ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

সরকারকে পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান

সৌদিতে গিয়ে নির্যাতিত নারীদের ফেরার পর ঠাঁই নেই পরিবারে

প্রকাশিত: ০৭:৩৭, ১ জুলাই ২০১৮

সৌদিতে গিয়ে নির্যাতিত নারীদের ফেরার পর ঠাঁই নেই পরিবারে

জান্নাতুল মাওয়া সুইটি ॥ ‘দুই সন্তান ও বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কথা চিন্তা করে বিদেশ গিয়েছিলাম। সংসারের আয় উন্নতি হবে, সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে পারব এই স্বপ্ন নিয়ে হাজার মাইল দূরে পাড়ি জমিয়েছিলাম। কিন্তু আমি দালালের খপ্পরে সৌদিতে বিক্রি হয়ে যাই। আমাকে বলা হয়েছিল সেখানে ঘরের কাজ করতে হবে আর তাদের সন্তানদের দেখাশুনা করতে হবে। ঘরের কাজ তো করতাম তবে যৌন নির্যাতনের কারণে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলাম। তাই পালাতে বাধ্য হই সেখান থেকে। এখন দেশে ফিরেও শান্তিতে নেই আমি। পরিবারসহ আত্মীয়-স্বজন সবাই যেন আমাকে অন্য চোখে দেখছে! সেইসঙ্গে কোন কাজ পাচ্ছি না। পেট চালানো দায় হয়ে গেছে।’ আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো জনকণ্ঠকে বলছিলেন হবিগঞ্জের শায়লা খাতুন (২০) (ছদ্মনাম)। শায়লার বাবা মাটির পাতিল বিক্রি করে কোনরকম সংসার চালান। ছয় ভাই বোনের মধ্যে শায়লা তৃতীয়। স্বামী পরিত্যক্তা শায়লা তার দুই সন্তান নিয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকেন। শায়লা স্থানীয় এক দালালের সহায়তায় রিক্রুটিং এজেন্সি ফোর সাইট ইন্টারন্যাশনাল লিঃ (আর এল:০৩৪৫) এর মাধ্যমে চলতি বছরের ২ মে গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরব যান। সৌদি আরবে শায়লা তার নিয়োগকর্তা কর্তৃক প্রায়ই যৌন নির্যাতনের শিকার হতে থাকেন। এ বিষয়ে নিয়োগকর্তার স্ত্রীকে জানালেও কোন প্রতিকার পাননি শায়লা। কাজে নিয়োগ হওয়ার ১০ দিনের মাথায় নিয়োগকর্তার স্ত্রী-বাচ্চাদের নিয়ে বাহিরে গেলে নিয়োগকর্তা শায়লাকে কফি বানাতে বলে। সে রান্না ঘরে গিয়ে ম্যাচ হাতে নেয়া মাত্রই নিয়োগকর্তা তাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে। শায়লা নিয়োগকর্তার বৃদ্ধাঙ্গুলে কামড় দিয়ে নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। পরবর্তীতে হাতের ম্যাচ দিয়ে নিয়োগকর্তার জুব্বার মধ্যে আগুন লাগিয়ে দেয়। নিয়োগকর্তা তাকে ছেড়ে দিলে শায়লা বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। পথে এক বাংলাদেশী অভিবাসী কর্মীর সহায়তায় দূতাবাসে আশ্রয় নেয়। এরপর দূতাবাস শায়লার নিয়োগকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তাকে দূতাবাসে আসতে বলে। নিয়োগকর্তা এসে অভিযোগ করে শায়লা বাসা থেকে চুরি করে পালিয়েছে। তখন শায়লা তার সঙ্গে কী কী ঘটেছে তা দূতাবাসকে জানায় এবং মালিকের বৃদ্ধ আঙ্গুল দেখাতে বলে দূতাবাসের কর্মকর্তার সামনে। ঘটনার সত্যতা পেয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা শায়লাকে তার কাগজপত্রসহ ২০ মে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়। বাংলাদেশে ফেরার পর তার পরিবার তাকে আশ্রয় দিতে না চাইলেও অনেকটা মেয়ের অধিকার নিয়ে জোর করে পরিবারে ফিরে গেলেও খুব ভাল নেই শায়লা, তাকে প্রতিনিয়ত তার এবং সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য দরিদ্র পিতার পরিবারে কথা শুনতে হচ্ছে। ভাগ্যবদলের আশায় শায়লার মতো অনেক নারী কেউ এক মাস, তিন মাস, কেউ ছয় মাস, কেউবা এক বছর আগে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে সৌদি আরবে যান। সেখানে তারা নানাভাবে শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হতে থাকে। গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত সৌদি আরব থেকে ফিরেছেন প্রায় এক হাজার নারী। দেশে ফিরে সরকারের কোন সংস্থাকে পাশে পাননি এ সব নারী। এমনকি পরিবারেও ঠাঁই হচ্ছে না অনেকের। সামাজিকভাবেও হেয় হতে হচ্ছে তাদের। অভিবাসন খাতের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, ফেরত আসা নারীদের শুধু আর্থিক সহায়তা নয়, দীর্ঘমেয়াদে তাদের সমাজে পুনর্বাসন করার দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকে। এ ক্ষেত্রে শুধু সৌদি আরব নয়, মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলো থেকেও যারা ফেরত আসছেন, তাদের বিষয়েও সরকারকে ভাবতে হবে। এ বিষয়ে গৃহশ্রমিক অধিকার প্রতিষ্ঠা নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী ও বিল্্স’র নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহম্মদ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের পক্ষ থেকে প্রায়ই বলা হয় নারী কর্মীদের নির্যাতনের ঘটনা খুব কম। কিন্তু একজন নারীও যেন নির্যাতনের শিকার না হয় তার জন্যও ব্যবস্থা নেয়া জরুরী। এই পরিস্থিতিতে বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত দেশ থেকে নারীদের গৃহকর্মী হিসেবে সৌদিতে পাঠানো বন্ধ করা উচিত। সেইসঙ্গে সৌদি আরবে আইন ও নীতিমালায় আদৌ অভিবাসী নারীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করে কি-না তা সঠিকভাবে বিচার বিবেচনা করার দায়িত্ব সরকারের নীতি-নির্ধারকদের। সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসা নারীদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণের দিকটি নিশ্চিত করাটা এখন অতীব জরুরী একটি বিষয়। কারণ এসব নারী এখন অসহায়। অনেকের পরিবার তাদের আশ্রয় দিতে নারাজ। সেইসঙ্গে তারা যে নির্যাতনের সম্মুখীন হয়েছে তাতে তারা মানসিকভাবে এখনও বিপর্যস্ত। বিদেশে কাজ করতে যাওয়া প্রতিটি নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পাশাপাশি সরকারকে ফেরত আসা গৃহশ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ, স্বাস্থ্য সেবা ও প্রাপ্য মজুরি নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি। আরেক নারী ফেনী জেলার শিরিনা আক্তার (২৩) (ছদ্মনাম)। মাদকাসক্ত বেকার স্বামী প্রায়ই তাকে মারধর করত। পরিবারে তাদের ১০ বছরের একটি সন্তান আছে। সংসারের খরচ যোগাড়ের জন্য সে গার্মেন্টসের কাজে যোগ দেয়। কিন্তু মাস শেষে প্রাপ্ত বেতন মাদকাসক্ত বেকার স্বামী কেড়ে নিত। একসময় সহ্য করতে না পেরে স্বামীকে ডিভোর্স দেয় শিরিনা। সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যতের কথা ভেবে শিরিনা বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। শিরিনা রিক্রুটিং এজেন্সি হলি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল (আর এল:১১৮৮) এর মাধ্যমে ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ তারিখে সৌদি আরবে যায়। যাওয়ার আগে শিরিনা মাসে এক হাজার রিয়্যাল বেতন পাবে জেনে যায়। সৌদি আরবে যাওয়ার পর শিরিনা গৃহকর্মীর কাজ পায়, তার নিয়োগকর্তা ছিল একজন বয়স্ক মহিলা। নিয়োগকর্তার বাসায় এক মাস সাত দিন শেষ হয়ে গেলেও শিরিনা কে কোন বেতন দেয়া হয়নি। বেতন চাইলে নিয়োগকর্তা আজ দিব, কাল দিব বলে। তাছাড়া ঘুমানোর জন্য একটা দরজাবিহীন স্টোর রুম দেয়া হয়েছিল। সে রুমের আলমারিতে নিয়োগকর্তার তিন ছেলের কাপড়-চোপড় রাখা হতো। ফলে নিয়োগকর্তার ছেলেরা রাত ১২টা বা ১টায় ঐ রুমে জামা কাপড় আনতে যেত। তাই শিরিনা সারাক্ষণ ভয়ে আতঙ্কিত থাকত। তাকে পর্যাপ্ত খাবারও দেয়া হতো না। শিরিনা এজেন্সি অফিসে ফোন করে সার্বিক বিষয়ে জানায়। এজেন্সি অফিসে অভিযোগ করায় নিয়োগকর্তা তাকে অনেক মারধর করে, ঝাড়ু দিয়ে পেটায়। এমনকি নিয়োগকর্তার ছেলেরাও লাথি ও ঘুষি মেরে তাকে রক্তাক্ত করে ফেলে। পরবর্তীতে এজেন্সি অফিস থেকে তাকে অন্য নিয়োগকর্তার বাসায় দেয়া হয়। কিন্তু যে বাসায় তাকে দেয়া হয় সেটা ছিল অনেক বড় পরিবার। সেখানে শিরিনা কে প্রায় সারা দিনরাত কাজ করতে হত। রাতে মাত্র দুই ঘণ্টা ঘুমাতে দেয়া হত। তাই সুযোগ বুঝে শিরিনা ঐ বাসা থেকে পালিয়ে পুলিশের কাছে আসে। পরবর্তীতে দূতাবাসের সহায়তায় চলতি বছরের ২৮ মে বাংলাদেশে ফেরত আসে। দেশে আসার পর শিরিনা কিভাবে শূন্য হাতে বাড়ি ফিরে যাবে, তার পরিবার তাকে গ্রহণ করবে কিনা এই দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে। সে পরিবারের ফিরলেও বর্তমানে কোন কাজ না থাকায় পরিবারে ফিরে গিয়েও অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে শিরিনাকে। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, ‘পরিবারের কাছে এখন বোঝা হয়ে আছি। সন্তানকে কি খাওয়াব সেই চিন্তাতে উদ্বিগ্ন আমি। কোন সংস্থা বা সরকারের কাছ থেকে সহায়তা পাইনি।’ ২০১১ সালের এপ্রিলে সৌদি ন্যাশনাল রিক্রুটমেন্ট কমিটি বাংলাদেশ থেকে গৃহকর্মী নিতে জনশক্তি রফতানিকারকদের সংগঠন বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সিসের (বায়রা) সঙ্গে সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করেছিল। তবে সৌদি আরবে কর্মরত ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিন্স ও শ্রীলঙ্কার ১৫০ জন গৃহকর্মীর সাক্ষাৎকারে ‘শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের’ ঘটনা উঠে আসে ২০১০ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এক প্রতিবেদনে। ফলে সমঝোতা স্মারক সই হলেও কোন নারী কর্মী সৌদি আরবে যাননি। এরপর গৃহকর্মী নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে ২০১৫ সালে চুক্তি করে সৌদি আরব। সেই চুক্তিতে নারী গৃহকর্মীর ওপর জোর দিয়ে একজন নারীর বিপরীতে ২/৩ জন পুরুষ শ্রমিক নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় দেশটি। এরপরই শুরু হয় নারী গৃহকর্মী পাঠানো।
×