ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুমন্ত গুপ্ত

হস্তশিল্প পণ্যের বাজার দেশের সীমানা ছাড়িয়ে

প্রকাশিত: ০৭:৩৫, ১ জুলাই ২০১৮

হস্তশিল্প পণ্যের বাজার দেশের সীমানা ছাড়িয়ে

দেশের ঐতিহ্যবাহী হস্ত শিল্পের কদর বাড়ছে। দেশের বাজারে যেমন এর কদর বাড়ছে, তেমনি বিদেশের বাজারেও। ফলে এ শিল্পের উদ্যোক্তার সংখ্যাও বাড়ছে; বাড়ছে বিনিয়োগ ও রফতানি। প্রাচীনকাল থেকেই সামাজিক ঐতিহ্যের কারণে বাংলাদেশের মেয়েরা অল্প বয়সেই সুচি শিল্পে পারদর্শী হয়ে উঠত। এই সুচি শিল্পে পারদর্শী হয়ে ওঠার পেছনে কোন পেশাদার প্রশিক্ষকের ভূমিকা বা অবদান ছিল না । দাদি , নানি, মা, খালাদের কাছ থেকে শিখে শিখেই আগে কার যুগের নারীরা সুচি শিল্পের অসাধারণ জ্ঞানার্জন করতেন, সুই-সুতার মিশ্রণে কাপড়Ñ চটের মতো সাধারণ জিনিসে তৎকালীন গ্রামবাংলার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক পরিবেশের চিত্র ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করতেন তার ক্যানভাসে। কখন ও কখন ও এদেশের নারী- শিশুকে সুই-সুতার মিশ্রণে কাপড় বা চটে নকশা দার প্রতি চিত্র অঙ্কন করে মানুষকে ইতিহাস সচেতন করে তুলেতেন। আবার কখন ও কখন ও নকশাদার প্রতিচিত্র অঙ্কন করে বর্ণিল বিচিত্র রঙের সমাবেশ ঘটিয়ে তৎকালীন গ্রাম বাংলার সামগ্রিক জন জীবনের সুখ-দুঃখ তারা ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন কাপড় বা চটে। দক্ষ চিত্রশিল্পী যেমন ক্যানভাসে ছবি এঁকে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখে তেমনি বাংলার নারীরা ও প্রাচীনকাল থেকে তাদের সুই-সুতায় বোনা কাপড় বা চটের অসাধারণ চিত্রকর্ম কে দীর্ঘ স্থায়ী করতে সুনির্দিষ্ট নকশা দার কাপড় বা চট কে বাঁধাই করে দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখত যাকে ইংরেজীতে ওয়াল ম্যাট বলা হয় । স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সাল থেকে ক্ষুদ্র পরিসরে ব্যক্তি পর্যায়ে হস্তশিল্প রফতানি শুরু“হয়। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রথম নিটল ক্রাফট ঝুড়ি (বাস্কেট) রফতানি শুরু“করে। ধীরে ধীরে এর সঙ্গে যুক্ত হয় আর ও অনেক প্রতিষ্ঠান। বাংলা ক্রাফেটর হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে কারুপণ্য রংপুর, ঢাকা ট্রেড, আস্ক হ্যান্ডি ক্রাফ্টস , কুমুদিনি , আড়ং, নিপুণ ক্রাফ্টস, সানট্রেড, হিড হ্যান্ডি ক্রাফ্টস, ক্রিয়েশন, পাইওনিয়ারসহ প্রায় ৫০টি প্রতিষ্ঠান হস্তজাত পণ্য রফতানি করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে ৩৯ হাজার ডলার রয়তানি হয়। পরবর্তী ১৩ বছরের মধ্যে ১৯৮০-৮১ অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৩৪ লাখ ৪৯ হাজার ডলার রফতানি আয় হয়। তবে এর আগের অর্থবছরে ও ৩৩ লাখ ৭২ হাজার ডলার মূল্যের হস্ত পণ্য রফতানি হয়। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুসারে, গত ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই খাত থেকে প্রায় দেড় কোটি ডলার বা ১২৫ কোটি টাকা রফতানি আয় হয়েছে। গত ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ও আয় হয়েছিল প্রায় ১ কোটি ডলার বা ৮২ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে রফতানি আয় বেড়েছে ৬৮ লাখ ডলার। বর্তমানে হস্তশিল্পের মধ্যে শতরঞ্জি, ঝুড়ি, পাটের তৈরি থলে ও পাপোস, টেরাকোটা, মোমবাতি, নকশিকাঁথা, পাখির খাঁচা, বাঁশ ও বেতের বিভিন্ন সামগ্রী, চামড়ার তৈরি মুদ্রার বাক্স, কয়েন বক্স, ফুলদানি, মানিব্যাগ, চাবিররিং, মোবাইল ব্যাগ, বেল্টসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য রফতানি হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে এসব পণ্য আমেরিকা, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, জাপান, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, সুইডেন, পোল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নেদারল্যান্ডসসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। বাংলা ক্রাফটের নিবন্ধিত সাড়ে পাঁচ শ’ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা অনেকেই রফতানি শুরু করেছে। বর্তমানে সবার নজর পোশাক শিল্পের দিকে। কিন্তু পোশাক শিল্পে শ্রম ছাড়া বাকি সবই আমদানি করতে হয়। ফলে খাতটিতে বিপুল পরিমাণ আয় হলে ও এর প্রায় ৭৫ শতাংশই বাইরে চলে যায়। কিন্তু হস্তজাত পণ্যের প্রায় শত ভাগই দেশীয় উপাদান ও প্রযুক্তিতে হয়। তাই বড় উদ্যোক্তার উচিত, এই খাতে বিনিয়োগ করা। শুধু রফতানি বাজার নয়, দেশের বাজারে ও এসব হস্ত শিল্প-পণ্যের চাহিদা বাড়ছে। ঈদ ও পয়লা বৈশাখের মতো বড় বড় উৎসবে দেশীয় পোশাকের পাশাপাশি এ সব দেশীয় পণ্য বিক্রি বাড়ছে । আর হস্তজাত পণ্য শতভাগ দেশীয় উপাদান হওয়ায় এখাত থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পুরোটাই দেশে থেকে যাবে।
×