ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

চলে গেলেন বিশিষ্ট লিপি বিশারদ মুদ্রা তাত্ত্বিক ড. শরিফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ৩ জুলাই ২০১৮

চলে গেলেন বিশিষ্ট লিপি বিশারদ মুদ্রা তাত্ত্বিক ড. শরিফুল ইসলাম

স্টাফ রিপোর্টার ॥ দেশের বিশিষ্ট লিপি বিশারদ মুদ্রা তাত্ত্বিক ও গবেষক ড. শরিফুল ইসলাম আর নেই। দীর্ঘদিন ক্যান্সারে ভোগার পর রবিবার রাতে নিজ বাসায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি (ইন্না লিল্লাহি...রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৪৮ বছর। তরুণ ইতিহাসবিদ স্ত্রী, দুই শিশুকন্যাসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। গভীর রাতে মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সংশ্লিষ্ট মহলে শোকের ছায়া নেমে আসে। গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের গোপালপুরে তাকে দাফন করা হয়। ড. শরিফুল ইসলাম মৃত্যুর আগ পর্যন্ত জাতীয় জাদুঘরের উপকিপারের দায়িত্ব পালন করেন। তার একের এক সফল গবেষণা যখন দেশ-বিদেশে বিপুল সাড়া ফেলছিল, ঠিক তখনই ক্যান্সার ধরা পরে তার শরীরে। চার পাঁচ বছর ধরে রোগটির সঙ্গে লড়াই করছিলেন তিনি। দেশের খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ জাদুঘরবিদ ও প-িত ব্যক্তিত্বরা তাকে বাঁচানোর নানা চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। দেশ ও বিদেশে চিকিৎসা গ্রহণ শেষে ঢাকায় নিজ বাসায় গত কিছুদিন শয্যাশায়ী ছিলেন তিনি। পারিবারিক সূত্র জানায়, গত কয়েকদিন ধরেই তার শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটছিল। তারও আগে ভেঙ্গে পড়েছিল শরীর স্বাস্থ্য। রবিবার মধ্যরাতে অবস্থার আরও অবনতি ঘটে। হাসপাতালে নেয়ার আগেই রাত পৌনে ১টায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। সকাল ৮টায় জাতীয় জাদুঘর কমপ্লেক্সে জানাজা শেষে তার মরদেহ গ্রামের বাড়ি ঝিনাইদহের গোপালপুরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেই দাফন করা হয় তাকে। ড. শরিফুল ইসলাম ১৯৭১ সালের ২১ নবেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে পাস করে জাতীয় জাদুঘরে যোগ দেন তিনি। শুধু চাকরি নয়, মনোযোগী হন গবেষণায়। অল্প বয়সেই তার গবেষণা বহু অসম্পূর্ণ পাঠকে পূর্ণতা দেয়। ইতিহাস চর্চায় বড় দাগে মৌলিক অবদান রাখতে সক্ষম হন তিনি। বিদেশে বাংলাদেশী স্কলার হিসেবে তার ছিল আলাদা পরিচিতি। পৃথিবী বিখ্যাত জার্নালগুলোতে বড় বড় লেখকের লেখার সঙ্গে তার লেখা ছাপা হয়েছে। শরিফুল ইসলাম ছাত্রজীবন থেকেই গবেষণায় মনোযোগী ছিলেন। এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ অনেক চাকরির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জাতীয় জাদুঘরে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। সরকারী প্রতিষ্ঠানে রয়েছে শত সহস্র বছরের পুরনো মুদ্রা তাম্র ও শিলালিপি। এসবের বেশ কিছুর পাঠোদ্ধার করে নতুন এবং চমকপ্রদ ইতিহাস আবিষ্কার করেন তিনি। এ কাজের প্রধান ও পূর্বশর্ত হিসেবে প্রাচীন ব্রাহ্মী, খরোস্ট্রি, নাগরী ও প্রোটো বাংলা লিপি সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞানঅর্জন করেন শরিফুল। কাজটি সহজ ছিল না। বিরল মেধা, অহর্নিশ চর্চা ও আন্তরিকতার কারণে সাফল্য পান তিনি। নিবেদিত প্রাণ তরুণ গবেষক প্রাচীন বাংলার ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে বহুকাল ধরে চলা বন্ধ্যাত্ব দূর করেন। আবিষ্কার করেন বর্তমান বাংলাদেশের মূল ভূখ-ের প্রাচীন ইতিহাস। দুর্লভ মুদ্রা, তাম্রলিপি ইত্যাদির পাঠোদ্ধার ও গবেষণা শেষে বিস্ময়কর এই আবিষ্কার সম্ভব হয়। বিরল গবেষণা কর্মের সমষ্টি তার লেখা গ্রন্থ- ঘবি ষরমযঃ ড়হ ঃযব ঐরংঃড়ৎু ড়ভ অহপরবহঃ ঝড়ঁঃয-ঊধংঃ ইবহমধষ. এতে প্রাচীন বাংলার ধারাবাহিক ইতিহাসটি সগৌরবে সামনে এসেছে। পূর্বের কিছু তথ্য ভুল প্রমাণিত করার পাশাপাশি, গবেষক তুলে এনেছেন এই অঞ্চলের পূর্ণাঙ্গ ও সমৃদ্ধ ইতিহাস। বাংলা লিপির বিবর্তনের ইতিহাস নিয়েও বিপুল কাজ করেন শরিফুল ইসলাম। প্রাচীন তাম্রলিপির পাঠোদ্ধার করে ওইসব লেখা থেকে প্রতিটি বর্ণের বিভিন্ন সময়ের আকৃতি সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা গ্রহণ করেন তিনি। পরে ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় গ্রাফিক্সের মাধ্যমে বর্ণমালাগুলোকে সাজান। একইসঙ্গে বাংলালিপির বিচিত্র পথপরিক্রমা পরিবর্তনগুলো তুলে ধরেন। এমন আরও অনেক সফল গবেষণা করে দেশ ও বিদেশের প-িতদের সমীহ আদায় করে নিয়েছিলেন শরিফুল ইসলাম। তাকে ঘিরে বিরাট বিরাট স্বপ্ন দেখছিলেন দেশের খ্যাতিমান ইতিহাসবিদরা। কিন্ত ক্যান্সারের কাছে পরাজিত হলো সব।
×