ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সব জঙ্গী নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ২ জুলাই ২০১৮

সব জঙ্গী নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ফুল দিয়ে স্মরণ করা হয়েছে হলি আর্টিজান হামলায় নিহতদের। শুধু স্বজনরা নন, বিদেশীরাও তাতে যোগ দিয়েছেন। শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বিদেশী রাষ্ট্রদূত, র‌্যাব, পুলিশসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক ও মানবাধিকার সংগঠনের নেতৃবৃন্দরাও। ইতিহাসের জঘন্যতম এই হামলায় নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তাকে স্মরণীয় বরণীয় করে রাখার জন্য তৈরি করা হয়েছে বিশেষ ভাস্কর্য ‘দীপ্ত শপথ’। রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গী হামলার দুই বছর পূর্ণ হওয়ার দিন রবিবার দিনভর সেখানে বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষের পদচারণা দেখা যায়। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ ও ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া আলাদা আলাদা শ্রদ্বাঞ্জলি নিবেদনের পর জানিয়েছেন, বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণ নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত জঙ্গীবাদবিরোধী অভিযান চলবে। চাঞ্চল্যকর এই মামলার চার্জশিট আগামী সাতদিনের মধ্যে প্রদানের কথা উচ্চারণ করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। এ উপলক্ষে গুলশান ২ নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়ক এলাকায় নিরাপত্তা জোরদারে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মোতায়েন করা হয়। ভোর ৬টার দিকে হলি আর্টিজানে যান বাংলাদেশে নিযুক্ত জাপানের রাষ্ট্রদূত ইজুমি। সকাল ১০টার পর বেকারির ফটক খুলে দেয়ার পর নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। সকাল ১০টা থেকে দুপুর সাড়ে ১২টা পর্যন্ত নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান ইতালি ও জাপানী নাগরিকরা। নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হলি আর্টিজান বেকারিতে যান র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন- যতক্ষণ পর্যন্ত দেশে একজন জঙ্গীরও অস্তিত্ব থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত জঙ্গীবিরোধী অভিযান চলতে থাকবে। তারপর যান ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার। ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান গুলশান থানা আওয়ামী লীগ, তিতুমীর কলেজ ছাত্রলীগ ও বিএনপির প্রতিনিধি দল। হামলায় নিহত ইতালিয়ান নাগরিক নাদিয়া বেনদিত্তি ছিলেন স্টুডিও টেক্স লিমিটেডের পরিচালক। ওই গার্মেন্ট কারখানার কর্মীরাও ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন- হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলা ঘটনার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। আগামী সাতদিনের মধ্যে পুলিশ চার্জশিট দেবে। বিশ্বব্যাপী জঙ্গী হামলা হচ্ছে। কয়েকদিন আগেও আমেরিকায় হামলা হয়েছে। তার মানে এই নয় যে, হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার কারণে আমাদের ভাবমূর্তি একেবারে নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা জঙ্গীবিরোধী ধারাবাহিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। এগুলো চলতে থাকবে। আমাদের দেশে জঙ্গীদের কোন স্থান নেই। যতক্ষণ জঙ্গী ততক্ষণ অভিযান ॥ হলি আর্টিজান বেকারিতে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন শেষে র‌্যাব মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত দেশে একজন জঙ্গীরও অস্তিত্ব থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত জঙ্গীবিরোধী অভিযান চলতে থাকবে। এখনই আত্মতুষ্টির কোন সুযোগ নেই। কারণ জঙ্গীবাদ নির্মূল একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। সম্পূর্ণ নির্মূল না হওয়া পর্যন্ত অভিযান চলবে। গত দুই বছর ধারাবাহিক অভিযানের মাধ্যমে আমরা বিশ্বকে এই বার্তা দিতে পেরেছি, বাংলাদেশ জঙ্গীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয় নয়। এ দেশের জনগণ কখনও জঙ্গীবাদ মেনে নেয়নি, নেবেও না। বেনজীর আহমেদ বলেছেন- আজ থেকে দুই বছর আগে জঙ্গীবাদের নামে দেশকে, রাষ্ট্রকে জিম্মি করার যে নীলনক্সা বাস্তবায়নের চেষ্টা চলেছে, সেই ভয়াল রাতে দায়িত্ব পালন করেছি। জঙ্গীবাদের নিরাপদ আশ্রয়ের স্থান যে বাংলাদেশ নয়, তা আমরা স্বল্প সময়ের মধ্যে প্রমাণ দিয়েছি। আমরা গত দুই বছরে জঙ্গী সংগঠনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছি। যারা বিভিন্নভাবে মদদপুষ্ট হয়ে ভ্রাতৃদেশগুলোর সামনে অপদস্ত করতে হামলার চেষ্টা করেছে। তবে খুব স্বল্প সময়ে প্রমাণ করেছি বাংলাদেশ জঙ্গীদের নিরাপদ আশ্রয় নয়। বাংলাদেশের মানুষ জঙ্গীবাদ বরদাস্ত করবে না। বাংলাদেশ থেকে সর্বশেষ জঙ্গীটিকে নির্মূল না করা পর্যন্ত আমরা অভিযান অব্যাহত রাখব। সরকারের নেতৃত্বে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে আমরা এ অভিযান চালাব। হলি আর্টিজানের হামলার দিনে আমরা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের দমন করেছি। গত দুই বছরের জঙ্গীবিরোধী অভিযানের মাধ্যমে আমরা সারাবিশ্বকে সিগন্যাল দিতে সক্ষম হয়েছি। এখনই আত্মতুষ্টির কোন কারণ নেই। কারণ, জঙ্গীবাদ একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। জঙ্গি শেষ হয়েছে এটা বলা যাবে না ॥ এদিকে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন- হলি আর্টিজান হামলার দুই বছর পর নির্দ্বিধায় বলতে পারি আমরা জঙ্গী নেটওয়ার্ক পর্যুদস্ত করেছি, ভেঙ্গে দিয়েছি, গুঁড়িয়ে দিয়েছি। তবে জঙ্গী শেষ হয়েছে এটা বলা যাবে না। কারণ এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। রবিবার রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলায় নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার স্মৃতিতে নির্মিত ভাস্কর্য ‘দীপ্ত শপথ’ উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের সামনে একথা বলেন তিনি। কমিশনার বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় এ ধরনের হামলা হয়। এটি একটি গ্লোবাল সমস্যা। তারপরও আমাদের তৎপরতা অব্যাহত আছে। জনগণের সমর্থনে আমরা এই ধরনের হামলা আর হতে দেইনি। তবে বিচ্ছিন্নভাবে তাদের (জঙ্গী) অপতৎপরতা থাকতেই পারে এবং সেটা রয়েছে। এটা আমরা অস্বীকার করব না। তবে আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট দিনরাত পরিশ্রম করছে। দেশে ছোট-বড় ৭০টি জঙ্গী আস্তানায় অভিযান চালানো হয়েছে জানিয়ে পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গীরা যেখানেই থাকুক তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনা হবে। ডিএমপি কমিশনার আরও বলেন, জঙ্গীবাদ স্তব্ধ না করতে পারলে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। হলি আর্টিজান হামলার পর আমাদের দেশ থেকে অনেক বিনিয়োগকারী, কূটনীতিক, ক্রেতা-বিক্রেতা চলে যেতে চেয়েছিলেন। তবে আমরা জঙ্গীবাদ রুখে দিয়েছি। জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় আরও যা যা করা দরকার আমরা করব। বাংলাদেশে কোন ধরনের জঙ্গীবাদের বিস্তার হতে দেয়া হবে না। হলি আর্টিজান হামলা-মামলার মতো একটি জটিল মামলার তদন্ত আমাদের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের মেধাবীরা শেষ করেছে। জড়িতরা অনেকে এনকাউন্টারে মারা গেছে, অনেকের বিরুদ্ধে চলতি সপ্তাহেই অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে। আমরা আশাকরি আইনের মাধ্যমে জড়িতরা শাস্তি পাবে। মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন- হলি আর্টিজান হামলা ছিল বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক সুগভীর ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্রের দিনে আমরা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করেছি। সেদিন আমাদের পুলিশ অফিসার রবিউল করীম ও সালাউদ্দিন খান শহীদ হয়েছেন। তারা জীবন উৎসর্গ করেছেন। আমরা তাদের হারানো শোককে শক্তিতে রূপান্তরিত করেছি। আমরা শক্তি সঞ্চয় করে জঙ্গীদের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করছি। জঙ্গী অভিযানে বিশ্বে আমরা নজির স্থাপন করছি। ভিকটিমদের উদ্ধার করেছি জঙ্গী আস্তানা থেকে এ ঘটনায় নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তা হলি আর্টিজান হামলায় নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার স্মৃতি ভাস্কর্য হলি আর্টিজান এলাকায় না করে গুলশান পুরাতন থানা এলাকায় করার বিষয়ে কমিশনার বলেন- হলি আর্টিজান এলাকাটি ব্যক্তি মালিকানাধীন। গুলশানের জমির অনেক দাম। আমরা মালিকের সঙ্গে কথা বলছিলাম। কিন্তু তিনি সেখানে জমি দিতে রাজি হননি। তাই আমরা আজাদ মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় ‘দীপ্ত শপথ’ তৈরি করেছি। এখানে নতুন প্রজন্ম তাদের ত্যাগের কথা জানতে পারবে। ভাস্কর্য দুই পুলিশ কর্মকর্তার ॥ গুলশান-২ নম্বর সড়কে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালেন হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলায় নিহত গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলাম ও তৎকালীন বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন খান। ওই এলাকার আজাদ মসজিদের পাশের সড়কে তাদের স্মরণে নির্মিত হয়েছে ভাস্কর্য। ভাস্কর্যটি তৈরি করেছেন ভাস্কর শিল্পী মৃণাল হক। এর নাম দেয়া হয়েছে ‘দীপ্ত শপথ’। সকালে ভাস্কর্যটি উদ্বোধন করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া। উদ্বোধন শেষে পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তা, রবিউল ও সালাহউদ্দীনের স্ত্রী এবং বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ এতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় ডিএমপি কমিশনার বলেন, রবিউল-সালাহউদ্দিন যে আত্মত্যাগ করেছেন তা পুলিশ ও দেশবাসী কখনও ভুলবে না। আর্টিজানের হামলার দিন নিজেদের জীবন বাজি রেখে তারা জঙ্গীদের বিরদ্ধে যুদ্ধ করেছেন, জীবন দিয়েছেন। আমরা তাদের স্মরণে এই ভাস্কর্য তৈরি করেছি। আর্টিজান ব্যক্তি মালিকানার জায়গা তাই আমরা ভাস্কর্যটিকে সেখান থেকে একটু দূরে গুলশান থানা এলাকার অধীন সরকারী জায়গায় স্থাপন করেছি। উল্লেখ্য, ২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটে। জঙ্গীদের হামলায় রেস্টুরেন্টের ভেতরে থাকা বিদেশীসহ ২০ জন এবং রেস্টুরেন্টের বাইরে জঙ্গীদের গুলিতে রবিউল ইসলাম ও সালাহউদ্দিন মারা যান। পরদিন ২ জুলাই হলি আর্টিজানে ‘অপারেশন থান্ডারবোল্ট’ পরিচালনা করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এতে হামলাকারী পাঁচ জঙ্গীও নিহত হন। বিসিএসের ৩০তম ব্যাচে উত্তীর্ণ হয়ে ২০১২ সালের জুন মাসে পুলিশ বাহিনীতে যোগদান করেন রবিউল। স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে রাজারবাগ পুলিশ লাইন কোয়ার্টারে থাকতেন তিনি। আর ৮ মাসের আরেক অনাগত সন্তান স্ত্রীর গর্ভে রেখেই আত্মত্যাগ করেন পুলিশের এ এসি। বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দিন ১৯৯১ সালের আগস্ট মাসে উপ-পরিদর্শক (এসআই-নিরস্ত্র) পদে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে যোগ দেন। পরবর্তীতে ২০০৭ সালে ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) পদে পদন্নোতি পান। পূর্বে তিনি পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি), সিআইডি ও ডিএমপির কোতোয়ালি ও মিরপুর থানার ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি তার স্ত্রী রেমকিম, ১৪ বছরের এক কন্যা ও ৬ বছরের এক পুত্র সন্তান রেখে গেছেন।
×