ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গৌরব ও ঐতিহ্যের ৯৭ বছর

প্রকাশিত: ০৭:৩৩, ১ জুলাই ২০১৮

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গৌরব ও ঐতিহ্যের ৯৭ বছর

৯৮-এ পা দিয়েছে আজ। বৃদ্ধকাল? মোটেই না। সামনে সময় অফুরন্ত। দায়িত্বভারও বেশ। বলা হচ্ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। জাতি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তার পাশে সর্বক্ষণিক সঙ্গে রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়টি। নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছে সম্মুখপান থেকে। দিয়ে যাবে- এমনটাই বিশ্বাস। স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে যেমন রক্ষা করা কঠিন, ঠিক তেমনই জাতির জন্ম দিয়ে তাকে বড় করে তোলাও তেমনই কঠিন। সে বন্ধুর পথ পাড়ি দিতেও প্রস্তত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সে পথেই আরও এক কদম পড়ল। ৯৭ থেকে ৯৮-এ পড়েছে এটির পথচলা। বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহক, নতুন একটি দেশের অভ্যুদয়ের সাক্ষী, স্বাধীনতা-সংগ্রামের পথপ্রদর্শক এ বিশ্ববিদ্যালয়। তৎকালীন অবিভক্ত ভারতবর্ষে অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে পূর্ববঙ্গে ১৯২১ সালের ১ জুলাই যাত্রা শুরু করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেই থেকে শুরু, গুটি গুটি করে আজ অবধি টিকে আছে দেশের সর্বোচ্চ জ্ঞানের আধার হিসেবে। দেশব্যাপী আলো বিতরণ করে যাচ্ছে এটি। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রেই রয়েছে এর মশালবাহী কেউ না কেউ। জন্মেই স্বাধীন জাতিসত্তার বীজ বপন করেছে এ বিশ্ববিদ্যালয়। আজও দেশসেরা এ বিদ্যানিকেতন নতুন নতুন দিগন্তের উন্মোচন করে যাচ্ছে মানুষের কাছে। শুধু ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে নয়, যুগের পর যুগ জন্ম দিয়ে যাচ্ছে নতুন নতুন ইতিহাসের। শুরু থেকে আজ অবধি ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, বঙ্গভঙ্গ রদের পর বাংলার মুসলমানদের দাবির প্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ববঙ্গ শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনীতি এসব ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও তা রদের মাধ্যমে এ অঞ্চলের মানুষকে আবার পিছিয়ে দেয়া হয়। ফলে এদেশের মানুষের গণদাবির মুখে ব্রিটিশ সরকার এখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়। সেদিন থেকে আজ অবধি জ্ঞানের আলো বিতরণে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর আদর্শ ও পথপ্রদর্শক এ বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হওয়ার পর ১৯১২ সালের জানুয়ারিতে ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, ধনবাড়ির নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী আর শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে তৎকালীন ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জের কাছে পূর্ববঙ্গে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের আবেদন করেন। সে বছরই ২ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন ভাইসরয়। ২৭ মে বেঙ্গল গবর্নমেন্ট গঠিত ব্যারিস্টার রবার্ট নাথানের নেতৃত্বে উত্থাপিত প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পটভূমি তৈরি হয়। ১৯১৩ সালে নাথান কমিটির ইতিবাচক রিপোর্ট আর ১৯১৭ সালের স্যাডলার কমিশনের রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে ১৯২০ সালের ১৩ মার্চ ভারতীয় আইন সভা পাস করে ‘দি ঢাকা ইউনিভার্সিটি এ্যাক্ট (এ্যাক্ট নং-১৩) ১৯২০।’ ছাত্রছাত্রীদের জন্য বিশ্ববিদ্যায়ের দ্বার উন্মুক্ত হয় ১৯২১ সালের ১ জুলাই। সে সময়ের ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত ও সৌন্দর্যম-িত রমনা এলাকায় প্রায় ৬০০ একর জমির ওপর পূর্ববঙ্গ এবং অসম প্রদেশের পরিত্যক্ত ভবনাদি এবং ঢাকা কলেজের (বর্তমান কার্জন হল) ভবনসমূহের সমন্বয়ে মনোরম পরিবেশে গড়ে ওঠে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাধীনতার পানে এগিয়ে চলা বঙ্গভঙ্গে ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা বেশ প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তখন থেকেই ভারতবর্ষের মানুষ উপলব্ধি করতে পারছিল যে, ব্রিটিশদের অধীনে থাকা যাবে না। দাঙ্গা-হাঙ্গামা ও ভারত বিভক্তি আন্দোলনের শুরু হয় সে সময়কালেই। চল্লিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে রাজনৈতিক সচেতনতা দেখা যায়। বিশেষ করে অধিকাংশ মুসলমান ছাত্র-শিক্ষকদের সমর্থন ছিল পাকিস্তান আন্দোলনের প্রতি। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনেও এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই প্রথম যোগ দেয়। যার শুরু ভাষা আন্দোলন দিয়ে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বিভিন্ন রাজনৈতিক জটিলতায় ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামক দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র করে দিতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ সরকার। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত প্রদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে এ দেশের মানুষের আশা-আকাক্সক্ষা উজ্জীবিত হয়। নব উদ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকা- শুরু হয়। এক সময় বাঙালী জাগরণের মহাশক্তির প্রতীক হয়ে দাঁড়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশেষ করে জাতির সঙ্কট ও দুর্দিনে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা জাতিকে সঠিক দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছেন বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে, ষাটের দশকে সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে গণঅভ্যুত্থান সৃষ্টি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ। ৬২’র শিক্ষানীতি আন্দোলন, ঊনসত্তরের আন্দোলন শেষে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গণজাগরণ এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাপরবর্তী নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ এ ভূখ-ের সব ঐতিহাসিক গণআন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে এ প্রতিষ্ঠান। ১৯৪৮ সালে মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির মধ্য দিয়ে যে সংগ্রামের শুরু বায়ান্নতে সেই আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতি রক্তের আখরে। ভাষা আন্দোলনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অবদান আর বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রথম প্রতিবাদ থেকে শুরু করে রক্তাক্ত শেষ অর্জন পর্যন্ত নেতৃত্বের আসনে সমাসীন ছিল এ বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অদম্য স্পৃহাই জয় ছিনিয়ে এনেছিল। ভাষার জন্য রাজপথের এ আত্মদান গোটা দেশে আন্দোলনের দাবানল ছড়িয়ে দেয়। একপর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়া হলেও যার রেশ থেমে যায়নি। বাঙালী জাতিসত্তার বিকাশের অগ্রযাত্রা শুরু থেকে ১৯৭১-এর স্বাধীনতাযুদ্ধ পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়েছে গৌরবময় ভূমিকা। তাই স্বাধীনতাযুদ্ধে এ বিশ্ববিদ্যালয় পাকিস্তানীদের রোষের শিকার হয়। হানাদার বাহিনী এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং ছাত্রছাত্রীসহ অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে। এমনইভাবে দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কা-ারীদের আঁতুড়ঘর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্ঞানের আলো নিয়ে আলোকিতজনেরা ছড়িয়ে আছেন দেশের সর্বত্র। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত এখান থেকে জন্ম নিয়েছেন হাজারো মনীষী, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক, কূটনীতিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিল্পপতি। পুরো জাতির উচ্চশিক্ষা ও আশা-আকাক্সক্ষার প্রতীক এ বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিপুল জাগরণের সঞ্চার করেছে। জাতীয় সব গুরুত্বপূর্ণ কাজে নেতৃত্ব দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থান করে নিয়েছে আপামর জনসাধারণের হৃদয়। শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি দেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নানা কর্মকা-সহ দেশের সকল নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান অনস্বীকার্য। সুদীর্ঘ এই ৯৫ বছরের পথচলায় বিশ্ববিদ্যালয় এ দেশকে দিয়েছে অনেক কিছু। কুড়িয়েছে গৌরব, খ্যাতি, সম্মান। প্রতিষ্ঠালগ্নের শিক্ষকদের মধ্যে মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, হরিদাস ভট্টাচার্য, রমেশচন্দ্র মজুমদার, স্যার এ এফ রহমান, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ প্রত্যেকেই এক একটা অবিস্মরণীয় নাম। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জনক ও প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদÑ সবাই এ প্রতিষ্ঠানের কৃতী শিক্ষার্থী, এক একটা আলোকচ্ছটা। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এ সংগঠকরা প্রত্যেকেই পথ দেখিয়েছেন দেশের মানুষকে। মন্ত্রিপরিষদের অধিকাংশ বর্তমান ও সাবেক অনেক সদস্যই এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। ছাত্র আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র সকল ছাত্র আন্দোলনের সূত্রপাত হয় এখান থেকেই। ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং তৎপরবর্তী সকল আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নেতৃবৃন্দের অবদান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য। প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন থেকে শুরু করে সম্মুখসারিতে যুদ্ধ করে এরাই ছিনিয়ে এনেছেন বিজয়। বর্তমান সময়ে ছাত্ররাজনীতির বিপর্যস্ত অবস্থা চললেও এখনও সব ছাত্রসংগঠনের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু এই প্রাঙ্গণ। সব ছাত্রসংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এখান থেকেই সৃষ্টি হচ্ছে। পাশাপাশি মধুর ক্যান্টিন এখনও ছাত্র রাজনীতির অন্যতম মহামিলনস্থল। ঐতিহাসিক স্থাপনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে রয়েছে দেশের বেশ কিছু ঐতিহাসিক স্থাপনা যা দেশের মানুষকে আকৃষ্ট করে। এর মধ্যে কার্জন হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, দেশের একমাত্র গ্রীক নিদর্শন, গুরুদুয়ারা নানক শাহী, জাতীয় জাদুঘর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম সমাধিসৌধ, তিন নেতার মাজার প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ক্যাম্পাস প্রতিবেদক
×