ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পর্তুগালকে কাঁদিয়ে শেষ আটে উরুগুয়ে

প্রকাশিত: ০৯:২৭, ১ জুলাই ২০১৮

পর্তুগালকে কাঁদিয়ে শেষ আটে উরুগুয়ে

রুমেল খান ॥ স্প্যানিশ ক্লাব রিয়াল মাদ্রিদের সুপারস্টার পর্তুগালের ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডোর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন বার্সেলোনার ডায়মন্ড আর্জেন্টিনার লিওনেল মেসি। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস। চলমান রাশিয়া বিশ্বকাপ থেকে দুজনের দেশই কি না বিদায় নিল একই দিনে!/ প্রচন্ড গতিশীল ফুটবল। আক্রমণ আর পাল্টা আক্রমণের বন্যা। মাঝে মাঝে শারীরিক শক্তির প্রদর্শনী। ভীষণ স্নায়ুর চাপ। পুরো খেলার শুরু থেকে একেবারে শেষ পর্যন্ত সোচির ফিস্ত অলিম্পিক স্টেডিয়ামভর্তি (৪৪,৮৭৩) দর্শকদের শিহরণ জাগানিয়া চিৎকার-উল্লাস। শনিবার রাতে এমনই এক শ্বাসরুদ্ধকর-উত্তেজনাময়-প্রতিদ্বন্দ্বিতার ম্যাচে ইউরোপের পর্তুগালকে ২-১ গোলে হারিয়ে রাশিয়া বিশ^কাপের শেষ আটে- অর্থাৎ কোয়ার্টার ফাইনালে পৌঁছে গেল লাতিন আমেরিকার দেশ উরুগুয়ে। ফিফার চতুর্দশ র‌্যাঙ্কিংধারী এবং ‘লস চারুয়াস’ খ্যাত উরুগুয়ে এখন কোয়ার্টার ফাইনালে মুখোমুখি হবে ফ্রান্সের। নিয়নির নভগরদ স্টেডিয়ামে ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হবে আগামী ৬ জুলাই। ম্যাচের ৭ মিনিটেই গোল করে এগিয়ে যায় উরুগুয়ে। ঝটিকা আক্রমণ করে তারা। মাঠের বা প্রান্তে পতুর্গালের ডি-বক্সের বাইরে বল পান তারকা ফরোয়ার্ড লুইস সুয়ারেজ। সেই বল উড়ন্ত ক্রস ফেলেন সতীর্থ আরেক ফরোয়ার্ড এডিনসন কাভানির উদ্দেশে। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার অধিকারী, ৩১ বছর বয়সী এবং ফরাসি ক্লাব প্যারিস সেইন্ট-জার্মেইনের হয়ে খেলা কাভানি যেভাবে দ্রুত বক্সের ভেতর দৌড়ে গিয়ে সেই বল দুরূহ কোন থেকে তীব্র হেডে জালে জড়িয়ে দিলেন, তা সত্যিই ছিল দেখার মতো। পর্তুগিজ গোলরক্ষক রুই প্যাট্রিসিও আপ্রাণ ঝাঁপিয়ে পড়েও বলটি রুখতে পারেননি। গোলের আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়েন দীর্ঘদেহী কাভানি, একটু পরেই সতীর্থরা যোগ দেন তার সঙ্গে (১-০)। আন্তর্জাতিক ফুটবলে পর্তুগালের বিরুদ্ধে এটাই তার প্রথম গোল। প্রথমার্ধে এই স্কোরলাইন নিয়েই বিরতিতে যায় উভয় দল। দ্বিতীয়ার্ধে খেলা শুরুর আগে টিভির পর্দায় দেখা যায় মাঠে নামার আগে টানেলে সতীর্থদের নিয়ে গোল হয়ে সংক্ষিপ্ত এক ‘টিম মিটিং’ করছেন অধিনায়ক রোনাল্ডো। তাদের উজ্জীবিত করার চেষ্টা করেন। সেই কারণেই হয়তো দ্বিতীয়ার্ধে ম্যাচ শুরুর ১০ মিনিটের মধ্যেই (৫৫ মিনিটে) দারুণভাবে সমতায় ফেরে পর্তুগাল। কর্নার পায় তারা। তা থেকে উরুগুয়ের বক্সের ভেতর বল ভাসিয়ে দেন রাফায়েল গারেইরো। জটলার মধ্যে সেই বল পর্তুগিজ ডিফেন্ডার এবং সহ-অধিনায়ক পেপে শূন্যে লাফিয়ে হেড করে উরুগুয়েন গোলরক্ষক ফার্নান্দো মুসলেরাকে পরাস্ত করেন (১-১)। ৬ ফুট ২ ইঞ্চি উচ্চতার এবং ৩৫ বছর বয়সী স্প্যানিশ ক্লাব রিয়ার মাদ্রিদের সাবেক এই ডিফেন্ডারের এটি ছিল ৯৯তম আন্তর্জাতিক ম্যাচে ষষ্ঠ গোল। গোল হজম করে ক্ষণিকের জন্য হতাশাগ্রস্ত হলেও উরুগুয়ে কিন্তু মনোবল হারায়নি। ৬২ মিনিটে গোল করে আবারও এগিয়ে যায় তারা। মিডফিল্ডার রড্রিগো বেন্টানকুরের লম্বা বাড়ানো থ্রু পাস পতুর্গালের ডি-বক্সের পান কাভানি। চলতি বলেই দারুণ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ডান পায়েই বাঁক খাওয়ানো শটে বল জালে জড়িয়ে দেন (২-১)। গোলরক্ষক এবারও ঝাঁপিয়ে শেষরক্ষা করতে পারেননি। ১০৫তম আন্তর্জাতিক ফুটবল ম্যাচে এটা কাভানির ৪৫তম, দুই বিশ্বকাপ মিলে চতুর্থ, চলমান বিশ^কাপে তৃতীয় গোল। ৭৬ মিনিটে আহত হয়ে মাঠ ছাড়েন কাভানি। তাকে ধরে ধরে মাঠ ছাড়তে সাহায্য করে প্রশংসিত হন রোনাল্ডো। কাভানির বিদায়ে উরুগুয়ের আক্রমণভাগ কিছুটা খর্ব হয়ে যায়। এই সুযোগে উরুগুয়ের ওপর চেপে বসে পর্তুগাল। উরুগুয়ে রক্ষণভাগ প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যায় সেসব ‘ভয়ংকর’ আক্রমণ আটকাতে। পর্তুগালের স্তম্ভ রোনাল্ডো এদিন সেসভাবে ঝলসে উঠতে পারেননি স্বমহিমায়। বরং খেলার শেষদিকে রেফারির সঙ্গে বাজে আচরণ করে হলুদ কার্ড দেখেন। শেষ পর্যন্ত মেক্সিকোর রেফারি সিজার আরতুরো রামোস খেলা শেষের বাঁশি বাজালে জয়ের আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়ে উরুগুয়ে এবং হতাশায় ভেঙ্গে পড়ে পর্তুগাল। এবারের বিশ্বকাপে ‘এ’ গ্রুপে উরুগুয়ে মিশরকে ১-০, সৌদি আরবকে ১-০ এবং স্বাগতিক রাশিয়াকে ৩-০ গোলে হারিয়ে ৩ খেলায় পূর্ণ ৯ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপসেরা হয়ে পা রাখে নকআউট পর্বে। পক্ষান্তরে ‘বি’ গ্রুপে পর্তুগাল স্পেনের সঙ্গে ৩-৩ এবং ইরানের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করে ও মরক্কোকে ১-০ গোলে হারায়। ৩ খেলায় ৫ পয়েন্ট নিয়ে গ্রুপ রানার্সআপ হিসেবে নাম লেখায় দ্বিতীয় রাউন্ডে। বিশ্বকাপে এই প্রথম মুখোমুখি হয় উরুগুয়ে ও পর্তুগাল। আন্তর্জাতিক প্রীতি ম্যাচে অবশ্য এর আগে দুবার মুখোমুখি হয়েছিল তারা। তাও আবার ৪৬ বছর আগে। ১৯৭২ সালের জুলাইয়ে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোর মারকানা স্টেডিয়ামে দুদলের লড়াইটি ১-১ গোলে ড্র হয়েছিল। দুদল পরস্পরের মোকাবেলা করেছে মাত্র দুবার। তাও সর্বশেষ মোকাবেলা করেছে ৪৬ বছর আগে। ফলে দুদলের বর্তমান প্রজন্মের ফুটবলাররা এই লড়াইয়ে ঐতিহ্য-ঝাঁজের ছিটেফোঁটাও পায়নি। দল দুটি হচ্ছে উরুগুয়ে ও পর্তুগাল। একটি প্রথম বিশ্বকাপের প্রথম চ্যাম্পিয়ন (মোট দুবার চ্যাম্পিয়ন, ১৯৩০ ও ১৯৫০ সালে) দল, আরেকটি এখনও বিশ্বকাপের স্বাদ না পাওয়া অভাগা দল (১৯৬৬ আসরে তৃতীয় এবং ২০০৬ আসরে চতুর্থ)। ৬৮ বছরের শিরোপা খরা ঘোঁচাতে এবার মরিয়া হয়ে আছে উরুগুয়ে। ‘দ্য নেভিগের্টস’ খ্যাত পর্তুগালের লক্ষ্য ছিল সেমির গেরো কাটিয়ে প্রথমবারের মতো ফাইনালে খেলা। ১৯৩০ ও ১৯৫০ সালের বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে ২০১০ সালে পারলেও ১৯৭৪ থেকে শুরু করে বাকি বিশ্বকাপের কোনটিতেই দ্বিতীয় রাউন্ডের গন্ডি পেরুতে পারেনি। আর ১৯৩০ সালের পর আর কখনই বিশ্বকাপের শুরুতে টানা চার ম্যাচ জেতেনি। এবার দুটোই পারল তারা। পর্তুগালের ভরসা ক্রিস্টিয়ানো রোনাল্ডো এবারের আসরে প্রথম ম্যাচে হ্যাটট্রিক করার পর দ্বিতীয় ম্যাচে এক গোল করেছিলেন। কিন্তু গ্রুপের শেষ ম্যাচে গোল পাননি, উপরন্তু মিস করেন পেনাল্টি। তার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নকআউট পর্বে এখন পর্যন্ত বিশ্বকাপে ৪২৪ মিনিট খেলে কোন গোলের দেখা পাননি। সেই গোল খরা কাটিয়ে উঠতে পারলেন না উরুগুয়ের বিরুদ্ধেও।
×