ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুনয়না বৃষ্টি

চেতনার বাতিঘর ড. হায়াৎ মামুদের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

প্রকাশিত: ০৪:১২, ২ জুলাই ২০১৮

 চেতনার বাতিঘর ড. হায়াৎ মামুদের জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

‘সৎ সঙ্গে স্বর্গবাস, অসৎ সঙ্গে সর্বনাশ’- বর্তমান প্রেক্ষাপটে এ প্রবাদটির গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে বৈ কমছে না। কেননা, সৎ সঙ্গ পাওয়া বড়ই দুর্লভ। ইট-পাথরের শহরে, যান্ত্রিক সমাজে বেশিরভাগ মানুষই এখন স্বার্থান্বেষী, পরশ্রীকাতর। মুখে এক তো অন্তরে আরেক। দুর্নীতি, হিংস্রতা, নাশকতার মতো খারাপ প্রবণতাগুলো আমাদের আষ্টে-পৃষ্ঠে গিলে খাচ্ছে। নেই কোন নৈতিকতা, নেই কোন মনুষ্যত্ববোধ। হ্যাঁ মনুষ্যত্ব। বর্তমান সময়ে যার বড়ই অভাব। মনুষ্যত্ব এমনই এক জিনিস যা বলে কয়ে হয় না, প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যা অর্জনেও যা আয়ত্তে আনা যায় না, এটা উপলব্ধির ব্যাপার। ভেতরের মনটাকে অন্ধকার থেকে ঠেলে বের করে, আলোর আশ্রয়ে জীবনটাকে দেখার ব্যাপার। সমস্যা হলো, অন্ধকার থেকে আলোর দিশা পাওয়া খুব সুলভ নয়। পথ না চিনে, আলোর দেখা না পেয়ে জীবনের মানেটাই আর এক জীবনে জানা হয়ে ওঠে না বেশিরভাগ মানুষের। তাই পথটা যেন না হারাই, আলোটা যেন খুঁজে পাই তার জন্য ঈশ্বরের আশীর্বাদস্বরূপ পৃথিবীতে এমন কিছু মহৎ ব্যক্তিত্ব আসেন, যাঁর সান্নিধ্যে ধন্য হয়ে ওঠে এই বসুন্ধরা। আমাদের ভেতরের কলুষিত মনের অন্ধকারটাকে দূরে ঠেলে দিয়ে সুন্দর মনের অধিকারী, মনুষ্যত্ববোধসম্পন্ন মানুষ গড়ে তুলতে তারা নিভৃতে কাজ করে যান। তাঁরা আমাদের নতুন আলো দেখান, চিনতে শেখান সঠিকপথ। জ্ঞানের আলোয় মনের সব কালো দূর করে নতুন করে ভাবতে শেখান, স্বপ্ন দেখতে শেখান, শেখান দায়িত্ববোধ। বাংলা সাহিত্যের এমনই এক আধুনিক কবি, লেখক-ব্যক্তিত্ব ড. হায়াৎ মামুদ। অগ্রপথিক ড. হায়াৎ মামুদ এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি একাধারে কথাসাহিত্যিক, অধ্যাপক, শিক্ষাবিদ, অনুবাদক। গবেষক ও প্রবন্ধকার হিসেবেও তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত। ড. হায়াৎ মামুদ কর্মজীবনের শুরুতে কিছু দিন বাংলা একাডেমিতে কাজ করেন। এরপর দীর্ঘকাল তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বাংলা ভাষা ও সাহিত্য’ বিভাগে অধ্যাপনা করেন। ‘তুলনামূলক সাহিত্যের’ ওপর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি ডিগ্রী লাভ করেন। দীর্ঘ সাহিত্যজীবনে তিনি লিখেছেন অজস্র কবিতা, প্রবন্ধ, জীবনীগ্রন্থ। অনুবাদ করেছেন অসংখ্য বই। তার অনূদিত বইয়ের মধ্যে অন্যতম ম্যাক্সিম গোর্কির ‘চড়ুইছানা’, যা সব মহলে উচ্চ প্রশংসা লাভ করে। বাংলা ছাড়াও রুশ ভাষায় পারদর্শী ড. হায়াৎ মামুদের রচিত বইয়ের সংখ্যা ৬০টিরও অধিক। ‘মৃত্যুচিন্তা রবীন্দ্রনাথ ও অন্যান্য জটিলতা’ তার বিখ্যাত একটি গ্রন্থের নাম। শিশু-কিশোরদের জন্য তিনি লিখেছেন প্রচুর বই। বাংলা ব্যাকরণের কঠিন বিষয়গুলোকে সহজে কিশোর-কিশোরীদের আত্মস্থ করার জন্য লিখেছেন বাংলা ব্যাকরণবিষয়ক জনপ্রিয় বই। তার লেখা ‘শব্দকল্প ধ্রুম’ ব্যাকরণ শেখার একটি অসাধারণ বই। ব্যাকরণের জুজুর ভয় তাড়ানোর জন্য এ বইটি পড়লে বাংলা ব্যাকরণের যে মজা তা বোঝা যাবে। গল্পের ছলে বিদ্যা শেখার এসব বইয়ের কারণে তরুণ প্রজন্মর কাছে হায়াৎ মামুদ এক সুপরিচিত প্রিয় লেখকের নাম। প্রগতিশীল এই চিন্তাবিদের লেখায় উঠে এসেছে সমাজের সমস্যাও। তার রচিত ‘অবহেলিত ধ্রুবপদ কিন্নরদল’ এবং সম্পাদিত ‘যুদ্ধাপরাধের শাস্তি চাই’ এমনই দুটি গ্রন্থ। সাহিত্যে বহুমুখী সৃষ্টিকর্মের জন্য তিনি পেয়েছেন অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কার। তার মধ্যে জীবনব্যাপী শিশুসাহিত্য রচনার জন্য তিনি পান ‘বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ (২০১৩), একুশে পদক (২০১৬), রবীন্দ্র পুরস্কার (২০১৭)। শিশুসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি পান বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। এ পুরস্কার প্রদানে যে দুটি বই প্রধান বিবেচ্য ছিল তা হলো ‘রবীন্দ্রনাথ : কিশোর জীবনী’ ও ‘নজরুল ইসলাম : কিশোর জীবনী’। এ দুটি বইতে আমরা শক্তিশালী এক গদ্যশিল্পী হায়াৎ মামুদকে খুঁজে পাই। দুই. সৌভাগ্যবশত ব্যক্তি ও কর্ম উভয় জীবনেই ড. হায়াৎ মামুদকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। ব্যক্তিগত জীবনে হায়াৎ মামুদ প্রগতিশীল মতাদর্শ ও পরিশীলিত রাজনৈতিক চিন্তার মানুষ। আড্ডার আসরে সকলের মধ্যমণি। তিনি সহজেই মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেন। সদাহাস্যোজ্জ্বল ড. হায়াৎ মামুদ তার বর্তমান কর্মক্ষেত্র পুথিনিলয়তে ঢুকেই সবার উদ্দেশে বলেন- ‘শুভ অপরাহ্ণ’। কারও সঙ্গে ফোনালাপের শুরুতেই অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে তাকে বলতে শোনা যায়- ‘জি, অধমের নাম হায়াৎ মামুদ।’ নিরহঙ্কার এ মানুষটি যেন ফলপূর্ণ বৃক্ষের নতজানু শিরের মতো। পুরান ঢাকার দীননাথ সেন রোডে তার নিবাস। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষটি তার বাড়ির সামনে ও পেছনে গড়ে তুলেছেন ছোট্ট বাগান। বাড়ির দোতলায় ব্যক্তিগত একটা লাইব্রেরি আছে তার। সেখানে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বইয়ের বিশাল সংগ্রহ। তিন. ব্যক্তি জীবনে তাকে আমি কাকু ডাকি। অবশ্য এ ডাকটা তারই দেয়া এক অমূল্য অধিকারও আমার জন্য যা গর্বের। বাবার সূত্র ধরে কাকুর সঙ্গে প্রথম দেখায় যখন কাকুকে ‘স্যার’ ডাকি তখন কাকু আমায় বলেছিলেনÑ ‘স্যার ডাকলে তো সমস্যা।’ তার কাছে কন্যার অধিকারে অধিষ্ঠিত হওয়ার সৌভাগ্য যে কারও জন্য এক জীবনের পরম পাওয়া। কাকু হাসতে যেমন জানেন, তেমনি হাসাতেও জানেন। তাই মন খারাপ করে বেশিক্ষণ আপনি এই বুড়ো খোকার সামনে বসে থাকতে পারবেন না। জানিয়ে রাখছি, বুড়ো খোকার কিন্তু খুব ভুলোমন। তবে মনটা তার ধবধবে সাদা, মায়ায় ভরা। কাকু আমার জীবনের আদর্শ। গল্পচ্ছলে কথায় কথায় কাকুর কাছ থেকে অনেক কিছু শিখেছি, কাকুর সঙ্গে হেসেছি, কেঁদেছি। স্বভাবে একটু আবেগপ্রবণ হওয়ায় যখন কোন কারণে কেঁদে ফেলতাম তখন কাকু তার স্নেহার্দ্য হাতটি মাথায় রেখে বলতেন- ‘বোকা মেয়ে কাঁদিস কেন?’ কাকুর সঙ্গে আমার প্রায়ই দেখা হয়, কথা হয়। কিন্তু একটা কথা কখনও কাকুকে বলা হয়ে ওঠেনি। আসলে মুখে বলে ভেতরে থাকা আবেগটাকে কখনও প্রকাশ করা যায় না। এটা সত্যি খুব কঠিন, প্রায় অসম্ভব। তাই কিছু কিছু কথার শেষ আশ্রয় হলো লেখা। আজ ২ জুলাই কাকুর জন্মদিনে চাই- ‘কাকু তোমায় বড্ড ভালবাসি।’ ভুলোমনা আমার মিষ্টি কাকুটাকে জানাই ৮০তম জন্মদিনের শ্রদ্ধাঞ্জলি।
×