ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হার না মানা এলেক্স ম্যাকানিজ

প্রকাশিত: ০৬:৩৮, ৩ জুলাই ২০১৮

হার না মানা এলেক্স ম্যাকানিজ

এলেক্স ম্যাকানিজ, বাংলাদেশী বিস্ময় তরুণ। বিস্ময় বলার কারণ, ক্যারিয়ারের নানা চক্রবাকে কখনও কাজ করেছেন দেশীয় মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে। শিক্ষাগ্রহণ করেছেন গুরু কিশোর নামিত কাপুর ও মিরা নায়ারের কাছে। পড়েছেন নিউইয়র্ক ফিল্ম সোসাইটিতে। কাজ করেছেন রাগীনি, এমএমএস২ কিংবা কুইন্স ছবির টিমে। বলিউড ছেড়ে দেশে ফিরে নিজেই বর্তমানে ব্র্যান্ড প্রমোশনে দেশের সেরাদের একজন। আজকের সাক্ষাতকারে উঠে আসবে আরও বিস্তারিত। সাক্ষাতকার নিয়েছেনÑ বেনজির আবরার ডিপ্রজন্ম : এলেক্স ম্যাকান্জি, স্বাগতম। আপনার ছোটবেলার গল্প বলুন। এলেক্স ম্যাকান্জি : আমাদের একটি সুন্দর পরিবার ছিল। বাবা ব্যবসা করতেন, মা সিটি ব্যাংকে কর্মরত ছিলেন। আমরা দুই ভাই। পড়ছিলাম গ্রীন হেরাল্ডে, এরমধ্যেই বাবা-মায়ের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। আমাদের জন্য জীবনটা অনেক কঠিন হয়ে যায়, মাঝে বাবার ব্যবসায়ে ধস নেমে আসে। সবকিছু মিলিয়ে আমি আমার কাছের বন্ধুদের থেকেও অবহেলা পেতে শুরু করি। অবস্থাটা এমন গিয়ে ঠেকলো, বাবা আমাকে প্রতিদিন হাতখরচ হিসেবে যে দশটাকা দিতেন সেটা আমি জমিয়ে ছোটভাইর জন্য গরুর মাংস কিনতাম। ওর খুব পছন্দের খাবার এটা। ৮ম শ্রেণী শেষে গ্রীন হেরাল্ড স্কুল পর্ব শেষ হয় আমার, এরপর সরাসরি ব্রিটিশ কাউন্সিলের অধীনে ও লেভেল দেই। এরপর কোচিং পর্ব, তখন দেশে সাইবার ক্যাফেতে ঘণ্টাপ্রতি ২০ টাকা করে লাগত। আমি ২০০১ এর দিকে এমন একটা সাইবার ক্যাফেতে বসে দেখি একটা ব্রাউজার ওপেন, কেউ হয়ত ওপেন করে চলে গেছে। নাম ‘অষঃবৎসবঃধষ.পড়স’। আমি বের না হয়ে দেখিÑ কত সার্কুলার। কারও সিঙ্গার দরকার, কারো গিটারিস্ট, কারও তবলাবাদক। আমার কাছে এটা তো এক ভিন্ন জগৎয়ের সঙ্গে পরিচয়। আমি নিজে অনেক কষ্ট করে গান শিখে ২০০১ য়ে অল কমিউনিটি ক্লাবে শো করি প্রথম। ডিপ্রজন্ম : আপনি এরপর ব্যান্ডের গানের দলের সঙ্গে যুক্ত হন, ট্র্যাক তো ঠিক ছিল। ভারত যাবার পরিকল্পনা কীভাবে আসল? এলেক্স ম্যাকান্জি : সে তো এক বিরাট ঘটনা। একদিন টিভিতে কিশোর নামিত কাপুরের শো দেখে ভাবলাম, আমি ক্যামেরা, প্রযোজনা সম্পর্কে জানব যে কোনভাবে। জানতে হলে আমাকে কিশোর স্যারকে ধরতে হবে। যেই ভাবা, সেই কাজ। চলে গেলাম ভারত, বলতে পারেন ৩৫ বার কল দেই স্যারকে। ৩৬তমবার আমাকে তিনি বলেন, ‘তুমি আস ভারত, তোমার পক্ষেই পরিচালক হওয়া সম্ভব। আমি তোমাকে গাইড করব।’ এরপর কিশোর নামিত কাপুরের ফিল্ম ইনস্টিটিউটে আমার সহপাঠী ছিল আয়েশা ছবির পরিচালক রিয়া কাপুর, জনপ্রিয় নায়ক গোবিন্দর মেয়েসহ এখনকার বলিউডের অনেক পরিচিত নাম। সেখান থেকে কিশোর নামিত কাপুর স্যারের পরামর্শমতো চলে যাই নিউইয়র্ক ফিল্ম একাডেমিতে, সেখানে হলিউডের মুভি নেইমসেইক, ভ্যানিটি ফেয়ার, এ্যামেলিয়ার মতো জনপ্রিয় ছবির পরিচালক মিরা নায়ারের কাছে সরাসরি শিক্ষাগ্রহণ করি। আমার জীবনের টার্নিং পয়েন্ট বলতে পারেন এটাকে। এরপর গ্র্যাজুয়েশন শেষে দেশে ফিরি। ডিপ্রজন্ম : এরপর দেশে ফেরার পর কী ভাবছিলেন? বাংলাদেশের পরিবেশ কী ঠিক সে রকম ছিল আপনার ভাবনার মতো? এ্যালেক্স ম্যাকান্জি : ভেবেছিলাম দেশে হলিউডের মতো করে কাজ করা যাবে, আসলে তখনও চিন্তাটা খুব কঠিন ছিল এদেশের প্রেক্ষাপটে। অনেকদিন বসে থাকার পর বাবা বললেন, নিজে কিছু শুরু কর। ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে শুরু করলাম ‘হোয়াইট ওয়াটার’। সেখান থেকে টুকটাক কাজ শুরু করি, আরটিভিতে প্রচার হয় আমার তৈরি ‘জুডোস কিস’, জি সিরিজের সঙ্গে কিছু কাজ করি খুব কম চাহিদায়। এরপর তখন তাহসান খান দেশে ফিরলেন। উনার এ্যালবাম প্রত্যাবর্তনের কাজ একলা করেছি পুরোটা আমি। তখন আমার কোন টিম ছিল না, একলাই স্ক্রিপ্ট রাইটার, একলাই ক্যামেরাম্যান, একলাই এডিটর। ২০১১ তে বিপিএলে ঢাকা গ্লাডিয়েটরসের ফুল ব্র্যান্ডিং করি, তখন স্টান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, ব্রিটিশ আমেরিকান টোবাকোর সঙ্গে কাজ করেছি দীর্ঘ সময়। ডিপ্রজন্ম : খুব ঘটনাবহুল জীবন। আমরা জেনেছি ২০১২ তে আবার ভারত পাড়ি জমান, সেটা কেন? এ্যালেক্স ম্যাকান্জি : আরও বড় কিছু করার পরিকল্পনা নিয়ে ভারত যাই। হাতে বেশ অর্থকরিও ছিল তখন। তবে তিন মাস থেকেও তেমন কিছু করতে না পেরে সব অর্থকরি শেষ করে ফেলি। তখন ধর্ম প্রোডাকশনে কাজ করার সুযোগ পাই, তখন রামলীলার প্রমোশন করেছি। মাত্র কিছু দিনের মাথায় আমাকে কোন কারণ ছাড়া বাদ দিল তারা। এরপর পরিচয় হয় আমার বোন বলি যাকে সালমা আগার মেয়ে সাশা আগার সঙ্গে। তিন মাস তার বাসায় ছিলাম আমি, এরমধ্যে একজন প্রডিউসারের সঙ্গে পরিচয়। তারা তিনজন রাধিকা নান্দা, হারমান বাওয়েজা, সন্জয় মিলে ‘বিগ এ্যাপল মিডিয়া ওয়ার্কস’ প্রতিষ্ঠা করেন। আমাকে তারা ম্যানেজিং পার্টনার হিসাবে নেন। এরপর ভিন্ন এক কাজের যাত্রা করলাম। কঙ্গোনা রনৌত এর কুইন্স, সানি লিওনের রাগীনি, এমএমএস-২ এর প্রমোশন করি ২০১৪ তে। এগুলো আমার করা বড় কাজগুলোর মধ্যে অন্যতম। ডিপ্রজন্ম : পাঠক নিশ্চয়ই অবাক হতে পারে একজন একাধারে গায়ক, পরিচালক, ব্র্যান্ড প্রমোটার। কত চক্রবাক, কীভাবে দেখেন বিষয়টাকে? এ্যালেক্স ম্যাকান্জি : ঘটনা শেষ হয়নি। ২০১৫ এর শেষে শুধুমাত্র বাবার জন্য দেশে ফিরে আমি। দেখা করি বাংলাদেশ ব্র্যান্ড ফোরামের শরীফুল ইসলাম ভাইয়ার সঙ্গে, শুরু করি নিজেদের প্রতিষ্ঠান ‘ফায়ার ফ্লেইম মিডিয়া’ এর। বর্তমানে আমি সিইও হিসেবে কাজ করছি। যে প্রশ্নটি করলেন তার উত্তর আমার কাছে রয়েছে, আমি দেখেছি আমি যখন যেটা করেছি অনেক বিষয় আমার মধ্যে ছিল। আমি উপভোগ করেছি পুরো কাজগুলোকে। ডিপ্রজন্ম : যদি বলা হয় এলেক্স ম্যাকান্জির জীবনের বড় অর্জন কোনগুলো? এ্যালেক্স ম্যাকান্জি : ২০১৬ তো কান ফেস্টিভ্যালে অতিথি হিসেবে যোগ দেয়া, গুরু কিশোর নামিত কাপুরের সান্নিধ্যে কাজ করাকে আমি বড় অর্জন ভাবি। ডিপ্রজন্ম : ডিপ্রজন্ম পাঠকদের জন্য কিছু বলুন। এ্যালেক্স ম্যাকান্জি : আমাদের গুডবুক তৈরি করা উচিত। আরেকজনের দরকার পূরণ করার মানসিকতা আনা দরকার। সবকিছুর উপরে দরকার যোগাযোগ দক্ষতা বাড়ানো। ক্যারিয়ার বাঁক নিতেই পারে, মানসিকতা ঠিক রাখতে হবে।
×