ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পারিবারিক রাজনীতির উত্তরসূরি এবং পরিবর্তিত নেতৃত্ব

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ৪ জুলাই ২০১৮

পারিবারিক রাজনীতির উত্তরসূরি এবং পরিবর্তিত নেতৃত্ব

নতুন শক্তিতে জাগছে তারুণ্য কিন্তু পরিবর্তনের মন্ত্র নিয়ে হাজির নেই কোন মহান নেতা। বিক্ষুব্ধ উচ্ছৃঙ্খল সন্ত্রাসী ইত্যাদি অভিধায় আখ্যায়িত হয়ে পথ হাতড়াচ্ছে তারুণ্যের সম্ভাবনা। ব্যক্তিকে শুদ্ধ করে সমাজে শৃঙ্খলা ফেরাতে চেয়েছিলেন যারা, যারা বলেছিলেন আগে আদর্শ মানুষ হবে তারপর আদর্শ সমাজ, তারা ইউটোপীয় হিসেবেই সমাজ-ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছেন। একজন একজন করে ব্যক্তিসুদ্ধি করা যায় না। প্রয়োজন বলিষ্ঠ মতাদর্শ এবং নেতৃত্ব। গত শতকে সমাজ বদলের আন্দোলনে অনেক শক্তিশালী নেতৃত্ব পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছিল। তখন তরুণদের সামনে মতাদর্শভিত্তিক পথপ্রদর্শক ছিল। পরিপূর্ণ জীবনবোধ নিয়ে বেড়ে ওঠার সুযোগ ছিল। বিরোধিতার জায়গা ছিল। সুনির্দিষ্ট প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে লড়ার সুযোগ ছিল। আজকের তারুণ্যের সামনে ওরকম জীবনদর্শন বা আদর্শ নেই বললেই চলে। অমিত সম্ভাবনা নিয়ে তারুণ্যের লিডারশিপ অথবা হিরোর অভাবে ভোগা নিয়ে ইন্ডিয়া টুডে দক্ষিণ এশীয় রাজনীতিতে তরুণ নেতৃত্বের উজ্জ্বল সম্ভাবনার খবর দিয়েছিল বেশ ক’বছর আগে। এ অঞ্চলের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিশোধনের কথা বলেছিল। বাংলাদেশ ভারত পাকিস্তান শ্রীলঙ্কা নেপাল এ পাঁচ দেশের পারিবারিক রাজনীতির সর্বশেষ প্রজন্মের প্রতিনিধিদের মূল্যায়ন করে ইন্ডিয়া টুডের এ প্রতিবেদন। এতে ভবিষ্যত প্রজন্মের সম্ভাব্য রাজনৈতিক নেতার তালিকায় ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ছেলে তারেক রহমান, ভারতের প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর ছেলে রাহুল গান্ধী, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টোর ছেলে বিলওয়াল ভুট্টো জারদারি, নেপালের মাওবাদী নেতা ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী পুষ্পকমল দাহাল প্রচ-র ছেলে প্রকাশ দাহাল, শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছেলে নামাল রাজা পাকশে ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী রানাসিঙ্গে প্রেমাদাসার ছেলে সুজিত প্রেমাদাসা। এরা সবাই উপমহাদেশে পারিবারিক রাজনৈতিক ধারার উত্তরসূরি। পত্রিকাটি বলেছে, নিছক ক্ষমতা বদল নয় এরা এলে এ অঞ্চলে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলে যাবে। এদের মধ্যে সক্রিয় রাজনীতিতে আছেন রাহুল গান্ধী। তাকে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে অনুকরণীয় আইকন বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সিএনএন, আইবিএন ও সিএনবিসিটিভি-১৮-এর জরিপ জানায়, আগামী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতের মানুষ রাহুলকে দেখতে চায়। জরিপে অংশ নেয়া শতকরা প্রায় চৌত্রিশ ভাগ মানুষ তাকে এখনই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চায়। মতিলাল নেহেরুর উত্তরাধিকার হিসেবে পরিবারের পঞ্চম প্রজন্ম রাহুল মা সোনিয়া গান্ধীর মতোই স্থির শান্ত। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তাড়াহুড়া নেই। সজীব ওয়াজেদ জয় এখনও রাজনীতিতে সক্রিয় নন। তবে মায়ের উপদেষ্টা হিসেবে নেপথ্যে থেকে বিভিন্ন ভাবে দেশীয় রাজনীতিতে আধুনিক মাত্রা সংযোজন করছেন। তারেক রহমানের নাম এসেছে নেতিবাচক উদাহরণ হিসেবে। বলেছে, ক্ষমতার প্রতি লোলুপ দৃষ্টি অনেকটাই তার বাবা জিয়াউর রহমানের মতো। প্রধানমন্ত্রী বেনজীর ভুট্টো নিহত হওয়ার পর পাকিস্তান পিপলস পার্টির সভাপতি মনোনীত হন তার ছেলে বিলওয়াল ভুট্টো। বেনজীর ভুট্টো তার উইলে দলের সভাপতি হিসেবে স্বামী আসিফ আলী জারদারিকে মনোনীত করে গেলেও জারদারি ছেলের নাম প্রস্তাব করেন এবং তা গৃহীত হয়। বিলওয়াল পড়াশোনা শেষ করে সক্রিয় রাজনীতিতে যোগ দেবেন, এমনই বলেছিলেন বাবা আসিফ আলী জারদারি। সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত আছেন নেপালের পুষ্পকমল দাহালের ছেলে প্রকাশ দাহাল। ‘স্মল পি’ নামে পরিচিত প্রকাশ নেপালের রাজনীতিতে বেশ আলোচিত। নামাল রাজাপাকশে ও সুজিত প্রেমাদাসাও নিজ নিজ দেশে সম্ভাবনাময় ভবিষ্যত রাজনৈতিক নেতা। ইন্ডিয়া টুডে বলেছে, নিছক ক্ষমতার সঙ্কীর্ণতায় আবদ্ধ না থেকে রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাতে আসছেন এই তরুণরা। কিন্তু এমন কি হতে পারে পুরো পৃথিবীর রাজনৈতিক সংস্কৃতি বদলাতে তারুণ্য জেগে উঠছে? এক ঐক্যবদ্ধ সংস্কৃতি লালন করে পৃথিবী এগোচ্ছে নতুন রাজনৈতিক ভূমিকার দিকে? প্রেক্ষাপট ভিন্ন হলেও তারুণ্য ফুঁসছে বিভিন্ন দেশে। কোন এক বঞ্চনা থেকে ক্ষোভে ফেটে পড়ছে যেন। সেই বঞ্চনা ও ক্ষোভের স্বরূপ হয়ত জানে না তারা। বছর তিনেক আগে লন্ডনের এক ঘটনায় কিশোরদের লুটপাটের দৃশ্য, বিশেষ করে মদের বোতল নিয়ে লোলুপ দৌড়ানো দেখে মনে হয়েছিল অনেক দিনের অবরোধ থেকে যেন মুক্তি মিলেছে তাদের। সোভিয়েত ইউনিয়ন হলে এ ঘটনার যুৎসই ব্যাখ্যা খুঁজে পেত পুঁজিবাদী মিডিয়া। আফ্রিকা বা এশিয়ার নিরন্ন দেশে হলেও অনেক স্বাভাবিকভাবে মানা যেত। লন্ডনের মতো শহরে এ ধরনের ঘটনার সূত্রায়ন সত্যিই মুশকিল। রাজনৈতিক অর্থনৈতিক পোলারাইজেশনের দীর্ঘায়নে সমাজের ভেতরে এমন কিছু উপাদান জমা হয়েছে হয়ত যা নীরবে ভাঙছে সবকিছু। ভাঙ্গন বা বদলটা হুট করে চোখে পড়ে না। বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ যারা করেন তারা বলেন, পুরনো সমাজ থেকে নতুন সমাজ মৌলিকভাবে পৃথক। তবে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার কারণে পূর্বতন সমাজের সঙ্গে নতুন সমাজটি সম্পর্কিত থাকে। একই সময়ে এ দুটি পরস্পর পৃথক আবার পরস্পর সংযুক্ত। পুরনো সমাজ ভেঙ্গেই নতুন সমাজ গড়ে ওঠে বলে এই দুইয়ের মধ্যে পার্থক্য থাকার ব্যাপারটা সচরাচর বেশি গুরুত্ব পায়। উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের বিষয়টি প্রায়ই উপেক্ষিত হয়। নতুন সমাজের ভ্রƒণটি জন্ম নেয় পুরনো সমাজের গর্ভে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ভ্রƒণটি বিকশিত হয়ে পূর্ণাঙ্গ শিশুতে পরিণত হওয়ার সঙ্গে জননীর মৃত্যু সরাসরি সম্পর্কিত। মানুষের জন্ম ও বৃদ্ধির সঙ্গে সমাজের জন্ম ও বিকাশের বেশ অমিল রয়েছে। সমাজ ব্যবস্থার মৃত্যুর সঙ্গেও মানুষের মৃত্যুর পুরোপুরি তুলনা চলে না। কোন ব্যক্তি মারা গেলে মৃতদেহটি দ্রুত কবরস্থ করা, মাটির নিচে একেবারে পুঁতে ফেলা কিংবা চিতার আগুনে ভস্মীভূত করা সম্ভব। কিন্তু কোন সমাজ ব্যবস্থার মৃত্যু ঘটলে তেমনটি করা সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে মৃত সমাজদেহটি আমাদের সকলের মাঝখানে উন্মুক্ত থাকে এবং ধীরে ধীরে পচতে থাকে। সেই পচা-গলা সমাজদেহটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবার পূর্ব পর্যন্ত আবহাওয়াকে দূষিত করে এবং প্রতিনিয়ত আমাদের অর্থাৎ নতুন সমাজ ব্যবস্থার সব কিছুকে সংক্রমিত ও রোগাক্রান্ত করে।... নতুন সমাজ সাবালক হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত এ সমাজের সর্বত্র পূর্বতন সমাজের ছাপ দেখতে পাওয়া যায়। এ ছাপ বজায় থাকে অর্থনৈতিক, নৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিগত সমস্ত দিক থেকেই। আর বজায় থাকে মুমূর্ষু পুরনো সমাজ আর বর্ধিষ্ণু নতুন সমাজের মধ্যে মরণপণ সংগ্রাম। এমন কোন পরিবর্তিত সময় কি অতিক্রম করছি আমরা? যদি তাই হয় তাহলে ইন্ডিয়া টুডে তরুণ নেতৃত্বের যে সংবাদ দিয়েছে তার ইতিবাচকতা নির্ভর করবে সময়কে সঠিকভাবে ধরতে পারার ওপর। উপমহাদেশের পারিবারিক রাজনীতির ধারার সবশেষ যে উত্তরাধিকারীদের তালিকা পত্রিকাটি করেছিল তাদের কেউ কেউ আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় উচ্চ শিক্ষিত। আধুনিক জীবন ধারায় নির্মিত মানুষ। কিন্তু তাদের পরিচয় পারিবারিক উত্তরাধিকারে ভর করে এবং অপরিবর্তিত বিশ্ব অর্থনৈতিক পটভূমিতে। সময় ও সমাজ যদি ভেতরে ভেতরে সত্যিই বদলায় তাহলে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও এ তরুণরা কতখানি এগোতে পারবেন সে প্রশ্ন থেকে যায়। সে অর্থে নেতা বা হিরো, যার ডাকে এক হবে মানুষ, নির্ভরযোগ্য জীবনদর্শন নিয়ে এগোবেÑ সে রকম হিরোর শূন্যস্থান পূরণ হবে কি?
×