ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

সমাজে ঢুকে পড়া ঘুণ সরাতে প্রজন্মকে বন্ধু করে নিতে হবে...

প্রকাশিত: ০৭:৩৬, ১ জুলাই ২০১৮

সমাজে ঢুকে পড়া ঘুণ সরাতে প্রজন্মকে বন্ধু করে নিতে হবে...

সমুদ্র হক ॥ নিজের বাড়ির আঙিনায় ছেলেমেয়ে নাতি নাতনিদের নিয়ে বন্ধুর মতো গল্প করার দিনগুলো নির্বাসনে দেয়ায় বর্তমান প্রজন্ম অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। তারা আইন মান্য করা শিখছে না। কখনও অশান্ত হয়ে মরণ নেশার দিকে ঝুঁকে পড়ছে। এই প্রজন্মকে বিপথগামী করে তুলছে মাদকের কারবারিরা। সামাজিক অবক্ষয়ের ঘটনার গভীরে গিয়ে সহজভাবে এই কথাটিই উঠে আসে। আবার এই কথাটির গভীরে বাঙালীর সংস্কৃতির শিকড় গেঁথে আছে। শিকড় ছাড়া কোন জাতি টেকে না। কোন কারণে বা অনেক কারণে এই শিকড় কেটে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে বলেই প্রজন্মের একটি অংশ মরণ নেশায় বুঁদ হয়ে আছে। ওরা নিজেরাও জীবনকে মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রিয়জনকেও নানাভাবে বিব্রত করছে। দেশে জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ার পালা শুরু হওয়ায় একান্নবর্তী পরিবারগুলো ভেঙ্গে গিয়েছে অনেক আগে। ষাটের দশকে বিচ্ছিন্নভাবে গড়ে ওঠা যৌথ পরিবারগুলোও আর টেকেনি। গেল বিংশ শতকের শেষ দশক থেকেই পরিবারগুলো খ-িত হয়ে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলিতে রূপান্তরিত হয়েছে। বর্তমানে এই নিউক্লিয়ার এতটাই ক্ষুদ্র হয়েছে যে শহর ও নগরগুলোর ফ্ল্যাট বাড়িতে বাস করা এক ফ্ল্যাটের পরিবার আরেক ফ্ল্যাটের লোকজনের খবর রাখে না। নিজ পরিবারের সদস্যরা তাদের সন্তান কোথায় যাচ্ছে কি করছে সে খবরও রাখে না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় সন্তান নিজ কক্ষে প্রবেশ করে দরোজা বন্ধ করে দিয়ে লেখাপড়া করছে। তারা সত্যিই লেখাপড়া করছে না ট্যাব ল্যাপটপ স্মার্ট ফোন নিয়ে সময় ক্ষেপণ করছে এই বিষয়টির প্রতি কমই গুরুত্ব দেয়া হয়। অভিভাবকগণ খোঁজ খবর করেন কমই। সবচেয়ে বড় যে বিষয়টি উঠে আসছে তা হলো : অভিভবকগণ সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করছেন না। সন্তানদের ফ্রি করে নিতে পারছেন না। এভাবে সন্তানদের সঙ্গে অভিভাবকদের দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে। এই দূরত্ব দিনে দিনে বেশি হয়ে সন্তানরা ¯েœহ মমত্ববোধের নাগাল থেকে কখনও ছিটকে পড়ছে। যে পথ মূল্যবোধের পরিবর্তে বিপথের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সমাজ নিয়ে ভাবেন এমন একজন শিক্ষাবিদ ড. ত্বাইফ আল মামুন বলেন, সমাজের প্রত্যেক মানুষ যদি এগিয়ে না আসে তাহলে কি সম্ভব ঘুণ পোকায় ধরা সমাজকে পরিষ্কার করা! বিজ্ঞানের মতে মানুষের নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থা স্নায়ু। এই স্নায়ু তৈরি করে ইন্দ্রিয়। মানুষের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের অযাচিত ব্যবহারের পর অথবা অতি প্রয়োজনের মুহূর্তে কোন ইন্দ্রিয় বিকল হলে অস্বাভাবিক গতিতে এগিয়ে আসে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় (ইংরেজীতে সিক্সথ সেন্স)। সর্বশেষ এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ব্যর্থ হলে মানুষ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে অনেক কিছুই করতে পারে। আবার এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে একজন শিশু ধী-শক্তিতে নিজেকে গড়ে তোলে। এই শক্তির উৎস ঘরের আঙ্গিনায়। যেখানে বাবা-মা, নানা-নানি, দাদা-দাদি, আত্মীয় স্বজনের পরিম-লে কোন অশুভ ছায়া প্রবেশ করতে পারে না। শিশুরা সেই অশুভ বলয়ের প্রভাবমুক্ত হয়ে গড়ে ওঠে। অর্থাৎ ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়কে কাছে রাখতে পঞ্চম ইন্দ্রিয়ের সার্থকতা আনতে হবে আগে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, শিশুর মস্তিষ্কে স্নায়ুতন্ত্রের সর্বাধিক বিকাশ ঘটে ৮ বছরের মধ্যে। ৮ বছরের মধ্যে পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার যত বেশি হবে শিশুর মেধা তত বিকশিত এবং টেকসই হয়ে শাখা প্রশাখায় সম্প্রসারিত হবে। পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের সঠিক সার্থক ও সুষ্ঠু ব্যবহার তখনই হবে যখন নিজের ঘরের ভেতরের পরিম-লে বা ঘরের আঙ্গিনায় একান্ত আপনজনের ও স্বজনদের সান্নিধ্য গড়ে তোলা যাবে। এই জায়গাটিতেই ভয়ঙ্কর ফাটল ধরায় আজকের এই পরিণতি। আধুনিক যতই যুক্তি দেখানো হোক অপার স্নেহ, মমত্ববোধ ভালবাসার কোন বিকল্প যুক্তি নেই। স্বর্গীয় অনুভূতি মেলে সন্তানের প্রতি বাবা-মায়ের ভালবাসায়। এরপর পর্যায়ক্রমে আপনজন। উচ্চ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা বলেন শিশুর নিউরন কানেকশন টেকসই করতে (অর্থাৎ শিশুকে পরিবারের পরিম-লের ভেতর থেকে গড়ে তুলে আনতে) সরকারের এক টাকা ব্যয় পরবর্তী সময়ে ৭ টাকা বাড়তি খরচ সেভ করবে। এ জন্য ‘আর্লি চাইল্ডহুড প্রেগ্রাম’ হাতে নেয়া দরকার। একজন মনোবিজ্ঞানী বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের ছেলেমেয়েরা (বেশিরভাগ অংশ) যে পর্যায়ে আছে যা স্বল্প ঝুঁকির মধ্যে। তার অর্থ এই নয় যে ‘যাক বাঁচা গেল’ বলে চিন্তা মুক্ত থাকা। এই স্বল্প ঝুঁকি কোন সময় মারাত্মকও হতে পারে। তখন সামাল দেয়ার পথ থাকবে না। সুতরাং এর আগেই পারবারিক পরিম-লকে সাজিয়ে নিতে হবে। একটা সময় দেশে একান্নবর্তী পরিবার ছিল। সেই সময়ের প্রজন্ম (বর্তমানের প্রবীণ ও মধ্যবয়সী) বেড়ে উঠেছে আবেগবিহীন বাস্তবতার স্নেহ ভালবাসার বন্ধনে। তখন আপনজন এবং আত্মীয় স্বজনের ভালবাসার বন্ধন ছিল ম্যান্ডেটরি (বাধ্যতামূলক)। স্বজনের কোন ঘরের কোন ছেলে কি করল, কোথায় গেল, কার সঙ্গে মিশল, ঘরে কখন ফিরল, বিদ্যালয় ঠিকমতো গেল কি না, মাস্টার মশাই কি রিপোর্ট দিলেন সবই থাকত নখদর্পণে। এর মধ্যেই সন্তানদের শাসন করা হতো। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার “শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে ..” কথার মতোই শাসন হতো স্নেহের সুরে। বর্তমানে তা উল্টে গিয়ে হয়েছে শাসনের সুরে স্নেহ। একবিংশ শতকের প্রযুক্তির অগ্রসরতার এ যুগের প্রজন্ম তা যে সহজে মানবে না সেটা তো নিজেদের ভাবনাতেই বুঝে নেয়া যায়। এ জন্য এ যুগের পরিবেশ তৈরি করতে হবে নিজেদের সমাজের মধ্য থেকেই। আজ একান্নবর্তী পরিবার, যৌথ পরিবার নেই ঠিকই তবে খ-িত পরিবারের বন্ধন তো টিকে থাকার ব্যবস্থা আছে। সন্তানেরা যদি প্রযুক্তি নির্ভর হয় অভিভাবকদেরও তো প্রযুক্তির আওতায় এসে সন্তানকে কাছে নিয়ে গল্প করা দরকার। সেদিনের গল্পের সঙ্গে আগামী দিনের গল্প। একটা সময় প্রতিটি পরিবারের কর্তা ব্যক্তি ঘরের আঙ্গিনায় (বা যে কোন কক্ষে) বসে নানা ধরনের গল্প করতেন। বাড়ির কর্তা চাকরিজীবী হলে তার জীবনের কথা, গৃহিণীর পড়া কোন উপন্যাসের কথা, জীবনের ঘটে যাওয়া এবং শোনা কোন ঘটনা গল্পের মতো করে শোনাতেন। এর মধ্যে ‘কার্টিসি’ (ভদ্রতা) একে অপরের প্রতি সহানুভূতি, পারিবারিক বন্ধন অটুট রাখতে একে অপরের বাড়িতে যাওয়া, বিনোদনের জন্য গান শোনা, নাটক দেখা গ্রামে কবি গান পালা গান কখনও যাত্রা পালা দেখাসহ নানা অনুষঙ্গ উঠে আসে এইসব গল্পে। প্রযুক্তিকে সঙ্গে নিয়েই সেই ধারা যতদিন না গড়ে তোলা যায় ততদিন প্রস্তুত থাকতে হবে আরও ভয়ঙ্করের মুখোমুখি হওয়ার জন্য।
×