ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কত রঙ্গ জানোরে জাদু...

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ২ জুলাই ২০১৮

কত রঙ্গ জানোরে জাদু...

সেই কবে উনিশ শতকের শেষার্ধে সরলাবালা দাসী আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমি যাই বঙ্গে, কপাল যায় সঙ্গে।’ অর্থাৎ দুর্দশা আর দুর্গতি তার পিছু ছাড়ছিল না। বঙ্গে এসেও দুর্ভোগ তাকে আঁকড়ে রেখেছিল। এ কালের মার্সিয়া বার্নিকাটেরও সেই অবস্থা যেন। তবে তিনি তো আর সরলাবালা দাসী নন। বিশ্বের শীর্ষ শক্তিধর দেশের প্রতিনিধি। পূর্বপুরুষ যার যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাসী। সেই তিনি ঢাকায় আসার পর কপালও বুঝি তার সঙ্গে সঙ্গে এসেছে। নিজ দেশের নির্বাচনী দুরাবস্থার হাল হকিকত আর ঘোর তার পিছু ছাড়ছে না। তাই নিজ দেশে ট্রাম্পের নির্বাচনী ‘জালিয়াতি’র কারণে যখন হিলারি হেরে যান, আর নির্বাচনটি যখন বিশ্বজুড়ে বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেনি, তখন তার মধ্যে স্বাভাবিক নির্বাচনী ব্যবস্থাকে মেনে নেয়া কষ্টকর হয়ে পড়েছে বৈকি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন যখন ঘটেনি, তখন তিনি অন্য দেশে তা দেখবেন কেমন করে। নিজ দেশে যখন মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, তখন অন্য দেশে মানবাধিকার রক্ষার বিষয়টি মেনে নেবেন কেন। তাই বাংলাদেশে তিনি মানবাধিকার দেখেন না। ঢাকায় বসে বার্নিকাট খুলনা সিটি কর্পোরেশনের ভোটের পর এবার গাজীপুরের স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে যা বলেছেন তা কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত বলে অভিহিত করা হয়েছে। নির্বাচন সরেজমিন পর্যবেক্ষণ তিনি করেননি। স্বচক্ষে কোন দৃশ্য দেখেননি। তারপরও তিনি বলেছেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অনিয়মের খবরে যুক্তরাষ্ট্র উদ্বিগ্ন। খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ ওঠার পর এ নির্বাচন নিয়েও একই ধরনের অভিযোগ ওঠায় উদ্বেগ বেড়েছে। এটা ঠিক উদ্বেগ যুক্তরাষ্ট্র প্রকাশ করতেই পারে। কিন্তু অপর দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ কাম্য হতে পারে না। তদুপরি সঠিক তথ্যের ভিত্তিতে কথা বলা হলে তার একটা গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া যেত। কিন্তু সঠিক তথ্য তো তিনি সংগ্রহ করেননি। ‘চিলে কান নিয়েছে’ বলে চিলের পেছনে দোঁড়ানোর এ প্রবণতা কূটনীতিকের দক্ষতাকে তুলে ধরে না। বরং বিএনপি চেয়ারপার্সনের অবর্তমানে তিনি তারই মনোভাবকে তুলে ধরে যা বলেছেন এবং বলে যাচ্ছেন তাতে তাকে চেয়ারপার্সনের মুখপাত্র হিসেবে প্রতীয়মান হতেই পারে। তার এই উদ্দেশ্য সম্পর্কে বুঝতে পারা অসাধ্য নয়। কারণ বার্নিকাট অতীতে যেসব দেশে কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, সেসব দেশের অবস্থা কী দাঁড়িয়েছিল তার নথিপত্র ঘাঁটলে অনেক আতঙ্কিত দৃশ্যপট ভেসে ওঠে। আমরা সে নিয়ে কিছু বলতে চাই না। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে যে তাই রয়েছে। যেমন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন প্রত্যক্ষকারীরাও দেখেছেন, ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিনের মাধ্যমে কী হয়েছিল, সে নিয়ে নানা কথাবার্তা রয়েছে। ভোট কিভাবে টেম্পারিং করা হয়েছিল সেসব আলোচনা এখনও বিদ্যমান। খুলনা ও গাজীপুর নির্বাচন যখন সহিংসতামুক্ত, অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ হয়েছে বলে নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থাগুলোও বলেছে, তখন তিনি এক ধাপ এগিয়ে অভব্যভাবে বলে ফেলেন খুলনায় ভোটে বল প্রয়োগ হয়েছে, গাজীপুরে ব্যালট বাক্স ছিনতাই, বিরোধী দলের নেতা, কর্মী ও পোলিং এজেন্টদের গ্রেফতার হয়রানির ঘটনা ঘটেছে। দুটি নির্বাচন নিয়ে তিনি উদ্বিগ্ন। নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা, যেগুলোর সঙ্গে বিএনপির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, তারাও বলেছে দলমত নির্বিশেষে ভোটাররা নির্বিঘেœ ভোট দিতে পেরেছে। পরাজিত প্রার্থীরাও বলতে পারেননি নির্বাচন সরকারী হস্তক্ষেপ বা প্রভাবের কথা। ভোট কারচুপি, মিডিয়া ক্যু, ফলাফল ঘোষণায় অনিয়মের কথাও কারও মুখ থেকে উচ্চারিত হয়নি। নির্বাচন হয়েছে সুষ্ঠু, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ বলে সবাই মতামত দিয়েছেন, তখন সেদিকে ভ্র‍ুক্ষেপ না করে বিএনপি-জামায়াত নেতাদের কণ্ঠে কণ্ঠ মেলানো সঙ্গতিপূর্ণ নয় একজন কূটনীতিকের জন্য। কিন্তু তা মানবেন কেন বার্নিকাট? এক ধাপ এগিয়ে তিনি যেসব মতামত দিয়েছেন, তা বাস্তবতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। খুলনায় ভোটারদের ভোটদানে বাধা দেয়া হয়েছে বলে মন্তব্য শুধু করেননি, এসব ঘটনার উপযুক্ত তদন্ত করে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছেন। একই উচ্চারণ তিনি করেছেন সদ্য সমাপ্ত গাজীপুরের নির্বাচন নিয়ে। নির্বাচনে জনমতের প্রতিফলন ঘটেনি বলে তার মনে হয়েছে। এমনকি নির্বাচনে জালিয়াতি আর রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ও পোলিং এজেন্টদের ভয়-ভীতি দেখানো হয়েছে বলে যে গালগপ্প করেছেন তা ধোপে টেকে না। ট্রাম্প-হিলারির নির্বাচন নিয়ে অবশ্য বাংলাদেশ কখনও উদ্বেগ প্রকাশ করেনি। অনেক ভোট কেন্দ্রে নামমাত্র ভোটারের উপস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ একটুও মন্তব্য করেনি। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মার্কিন নির্বাচনে যেসব অনিয়ম হয়েছে সে সম্পর্কে ‘টু’ শব্দটিও উচ্চারণ করেননি। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের আগেই শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের ত্রিশ শতাংশ প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করেছেন। নির্বাচনের সময় সহিংসতায় ১২ জনেরও বেশি মারা গেছে। ভারতে অবস্থানরত বিদেশী কোন রাষ্ট্রদূতকে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করতে দেখা যায়নি। সেখানকার তুলনায় খুলনা ও গাজীপুরের নির্বাচন অনেক অনেক সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়েছে। বাংলাদেশ মনে করে নির্বাচন যার যার দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। তথাপি বার্নিকাট দাবি করেছেন, স্থানীয় সরকারের দুটি নির্বাচন তিনি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন। ভোট কেন্দ্রে এজন্য তাকে যেতে হয়নি। এ যেন অন্যের মুখে ঝাল খাবার মতো। এই পর্যবেক্ষণ তিনি ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে করেছেন কি না তা জানাননি। বরং বিএনপির পর্যবেক্ষণকে তিনি তার নিজের মনে করেছেন। ঢাকায় বসে আমরা যারা নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছি তাদের কাছে এমনটা দৃশ্যমান বা মনে হয়নি যে, হতাশ হওয়ার মতো কোন ঘটনা ঘটেছে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প-হিলারির নির্বাচনের সময় যা ঘটেছে তা বিশ্ববাসী দেখেছেন। রাশিয়ার হস্তক্ষেপ নিয়ে যে তুলকালাম কা- ঘটেছে তার রেশ এখনও চলছে। পপুলার ভোটে হিলারি এগিয়ে গেলেও ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটে জিতেছেন ট্রাম্প। সে দেশের জনগণ এই ভোট মেনে নেয়নি। সেই নির্বাচন নিরক্ষেপ, স্বচ্ছ, অবাধ ও সুষ্ঠু হয়েছে কি-না তা নিয়ে এন্তার প্রশ্ন এবং অভিযোগের বহর কম ছিল না। নিজ দেশের এমন বিতিকিচ্ছিরি নির্বাচনের অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ বার্নিকাটকে খুলনা, গাজীপুরের স্থানীয় সরকার নির্বাচন কেন হতাশ করেছে তার কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না। ভোটে বল প্রয়োগের ঘটনাকে তিনি যেভাবে প্রাধান্য দিচ্ছেন, এমনকি ভোটদানে বাধা প্রদানের যে কথা তিনি বলছেন তাতে পুরো নির্বাচনেরই বিশ্বাসযোগ্যতা থাকার কথা নয়। বরং ওই দুটি এলাকার ভোটারদের প্রতি তিনি যে অবজ্ঞা দেখিয়েছেন তাতে নানা প্রশ্ন উঠতে পারে। বার্নিকাটের মতো অবশ্য আমরাও মনে করি সুষ্ঠু, অবাধ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন একটি স্বাস্থ্যকর গণতন্ত্রের মূলভিত্তি। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিষয়ে তার মন্তব্য কোন স্বাস্থ্যকর বিষয় হতে পারে না। বার্নিকাট যা বলেছেন তা তার স্বচক্ষে দেখা কোন বিষয় নয়। বরং নির্বাচনে পরাজিত বিএনপির ভাষ্যেরই প্রতিধ্বনি। বিএনপি বলেছে, ব্যালট পেপারে জোর করে সিলমারা হয়েছে, তাদের পোলিং এজেন্টকে জোর করে কেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। ভোটারদের ভোটদানে বাধা প্রদান করা হয়েছে। অবশ্য নির্বাচনে হেরে গিয়ে ক্ষোভ, হতাশা, আর অপমানে মুহ্যমান হয়ে বিএনপি যেসব অভিযোগ এনেছে তারই প্রতিধ্বনি করছেন বার্নিকাট। কিন্তু তিনি যদি জানতেন কথিত এসব বিষয়ের চর্চা বিএনপির একান্ত নিজস্ব। এদেশে ভোট ও নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ধ্বংসের সমস্ত আয়োজনটা তাদের হাতেই হয়েছে। পঁচাত্তর পরবর্তী ক্ষমতা দখলকারী ও রাজাকার পুনর্বাসনকারী জিয়া কিভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে পর্যদুস্ত করেছিলেন, একটু নথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করলে তিনি স্পষ্ট হতেন জিয়ার ‘হ্যাঁ না’ ভোট, দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচনটি কেমন হয়েছিল। আর রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নামে জিয়া যে প্রহসনের আশ্রয় নিয়েছিলেন তাতে দেশবাসী শুধু নয়, বিশ্ববাসীও হতবাক হয়েছিল। উর্দিপরা ব্যক্তিটি ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য যা করেছেন তাতে এদেশবাসী ভাবতেই পারেনি কোন দিন তারা আর ভোট দিতে পারবে। জিয়ার উত্তরসূরি বিচারপতি সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের নামে ভোটকেন্দ্র দখল, জালভোট, ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধা প্রদান, পোলিং এজেন্ট নিয়োগ না দেয়া ইত্যকার অনিয়মগুলোকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছিলেন। ক্ষমতা দখলকারী জান্তা এরশাদ তো নির্বাচনে প্রার্থীকে ভোট কেন্দ্রের ধারে কাছে যেতে দেননি। ভোট কেন্দ্র সশস্ত্র পন্থায় দখলের মহড়া দেখা গেছে ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের সংসদ নির্বাচনে। স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে সহিংসতার মাত্রা এমন ছিল যে, বহু মানুষ হতাহত হয়েছে। ‘মিডিয়া ক্যু’ চালু করে বিজয়ী প্রার্থীকে হারিয়ে দেয়ার কাজটি সুচারুরূপে করেছিলেন এরশাদ। ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা ও ক্ষমতায় পুনর্বহাল হওয়ার লক্ষ্যে দুর্বৃত্তায়নকেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। ২০০১ সালের নির্বাচনে সেনাবাহিনী নিয়োগ করেছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান বিচারপতি লতিফুর রহমান। বিএনপির প্রতিদ্বন্দ্বী দলের প্রার্থীদের তারা কেন্দ্রেও আসতে দেয়নি। নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার, হামলা চালিয়ে আহত করার ভূরি ভূরি ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। ভয়ে মানুষ ভোট কেন্দ্রে যায়নি। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে খালেদা জিয়ার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ছিল সর্বকালের সেরা প্রহসনের। ভোটারবিহীন ওই নির্বাচনে মিডিয়ার মাধ্যমে ফলাফল ঘোষণা করা হয়েছিল। সেসব এদেশের মানুষ ভুলে যায়নি। বার্নিকাট সেসব ঘটনা চাপা দিয়ে যা বলছেন তাতে ‘ঘোড়ায় ভি হাসব’ বাক্যকেই মনে পড়ে। খুলনা ও গাজীপুরের নির্বাচনে প্রাণহানির ঘটনা যেমন ঘটেনি, তেমনি সংঘর্ষও নয়। ভোটাররা নির্বিবাদে কেন্দ্রে যেতে পেরেছে, ভোট দিয়েছে। বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীরা ভয়ে হয়ত ভোট কেন্দ্রে যায়নি, এমনকি দলীয় কোন্দলের কারণে একটা অংশ তাদের প্রার্থীকে ভোট দেয়নি। বার্নিকাট সেসব খতিয়ে না দেখে বিএনপির প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী তাদের ভাষ্যকে উদ্গীরণ করে একটা হাস্যকর অবস্থা তৈরি করেছেন। তার এসব ভাষ্য মনে করিয়ে দেয় উনিশ শতকের গোড়ায় রচিত সেই ছড়াকে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘কত রঙ্গ জানোরে জাদু, কত রঙ্গ জানো।’
×