ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বর্ষায় কদর এই মেরামতকারীদের

আ-ছে ছেঁড়া-ফাটা কলপি বাঁকা স্প্রিং নষ্ট, লাঠিভাঙ্গা ছাতা...

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১ জুলাই ২০১৮

আ-ছে ছেঁড়া-ফাটা কলপি বাঁকা স্প্রিং নষ্ট, লাঠিভাঙ্গা ছাতা...

সমুদ্র হক ॥ আকাশে মেঘ। বৃষ্টির আভাস। পথে বের হয়েছেন। সঙ্গে ছাতাটিও নিয়েছেন। বৃষ্টি ঝরা শুরু হলো। বাতাসও উঠল। ছাতাটি মেলে ধরলেন। হঠাৎ বাতাসের ধাক্কায় ছাতাটি গেল উল্টে। স্প্রিং খসে পড়ল। কিই না বিপাকে পড়তে হয় তখন। বর্ষায় এমন অবস্থা অনেকেরই হয়েছে। যারা প্রবীণ ও মধ্যবয়সী তারা এই অংশটুকু পড়ে হয়ত স্মৃতিকাতর হতে পারেন। বছরের অনেকটা সময় ঘরের কোণেই থাকে। হয়ত কোথাও ঝুলিয়ে রাখা হয়। আধুনিক ছাতা ফোল্ড করে আলমারি অথবা ওয়ার্ডরোবেও রাখা হয়। ধুলোও জমে। ছাতা মেললে ধুলা উড়িয়ে সোজা নাসিকায়। যাদের ধূলি এ্যালার্জি আছে শুরু হয় হাঁচির উৎপাত। এ আরেক যন্ত্রনা। তবু ওই ছাতা নামের বস্তুটি হাতে না নিলেই নয়। কারণ বাইরে অঝোর ধারায় বৃষ্টি। বারিধারার দিন এসেই গেছে। এর মধ্যেই গ্রামের মেঠোপথে ছাতা মেরামতেকারী টাইকরদের হাঁক শোনা যায়: আ...ছে ছেঁড়া...ফাটা, কলপি বাঁকা...স্প্রিং নষ্ট, লাঠি...ভাঙ্গা ছা...তা...। টনক নড়ে গৃহস্থ কিষান চাষী মজুরদের। কখন বৃষ্টি নামবে কেউ জানে না। আকাশে কালো মেঘ দেখলেই বলাবলি হয় এই নামল বলে। এই সময় ছাতা ঠিক না থাকলে কি চলে! নগরীতে সামান্য বৃষ্টিতেই রিক্সাচালকরা চড়া ভাড়া দাবি করে। তখন মনে হয় বড় জলজটের মধ্যে ডুবসাঁতার দিয়েই বাড়ি পৌঁছা ভাল। এই অবস্থায় একমাত্র সাহায্যকারী বস্তুটির নাম ছাতা। গ্রামের পথ ও হাটবাজার ছাড়াও ছাতা মেরামতকারী টাইকররা শহর ও নগরীর কোন স্থানে পথের ধারে বসে। বর্তমানে কত রকমের যে ছাতা এসেছে...। ছাতার হাতলের সঙ্গে সুইচ টিপলেই মেলে ওঠে। ছাতা যত বড়ই হোক বহনের কত সুবিধা এখন। স্প্রিং ও স্টিল কর্ডে ছাতার টানির প্লাস্টিকের অংশকে নানা কায়দায় ছোট করে ছেলেরা প্যান্টের লুপের সঙ্গে এঁটে, মেয়েরা ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে বহন করতে পারে। ছাতার হাতলেও এসেছে কত পরিবর্তন। একটা সময় ছাতার হাতল বাংলা ‘ট’ বর্ণের মতো বাঁকানো থাকত। বর্তমানে এই বাঁকানোকে কতই না দৃষ্টিনন্দন করে তোলা হয়েছে। ছাতার কাপড়েও এসেছে পরিবর্তন। এখন কালো কাপড়ের ছাতার সঙ্গে নানা বর্ণের কাপড় ব্যবহার হয়। কোন কাপড়ে নক্সাও থাকে। ছাতা যত দৃষ্টিনন্দনই হোক; মেলতে না চাইলে, কখনও উল্টোমুখি হলে, কখনও ভেতরের কোন পার্টসের জন্য বা সেলাই খুলে গেলে মেলতে অসুবিধা হলে টাইকর ছাড়া গতি নেই। ছাতা মেরামতের এসব কারিগরের নাম অঞ্চলভেদে ভিন্নতাও আছে। নামে যাই থাক তাদের ব্যাগে ছাতা মেরামতের যন্ত্র একই। সুঁই-সুতো, ছোট্ট হাতুড়ি, সাঁড়াশির সঙ্গে টুকরো কাপড়, ছাতার ভেতরের রিং-স্পোক, কাঁটা, গুনাসহ কত জিনিসই থাকে। একজন টাইকর বললেন, ছাতা মেরামত করার সময় কোন জিনিস ফেলে দেয়া হয় না। নতুন করে পাল্টে নেয়ার পর ওই ভাঙ্গা টুকরো রেখে দেয়া হয়। যাদের ছাতায় সামান্য খুঁত আছে সেখানে বসিয়ে দেয়া হয়। এই টাইকররা এতটাই এক্সপার্ট যে ছাতার যে কোন জায়গায় দ্রুত মেরামত করে দিতে পারে। এই ছাতা বছরের অনেকটা সময় ঘরে বন্দী থাকে। ধুলো মুছে যতœাদি তো দূরে থাক খোঁজও কেউ নেয় না। ছাতাটা ‘অসুস্থ’ হলো না ‘মরল’ (অর্থাৎ কোথাও নষ্ট হলো না ইঁদুর কাটল)। কে রাখে খোঁজ। বাইরে তখন ফুরফুরে আবহাওয়া। কিছুদিনের জন্য ছাতার কদর প্রায় ফুরিয়েই যায়। প্রকৃতিতে যেই বৃষ্টি ঝরার পালা শুরু অমনি খোঁজখবর; কোথায় আছে বৃষ্টির বন্ধু ছাতা। একটা সময় গল্পে-উপন্যাসে-চলচ্চিত্রে গ্রামের মানুষের চরিত্রচিত্রনে ছাতাকে টেনে আনা হতো। চামচারা ছাতা মেলে ধরত প্রভাবশালীর মাথার ওপর। গৃহস্থ ও কিষানরা গ্রীষ্ম-বর্ষায় ছাতা ছাড়া ঘর থেকে বের হয় না। ছাতা কখনও মর্যাদার প্রতীক। ছাতা হাতে গ্রামের স্কুলের মাস্টার মশাইয়ের পথ চলা প্রতীকী পরিচয়ের। একটা সময় পায়জামা-পাঞ্জাবি পরা ঘটকের হাতে বা বগলের নিচে ছাতা থাকতই। নির্বাচনের সময় প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দে পছন্দের তালিকায় ছাতা ওপরের দিকে থাকে। ছাতার এই পছন্দ প্রতীকী পথচলার সঙ্গে মাটির স্পর্শের মাটির গন্ধে প্রাণের আকুলতায় বেড়ে ওঠা মানুষের পরিচয় বহন করে। রোদেলা তাপ, বৃষ্টির ধারা থেকে মুক্তির ছোট্ট একটি বস্তুর প্রয়োজনটা যে কত তা মৌসুমই বলে দেয়। যাই হোক, এই ছাতা আবিষ্কার হয়েছে বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য নয়। চীন প্রথম ছাতা আবিষ্কার করে রোদ থেকে রক্ষার জন্য। পরবর্তী সময়ে রোদ থেকে রক্ষার সঙ্গে বৃষ্টি থেকেও রক্ষা করে ছাতা। বর্ষায় ছাতা ঠিক না থাকলে পথ চলাই দায়। মধ্যবিত্ত ও স্বল্প আয়ের মানুষ ছাতা হাতেই ঘর থেকে বের হয়। যাদের গাড়ি আছে ছাতা ব্যবহার না করলেও চলে। মোটরসাইকেল চালকদের রেইনকোট দরকার। অনেকেই রেইনকোট পরে পথ চলেন। তবে ছাতার কদরই আলাদা। আবার এই ছাতা হারায়ও বেশি। বৃষ্টির সময় ছাতা হাতে বের হওয়ার পর রোদ উঠলে ছাতা নেয়ার কথা মনে থাকে না। ছাতা হারিয়ে যাক আর নাই যাক; বৃষ্টিতে ছাতার আকর্ষণ মানব জীবনের রোমন্টিকতার চাইতে কম নয়। ভাঙ্গা রোমান্স জোড়া দেয়ার কারিগর হয়ত নেই, ভাঙ্গা ছাতা জোড়া দিয়ে সারিয়ে তোলার কারিগর টাইকররা আছে। ওরা বৃষ্টিতে ভিজলেও মানুষকে ভিজতে দেয় না।
×