ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দুলাল আচার্য

নিয়ামত ভাই চলে গেলেন

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ৪ জুলাই ২০১৮

নিয়ামত ভাই চলে গেলেন

আমাদের নিয়ামত ভাই চলে গেলেন না ফেরার দেশে। যে মৃত্যুকে তিনি ভয় পেতেন, অবশেষে সেই মৃত্যুর কাছেই হার মানলেন। নানা জটিল রোগে ভুগতেন, কিন্তু কাউকে বুঝতে দিতেন না। চলনে-বলনে ছিলেন অনেকটা স্বাভাবিক। অসুস্থতা নিয়ে ঈদের পরও অফিস করেছেন। রবিবার বিকেলে নিজ বাসভবনে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর মৃত্যুতে সাংবাদিক মহল শোকবিহ্বল। তাঁর সুদীর্ঘ কর্মময় জীবন সবটুকু দেখিনি, তাই মূল্যায়ন করার মতো সঠিক বা যোগ্য লোক আমি নই। হয়ত তাঁকে নিয়ে তার প্রিয় বন্ধু এবং আপনজনরা লিখবেন। তবে আমার কাছে তিনি ছিলেন একজন পিতার সমতুল্য অভিভাবকের প্রতীক। ‘আপনি’ সম্বোধন ছাড়া কাউকে ডাকতেন না। আমার ১১ বছরের সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা নিয়ে জনকণ্ঠে যোগদান এবং জনকণ্ঠে তাঁর অধীনে কাজ করাÑ বলা যায়, আমার সাংবাদিক জীবনের একটা পূর্ণতা আসে নিয়ামত ভাইয়ের সাহচর্যের মাধ্যমেই। সময়টা ২০০৯ সালের মার্চ মাস। জনকণ্ঠের সস্পাদকীয় বিভাগে যোগদানের পর নিয়ামত ভাইয়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেন শ্রদ্ধেয় স্বদেশ রায়। সম্পাদকীয় বিভাগের কাজের সূত্রে নিয়ামত ভাইয়ের সঙ্গে আমাকে প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটা সময় দিতে হতো। প্রথম দিনই উপলব্ধি করি তিনি একজন সজ্জন মানুষ, মজার মানুষ। সহজ সরল নিভৃতচারী মানুষ বলতে যা বোঝায়, তিনি ছিলেন আক্ষরিক অর্থে তেমনই একজন। নিয়ামত ভাই ছিলেন জীবনবাদী, প্রগতিশীল ও মনেপ্রাণে আধুনিক মানুষ। মেধাবী, বিনয়ী, প-িত নানা অভিধায় তাঁকে অভিহিত করা যায়। টলস্টয় থেকে রবীন্দ্রনাথ, হুগো থেকে নজরুল, মার্কস থেকে লেনিন, ম্যাক্সিম গোর্কি থেকে শংকর, মিল্টন থেকে জীবনানন্দ সবই ছিল তাঁর আত্মস্থ। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের সবই নখদর্পণে ছিল তাঁর। তাদের কোন্ বইয়ের কোন্ পৃষ্ঠায় কোন্ লাইনে কি আছে তা অবলীলায় বলতে পারতেন। এই স্মৃতিশক্তি জীবনের শেষ দিনগুলোতেও লক্ষ্য করেছি। বাংলা ইংরেজী ডিকশনারি তাঁর মুখস্থই ছিল বলা যায়। দেশের খ্যাতনামা ছড়াকার, লেখক, অনুবাদকদের তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। কাজ করেছেন সোভিয়েত দূতাবাসে। একাত্তরের মার্চ মাসে সেখানে আটকা পড়েছিলেন। কাজ করেছেন দৈনিক রূপালীসহ বহু পত্রিকায়। সর্বশেষ জনকণ্ঠে সম্পাদকীয় বিভাগের প্রধান হিসেবে। বর্তমান প্রজন্মের অনেক লেখক-সাংবাদিকই হয়ত তাঁর নাম জানেন না! কত মধুর ভালবাসা-স্নেহ তাঁর কাছ থেকে আমরা সহকর্মীরা পেয়েছি, তা বলে শেষ যাবে না। যে কোন লেখা নির্ভুল করার ব্যাপারে তাঁর প্রচেষ্টা আমি অন্য কারও মাঝে লক্ষ্য করিনি। প্যারোডি কবিতার কারণে সাহিত্যাঙ্গনে নিয়ামত ভাইয়ের একটা আলাদা পরিচয় ছিল। তিনি রবীন্দ্রনাথ, নজরুল ইসলামসহ বহু বিখ্যাত লেখকের জনপ্রিয় কবিতা নিয়ে প্যারোডি করেছেন। এসব প্যারোডি সাপ্তাহিক বিচিত্রাসহ দেশের বিভিন্ন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। তেমনি একটি কবিতা এখানে তুলে ধরছিÑ মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে যুগ যুগ ধরে আমি বাঁচিবারে চাই সুন্দর বিল্ডিং আর পুষ্পিত কাননে যদি হুরপরি আর ব্যাংক ব্যালান্স পাই... শহরে বাসেতে চলা চির তরঙ্গিত ইচ্ছা হয়, করে ফেলি ক্যাডিলাক ক্রয় সুখের পায়রার মতো গাহিয়া সঙ্গীত নব্য লাটের মতো মাতাই আলয়। তা যদি না পারি তবে বাঁচি যত কাল তোমাদের মধ্যিখানে লভি যেন ঠাঁই তোমাদের শিরোপরি ভাঙিয়া কাঁঠাল মজাসে আরাম করে একা একা খাই। ইহাতে কাহারও যদি মাথা ফাটে হায় মেডিক্যালে গিয়ে তাহা করিয়ো সেলাই। ভারতের বসিরহাটে জন্ম নেয়া নিয়ামত ভাইয়ের প্রথম কর্মস্থল রাশিয়ান দূতাবাস হলেও বাংলাদেশের প্রতি তার প্রাণ ফুটে ওঠে তার কবিতা ও কর্মকান্ডে। দেশপ্রেম আর অসাম্প্রদায়িক চেতনা তাঁর লেখার উপজীব্য ছিল। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ছিল তার অনন্য অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের সময় লেখা তার কবিতা স্টেটসম্যান, নিউজ উইক পত্রিকায় অনূদিত হয়। তিনিই দেশের প্রথম কোন কবি, মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে যার কোন কবিতা সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। নিভৃতচারী নিয়ামত ভাই আত্মপ্রচারে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই এসব বিষয় সবার কাছে শেয়ার করতেন না। ব্যক্তিগতভাবে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল রনেশ দাশগুপ্ত, সত্যেন সেন, সন্তোষ গুপ্ত, জহুর হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ তোহা খান, কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ, বজলুর রহমানসহ সমসাময়িক প্রগতিশীল শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে। খেলাঘরের হয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন স্বাধীনতার পর পর। খেলাঘরের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন নিয়ামত ভাই। সম্পৃক্ত ছিলেন উদীচীর সঙ্গেও। মৃত্যুকে ভয় পেতেন নিয়ামত ভাই। তাই নিজের বয়স কত তা বলতে চাইতেন না। বয়স প্রসঙ্গ এলেই প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতেন। একদিন জনকণ্ঠ সম্পাদক ও প্রকাশক আতিকউল্লাহ খান মাসুদ সাহেবের জন্মদিনে সম্পাদকীয় বিভাগের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা জানাতে গেলে, সম্পাদক প্রশ্ন করেছিলেনÑ ‘নিয়ামত সাহেব আপনার বয়স কত?‘ নিয়ামত ভাইয়ের সাদাসিধে জবাব ছিলÑ ‘বয়স গুণি না, ভয় করে।’ যিনি মৃত্যুকে এত ভয় করতেন সেই মৃত্যুকেই এত সহজে আলিঙ্গন করলেন তিনি। আসলে মৃত্যুর কাছে পরাজয় স্বীকার করা ছাড়া মানুষের ভিন্ন কোন উপায় নেই। তারপরও বলতে হয়, নিয়ামত ভাই এভাবে চলে গেলেন কেন? কিছু কিছু মৃত্যু পৃথিবীতে বড় বেশি ছাপ ফেলে। কাছের-দূরের মানুষের কাছে দাগ রেখে যায়। নিয়ামত ভাইয়ের মৃত্যুও আমার কাছে তেমন। এ কথা সত্য যে, নিয়ামত ভাই আমাদের মাঝে নেই। চলে গেছেন শূন্যতার ওপারে। তবে তিনি কাজ দিয়ে আমাদের যা শিখিয়েছেন তা আমরা নতুন প্রজন্মের সাংবাদিকরা কখনই ভুলব না। অন্যায়কে অন্যায়, অসত্যকে অসত্য বলার দৃঢ় সাহস আমরা তাঁর কাছেই শিখেছি। নিয়ামত ভাই আপনি যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন। লেখক : সাংবাদিক
×