ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ান

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ৩ জুলাই ২০১৮

আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ান

রাজধানী ঢাকা এখন কয়েকটি বৈশ্বিক সংগঠন ও সংস্থার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, মূলত বাংলাদেশে মিয়ানমার থেকে আগত-আশ্রিত প্রায় ১১ লাখ শরণার্থীর দুঃখ-দুর্দশা প্রত্যক্ষ করাসহ তাদের সম্মানজনক পুনর্বাসনই এই সফরের উদ্দেশ্য। এই প্রেক্ষাপটে একই সঙ্গে জাতিসংঘের মহাসচিব, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট, আন্তর্জাতিক রেডক্রসের প্রধান এবং ইউএনএইচসিআরের প্রধানের উচ্চ পর্যায়ের সফরটি সবিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্ববহ। তারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাত করেছেন। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য নিয়ে এক অনুষ্ঠানে যোগও দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব। তবে সকল কিছু ছাপিয়ে এই চারটি আন্তর্জাতিক সংগঠন ও সংস্থার শীর্ষ পর্যায়ের সফরটিতে প্রধানত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে যথাযোগ্য নাগরিক মর্যাদায় প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের বিষয়টি মুখ্য হয়ে উঠেছে। উল্লেখ্য, রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসন বাস্তবায়নের জন্য মিয়ানমারের সঙ্গে জাতিসংঘের দুই সংস্থার চুক্তি নিয়ে ইতোমধ্যেই প্রশ্নœ উঠেছে। কেননা রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরার পর তাদের অবাধে চলাচল ও নাগরিকত্ব প্রদানের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি। শরণার্থীদের মোট সংখ্যা নিয়েও অস্পষ্টতা আছে। বাংলাদেশ বলছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা ১১ লাখের বেশি। অন্যদিকে মিয়ানমার বলছে, ৭ লাখ। এরও অবসান হওয়া জরুরী ও অত্যাবশ্যক। শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বদের সফরে এসবের অবসান হবে বলেই প্রত্যাশা। এর পাশাপাশি মিয়ানমার সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক চাপও নিশ্চয়ই বাড়বে। ইতোমধ্যে ইইউসহ যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব ট্রেজারির পক্ষ থেকে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের জাতিগত নির্মূল অভিযানে নেতৃত্ব দেয়ার অভিযোগে মিয়ানমারের জেনারেল মং মং সোয়েকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দুর্নীতির অভিযোগে বিশ্বব্যাপী কালো তালিকাভুক্ত ৫৮ ব্যক্তির অন্যতম একজন এই জেনারেল। অন্যদিকে ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনসহ দমন-পীড়নের অভিযোগ এবং তাতে সমর্থন দেয়ার সুনির্দিষ্ট কারণে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীপ্রধান এবং রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলপ্রাপ্ত আউং সান সুচির বিরুদ্ধেও নিন্দা প্রস্তাব আনা হয়েছে। আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের বিচারের দাবি উঠেছে। জাতিসংঘ রাখাইনের বাস্তব পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে আন্তর্জাতিক তদন্ত দল পাঠাতে চাইলেও সুচির নেতৃত্বাধীন মিয়ানমার সরকার তার অনুমতি দিচ্ছে না। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক আদালতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে মামলা দায়েরের জন্য ব্যাপক জনমত সৃষ্টি হয়েছে আন্তর্জাতিক মহলে। ইতোমধ্যে সুচির নানা আন্তর্জাতিক পদক ও সনদ প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশের পক্ষ থেকে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের অনেক দেশে প্রবেশসহ প্রশিক্ষণ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সার্বিক প্রেক্ষাপটে মিয়ানমার যদি বাংলাদেশের সঙ্গে যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের সুপারিশ ও তালিকা অনুযায়ী রাখাইনে বাংলাদেশে আশ্রিত ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা শরণার্থীকে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু না করে তাহলে আগামীতে তাদের একঘরে হয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। সে অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক অবরোধের সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। তখন মনে হয় না এমনকি চীন, রাশিয়া, ভারতও অন্তত নৈতিক ও মানবিক কারণে সমর্থন দেবে মিয়ানমারকে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে উদ্ভূত রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশ ৫টি প্রস্তাব পেশ করেছে। এগুলো হলো, সে দেশে চিরতরে সহিংসতা ও জাতিগত নিধন বন্ধ করা; জাতিসংঘ মহাসচিবের অধীনে একটি নিজস্ব অনুসন্ধানী দল প্রেরণ; জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান এবং তা পূরণে সেখানে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষাবলয় গড়ে তোলা; রাখাইন রাজ্য থেকে জোর করে বিতাড়িত সব রোহিঙ্গাকে, যাদের অধিকাংশ আশ্রয় নিয়েছে বাংলাদেশে, তাদের নিজ নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা; সর্বোপরি জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কোফি আনান কমিশনের সুপারিশমালা নিঃশর্ত, পূর্ণ ও দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। আসন্ন বৃষ্টি ও বন্যার মৌসুমকে সামনে রেখে সমূহ ঝুঁকি বিবেচনায় যত দ্রুত এই সমস্যার সমাধান হয়, ততই মঙ্গল।
×