তু ধর্মান্ধতার প্রসারের সামাজিক অবক্ষয় চরমে পৌঁছেছে। এর প্রতিকার করতে হলে মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার প্রয়োজন এবং মসজিদগুলো জামায়াত ও মৌলবাদীদের কবল থেকে মুক্ত করা প্রয়োজন। কিন্তু জনজীবনে ধর্মান্ধতার প্রভাব এত ব্যাপক যে সরকারের পক্ষে সহজে কিছু করা সম্ভব নয়। মসজিদ-মাদ্রাসার সংস্কারে হাত দিলেই রব ওঠে ধর্ম গেল, ইসলাম গেল। এই সরকার ইসলামের শত্রু, ধর্মের শত্রু ইত্যাদি ইত্যাদি। তাই হাসিনা সরকার দেশে ধর্মান্ধতার প্রসার ও সামাজিক অবক্ষয় রোধ করার জন্য এই ইসলামিক সেন্টার বা আধুনিক মসজিদ কমপ্লেক্স তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তাতে কট্টর ওয়াহাবিজমের বদলে প্রকৃত ইসলামের চর্চা করা হবে। আধুনিকমনা উদার আলেমরা খতিব ও ইমাম নিযুক্ত হবেন। যদি এই কমপ্লেক্সের মধ্যে মাদ্রাসা যুক্ত থাকে, তাহলে তার কারিকুলাম উন্নত ও যুগোপযোগী করা হবে। এই পদক্ষেপ বরং সেকুলার ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি বিপন্মুক্ত করবে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বন্ধুরা বললেন, তারা আমার সঙ্গে সহমত পোষণ করেন, কিন্তু তাদের ভয় হলো এই মসজিদ কমপ্লেক্সের সঙ্গে লাইব্রেরি, গবেষণাগার যেমন থাকবে, তেমনি মসজিদ থাকবে এবং কালক্রমে মাদ্রাসাও যুক্ত হবে ব্রিটেনে এক সময় সৌদি অর্থে অসংখ্য ইসলামিক সেন্টার গড়ে উঠেছিল। সরকারও তাতে সাহায্য যুগিয়েছেন। ধীরে ধীরে এই সেন্টারগুলোতে মসজিদ মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে এবং দেখা গেল এগুলো আসলে ধর্ম প্রচার ও ধর্ম শিক্ষার নামে জামায়াতের প্রচারণার আখড়া। অনেক বড় বড় মসজিদে সন্ত্রাসী ব্যক্তিরা ইমাম নিযুক্ত হয়েছেন এবং মাদ্রাসা ও স্কুলগুলোতে যা পড়ানো হচ্ছে তা উগ্র ইসলামী শিক্ষা এবং ব্রিটিশ শিক্ষানীতির বিরোধী। ছাত্রী এবং শিক্ষিকাদেরও বোরখা পরায় বাধ্য করা হয়েছে। ব্রিটিশ শিক্ষা কর্তৃপক্ষ এখন এই ধরনের বহু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য হয়েছেন। আমার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বন্ধুদের ধারণা বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পিত এই আধুনিক মসজিদ কমপ্লেক্স মাদ্রাসা নামে না হলেও শিক্ষা কেন্দ্র নামে মাদ্রাসার বিকল্প ধর্মীয় শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। তা হবে উন্নত ও আধুনিক। শিক্ষকেরাও হবেন আধুনিকমনা, উদার আলেম, যতদিন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকবে, ততদিন এই সেন্টারগুলো ঠিকমতো চলবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতা থেকে চলে গেলেই এই সেন্টারগুলো জামায়াত ও উগ্র মৌলবাদীদের দখলে চলে যাবে। তার কার্যক্রম ও পাঠ্যসূচী বদলে যাবে। শিক্ষকেরা চরিত্র বদলাবেন। দেশে ধর্মান্ধতার প্রসার আরও বাড়বে। দেশের গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক ভবিষ্যত বিপন্ন হবে। আমি তাদের শঙ্কাকে উড়িয়ে দেইনি। বলেছি, প্রস্তাবিত ইসলামিক সেন্টারে ইসলামিক শিক্ষা অবশ্যই থাকবে। তাকে মাদ্রাসা বলা হবে কিনা জানি না। তবে মাদ্রাসার বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা ও পাঠ্যক্রম নিশ্চয়ই তাতে সংশোধিত হবে। আমি বর্তমান মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার সমর্থক নই। কিন্তু আমিও প্রথম শিক্ষা শুরু করি মাদ্রাসায়। মাদ্রাসা শিক্ষা শেষ করে হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছি। তাতে আমার একজন প্রগতিমনা মানুষ হতে কোন বাধা হয়নি। এর একটা কারণ, ওল্ড স্কিম মাদ্রাসায় নয়, আমি নিউ স্কিম মাদ্রায় লেখাপড়া করেছি। তারা জিজ্ঞাসা করলেন, এই দুই ধরনের মাদ্রাসার মধ্যে পার্থক্যটা কী? তাদের প্রশ্ন শুনে আমার ধারণা হলো ওল্ড স্কিম ও নিউ স্কিম মাদ্রাসার মধ্যে পার্থক্যটা আগে সকলেই জানতেন, এখন সম্ভবত অনেকেই জানেন না। আমাকে তাই পুরনো ইতিহাস বলতে হলো। ব্রিটিশ রাজ ভারত উপমহাদেশ দখল করার পর দেখতে পেলেন তাদের সাম্রাজ্য পোক্ত করার জন্য ইংরেজী শিক্ষা প্রবর্তন করা দরকার, তখন ধর্মভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল। যেমন মুসলমানদের জন্য মাদ্রাসা শিক্ষা এবং হিন্দুদের জন্য টোল শিক্ষা, নতুন সরকার ইংরেজী শিক্ষা প্রবর্তনের জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা শুরু করেন। হিন্দু সম্প্রদায় এই শিক্ষা সাদরে গ্রহণ করলেও মুসলমানরা দীর্ঘদিন করেনি। তখনকার আলেম সমাজ ফতোয়া দিয়েছিলেন ইংরেজী শিক্ষা হারাম। তখন ইংরেজী শিক্ষার স্কুল প্রতিষ্ঠা অব্যাহত রেখে ব্রিটিশ শাসকেরা মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারে হাত দেন, অর্থাৎ তার কারিকুলাম পরিবর্তনের চেষ্টা করেন, কিস্তু তাতেও গোঁড়া মুসলমানদের কাছ থেকে বাধা আসে। পরবর্তীকালে ইংরেজী শাসকেরা নতুন কৌশল গ্রহণ করেন। তারা প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাগুলোকে ওল্ড স্কিমের মাদ্রাসা আখ্যা দিয়ে নিউ স্কিমের মাদ্রাসা শিক্ষা প্রবর্তন করেন। এই নিউ স্কিমের মাদ্রাসা শিক্ষায় ইংরেজী ও বাংলা ভাষা, সঙ্গে আধুনিক ভুগোল, ইতিহাস ও বিজ্ঞান শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত হয়। আধুনিক স্কুলের সঙ্গে এর পার্থক্য ছিল। এই মাদ্রাসায় আরবী ও দীনিয়ত (ধর্ম শিক্ষা) শিক্ষা দেয়া হতো। গ্রামে যে নিউ স্কিম মাদ্রাসায় আমার লেখাপড়া শুরু, তাতে বাংলা পাঠ্যপুস্তক ছিল কবি গোলাম মোস্তফার ‘আলোক মঞ্জরী’ প্রথম পাঠ তাতে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সঙ্গে মওলানা মোহাম্মদ আলীর জীবনী ছিল। সোহরাব রুস্তমের কাহিনীর সঙ্গে হিন্দু পুরাণের একলব্য এবং অগস্ত মুনীর গল্পও ছিল। অঙ্ক ও প্রাথমিক বিজ্ঞানও ছিল আমাদের পাঠ্য। ব্রিটিশ আমলে ওল্ড স্কিমের বদলে নিউ স্কিম মাদ্রাসার প্রসার বাড়ে এবং ওল্ড স্কিমের মাদ্রাসাগুলো খুবই কোণ্ঠাসা হয়ে পড়ে। কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলাদেশে বা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নিউ স্কিম মাদ্রাসা আর তেমন সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। বিভিন্ন পীর ও তাদের দরগাহের পৃষ্ঠপোষকতায় ওল্ড স্কিমের মাদ্রাসাগুলোর অস্তিত্ব ও প্রভাব টিকে থাকে। দেওবন্দ (ভারত), ফুরফুরা শর্ষিনা (বাংলাদেশ) এই ওল্ডস্ক্রিম মাদ্রাসা শিক্ষার প্রধান ঘাঁটিগুলোরও অন্যতম। একটা বিষয় লক্ষ্য করার মতো, উপমহাদেশে মুসলমানদের মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী রাজনৈতিক চেতনা সৃষ্টি করে ইংরেজী শিক্ষাভিত্তিক আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। ইংরেজী শিক্ষিত তরুণেরাই রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন। মাদ্রাসা শিক্ষিতরা তা পারেননি। সামাজিক নেতৃত্বও ছিল এই ইংরেজী শিক্ষিত তরুণ সমাজের হাতে। এ জন্যে সৌদি আরবের মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্রের দ্বারা প্রচারিত কট্টর ইসলাম বা ওয়াহাবিজম উপমহাদেশেÑ বিশেষ করে বাংলাদেশে শক্ত ঘাঁটি গাড়তে পারেনি। বরং সমন্বয়বাদী ইসলাম বা সুফীজম ইত্যাদির প্রসার বেড়েছে। ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার পর নিউ স্কিম মাদ্রাসাগুলো সরকারের তেমন পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। ওল্ড স্কিম মাদ্রাসাগুলোই মাদ্রাসা বলে বিবেচিত হয়েছে এবং বেশি সরকারী পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। এই ওল্ড স্কিম মাদ্রাসাগুলোতেও শিক্ষাসূচীর কিছু সংস্কার হয়, পরিবর্তন হয়; কিন্তু তাতে সামাজিক নেতৃত্ব থেকে ইংরেজী শিক্ষিতদের হটানো যায়নি। বরং ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্র মাত্র চব্বিশ বছরের মধ্যে ভেঙে যায় এবং স্বাধীন, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। এটা সৌদি আরবে ওয়াহাবিজমের পৃষ্ঠপোষকদের টনক নড়িয়ে দেয়। উপমহাদেশে ওয়াহাবিজম প্রতিষ্ঠার জন্য তারা দু’হাতে পেট্রো-ডলার ঢেলে জামায়াত এবং তার যে শাখা দলগুলো প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাদের রাজনৈতিক ব্যর্থতা থেকে তারা বুঝতে পারেন, ইংরেজী শিক্ষিতদের হাত থেকে সামাজিক নেতৃত্ব কেড়ে নিতে না পারলে উপমহাদেশেÑ বিশেষ করে বাংলাদেশে ওয়াহাবিজম প্রতিষ্ঠার সুযোগ নেই। ধর্মরাষ্ট্রের কাঠামো ভেঙ্গে সেক্যুলার বাংলাদেশের অভ্যুদয় তাই সম্ভব হয়েছে। সৌদি সামন্ত স্বার্থের এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থের এখানেই যোগ ঘটে। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা হিংস্র পলিটিকাল ইসলামের জন্ম দেয়। সৌদি আরব বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ ঘটিয়ে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় ইংরেজী শিক্ষিতদের আধিপত্য ঘুচিয়ে মাদ্রাসা শিক্ষিতদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী রাতারাতি হাজার হাজার মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। তাতে অজস্র টাকা ঢালা হয়। মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থা চলে যায় সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ব্যাঙের ছাতার মতো ধর্মীয় শিক্ষার নামে নানা ধরনের মাদ্রাসা গড়ে ওঠে, কওমি মাদ্রাসা খারেজি মাদ্রাসা ইত্যাদি। টাকা যোগাতে থাকে সৌদি আরব ও তাদের মিত্র দেশগুলো। পাকিস্তান আমলেই স্কুলের চাইতে মাদ্রাসা শিক্ষায় সরকারী অনুদান বাড়তে থাকে। তার দুর্ভোগ স্বাধীন বাংলাদেশেও পোহাতে হচ্ছে। এখন বাংলাদেশে স্কুলের চাইতে মাদ্রাসার সংখ্যা অনেক বেশি। এই মাদ্রাসা শিক্ষার জন্য সরকারী অনুদানও বেশি। ধর্ম শিক্ষায় সহায়তার নামে জামায়াত দেশের অধিকাংশ মাদ্রাসা ও মসজিদগুলোতে একাধিপত্য বিস্তার করেছে। ধর্মশিক্ষার নামে দেয়া হচ্ছে ধর্মান্ধতা শিক্ষা। অনেক মাদ্রাসায় বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া, জাতীয় পতাকা তোলা নিষিদ্ধ। এগুলোকে করে তোলা হয়েছে ধর্মান্ধ হিংস্র রাজনীতির ক্যাডার তৈরির আখড়া। হাসিনা সরকারের সাম্প্রতিক সন্ত্রাস দমনের অভিযানের সময় দেখা গেছে, শুধু মাদ্রাসা নয়, অনেক মসজিদ ও জামায়াতও তাদের দোসর জঙ্গীবাদীদের আড্ডা। ধর্মপ্রচার ও ধর্মীয় শিক্ষাদানের আড়ালে চলেছিল হিংস্র ধর্মীয় রাজনীতির তৎপরতা, সন্ত্রাসের ক্যাডার তৈরি করা। ওয়াহাবিদের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাংলাদেশে এখন অনেকটাই সফল হয়েছে। দেশটিতে আর্থ সামাজিক জীবন, রাজনীতি থেকে সেক্যুলার গণতান্ত্রিক কালচার এখন বহুলাংশে দূরীভূত এবং ধর্মান্ধতার কালচার তাকে গ্রাস করেছে। ডান বাম সকল রাজনীতিই এখন এই কালচার দ্বারা প্রভাবিত। হাসিনা সরকারের মধ্যপন্থা এই ধর্মান্ধতার কালচারের প্লাবন কোন রকমে ঠেকিয়ে রেখেছে। কিন্তু শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন এবং আবার একটি ধর্মান্ধতামুক্ত আধুনিক তরুণ সমাজ গড়ে তোলা ছাড়া এই প্লাবন ঠেকানোর উপায় নেই। এই শিক্ষা সংস্কারের জন্য প্রথমে দরকার জামায়াত ও মৌলবাদীদের কবল থেকে মাদ্রাসা ও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থাকে মুক্ত করা। মাদ্রাসার পাঠ্যসূচীর আধুনিকায়ন। হাসিনা সরকার সেই সংস্কার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। অমনি চারদিক থেকে রব তোলা হয়েছে ধর্ম গেল, ইসলাম গেল। অথচ শিক্ষা সংস্কারের সঙ্গে ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই। শিক্ষা সংস্কার আর ধর্মীয় শিক্ষার উচ্ছেদ এক কথা নয়। হাসিনা সরকারের মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের উদ্যোগকে মাদ্রাসা শিক্ষা উচ্ছেদ বলে অপপ্রচার চালানো হয়েছে। জনগণকে বিভ্রান্ত করা হয়েছে। কাদের সিদ্দিকীর মতো মুক্তিযুদ্ধের এক সৈনিক পর্যন্ত বলেছেন, হাসিনা মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের নামে তার উচ্ছেদ ঘটাতে চান। তিনি জামায়াতী প্রচারণায় কণ্ঠ মিলিয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর আমলেও যখন দেশে একই ধরনের শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন এবং ধর্মশিক্ষাকে ওই শিক্ষার অন্তর্গত করার প্রস্তাব উঠেছিল, তখন অসাম্প্রদায়িকতামনা অধ্যাপক আবুল ফজলও তার বিরোধিতা করেছেন। মাদ্রাসা শিক্ষাকে জামায়াতসহ উগ্র মৌলবাদীদের কবলমুক্ত করা সম্ভব নয় এবং সহজও নয়। কিন্তু তা করা না গেলে দেশকে ভয়াবহ মৌলবাদী উত্থানের আশঙ্কা থেকে মুক্ত করা ও মুক্ত রাখা সম্ভব নয়। হাসিনা সরকার তাই অত্যন্ত দূরদর্শিতার সঙ্গে কয়েক শ’ নতুন ইসলামিক সেন্টার স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এটা অতীতের ব্রিটিশ রাজের নিউ স্কিম মাদ্রাসা শিক্ষা প্রবর্তনের মতো কৌশল। এই সেন্টারে আধুনিকমনা আলেমরাই শিক্ষক হিসেবে নিযুক্ত হবেন। পাঠ্যসূচীতেও থাকবে আধুনিক প্রযুক্তি, বিজ্ঞান ও ধর্মীয় শিক্ষার সংমিশ্রণ। ব্রিটিশ আমলের নিউ স্কিম মাদ্রাসার মতো এই প্রতিষ্ঠানগুলোও শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের বেশি আকৃষ্ট করবে এবং দেশে মৌলবাদীদের অশুভ আধিপত্য ঠেকাবে। এই সেন্টার থাকবে সম্পূর্ণভাবে সরকারী নিয়ন্ত্রণে। তা সমাজে কুফল বয়ে আনবে না। বরং সুফলই বয়ে আনবে। কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়। মাদ্রাসা শিক্ষার নামে দেশে বর্তমানে যে অপশিক্ষার আধিপত্য চলছে তাকে ঠেকাতে হলে মাদ্রাসা শিক্ষা সংস্কারের কোন বিকল্প নেই। আমার এই কথাগুলো আমার বন্ধু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বোঝাতে পেরেছি কিনা জানি না। তারা আমার কোন কথায় প্রতিবাদ করেননি। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে ধর্মান্ধ অপশক্তি আবার এই মাদ্রাসাগুলোকে দখল করে তাদের শক্তি আরও বাড়বে। আমি বলেছি, এই আশঙ্কা তো গোটা দেশের জন্যই প্রযোজ্য। আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে গোটা দেশই হাফ তালেবানদের খপ্পরে পড়ে যেতে পারে। লন্ডন, ২ জুলাই, সোমবার, ২০১৮
×