ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির চাপে থাকবে দেশ

প্রকাশিত: ০৫:১১, ১ জুলাই ২০১৮

নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির চাপে থাকবে দেশ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার ॥ নতুন অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির চাপে থাকবে দেশ। নির্বাচনকে সামনে রেখে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ‘নির্বাচনকেন্দ্রিক’ প্রকল্প বাস্তবায়নের তাড়া থাকবে সরকারের। এতে বাজারে বাড়বে অর্থের জোগান। এ সময়ে খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে থাকলেও খাদ্যবহির্ভূত পণ্যের মূল্যস্ফীতি বাড়বে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে সার্বিকভাবে বছরটিতে দেশ থাকবে মূল্যস্ফীতির চাপে। বিদায়ী অর্থবছরের (২০১৭-১৮) চেয়ে দশমিক শূন্য এক শতাংশ বাড়িয়ে নতুন অর্থবছরের (২০১৮-১৯) বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৬ শতাংশ। শেষ হতে যাওয়া অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি মূল্যস্ফীতির পারদ। হাওড়ে আকস্মিক বন্যায় গত বছরের বোরো মৌসুমে যে ক্ষতি হয়েছিল তা পুষিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। চলতি মৌসুমে ‘বোরোর বাম্পার ফলন’ হলেও আশানুরূপ কমেনি চালের দাম। আবার চাল আমদানিতে যে শুল্ক কমানো হয়েছিল, নতুন অর্থবছরে তা নেয়া হয়েছে আগের অবস্থায়। এসব বিষয় নিয়েও মূল্যস্ফীতি সম্পর্কে আশঙ্কা আছে বিশ্লেষকদের। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ছে। ডলারের বিপরীতে টাকা অনেকটা অবমূল্যায়িত হয়েছে, ভবিষ্যতে আরও হতে পারে। এতে আমদানি ব্যয় আরও বাড়বে। এ ছাড়া তেলের দাম বাড়ার কারণে পরিবহন খরচ বাড়তে পারে। যেহেতু সরকার বড় বাজেট বাস্তবায়ন করছে, সঠিক পরিমাণে আমদানি হচ্ছে এবং আমদানির কারণে মুদ্রা সরবরাহ বাড়াতে হচ্ছে, ফলে মুদ্রা সরবরাহজনিত কারণেও এক ধরনের মূল্যস্ফীতির ঘটনা ঘটতে পারে। আগামী দিনে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যস্ফীতি হয়ত বাড়বে। বর্তমানে মূল্যস্ফীতি প্রত্যাশিত পর্যায়েই রয়েছে জানিয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ও অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ বলেন, আশঙ্কাটা হচ্ছে, সামনে নির্বাচনের সময়ে লেনদেন ও টাকাপয়সার চাপ বেড়ে যেতে পারে। নতুন বাজেটে অনেক প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে, যার বেশিরভাগই অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে বাস্তবায়নের চেষ্টা করা হবে। সব মিলিয়ে টাকাপয়সার লেনদেন বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর একটি চাপ পড়ে এবং তা বাড়ার প্রবণতা থাকে। তার মতে, বর্তমানের মূল্যস্ফীতি নিয়ে ভাবনার তেমন কিছু নেই। বরং আগামী ছয় মাস কিভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়, তা নিয়েই ভাবতে হবে। আর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) গবেষণা পরিচালক ও অর্থনীতিবিদ ড. মাহফুজ কবীর বলেন, আমার মতে, একটা মূল্যস্ফীতির ধাক্কা সামনে আসতে পারে এবং সেটা হবে খাদ্যবহির্ভূত খাতে। এবং সেই ধাক্কাটা পুরো মূল্যস্ফীতিকেই প্রভাবিত করবে। হয়ত সেটাকে মাথায় রেখেই সরকার মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা বাড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো কিংবা মূল্যস্ফীতির বর্তমান হার নিয়ে ‘উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই’ বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ড. নাজমা বেগম। তবে, নির্বাচনী ব্যয় বাড়লে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব পড়তে পারে বলে মনে করছেন তিনিও। অর্থনীতির এই অধ্যাপক বলেন, নির্বাচনী ব্যয় বাড়লে তখন সরকারী ব্যয়ও বাড়বে। মানুষের চাহিদা ও ভোগ বাড়বে, সামগ্রিক চাহিদা বেড়ে যাবে। তখন জোগান যদি সে পরিমাণে বাড়ানো না যায়, তাহলে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। বিদায়ী অর্থবছরের কয়েক মাসের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী মূল্যস্ফীতির পারদ ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। এর আগে, কয়েক বছর ধরেই মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা কমেছে। সেই সঙ্গে নিয়ন্ত্রণে রাখা গেছে মূল্যস্ফীতির পারদও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, ২০১২-১৩ অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বছর শেষে ১২ মাসের প্রকৃত মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৭ শতাংশ মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হলেও তা নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব হয়নি। অর্থবছর শেষে দেখা যায়, ১২ মাসের প্রকৃত মূল্যস্ফীতি ছিল ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। বিশ্লেষকরা বলছেন, ২০১৩ সাল ছিল নির্বাচনের। ফলে অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে অর্থের প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় নিয়ন্ত্রণে থাকেনি মূল্যস্ফীতি। তবে পরবর্তী ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬ ও ২০১৬-১৭ অর্থবছরেও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণেই ছিল। বিবিএস’র তথ্যমতে, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৬ দশমিক ৫ শতাংশ, বছর শেষে প্রকৃত মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ৬ দশমিক ২ শতাংশ। বছর শেষে দেখা যায়, প্রকৃত মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে মূলস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৮ হলেও প্রকৃত মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৪৪ শতাংশ। চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। ধারণা করা হচ্ছে, শেষ পর্যন্ত এটি ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। সর্বশেষ চলতি অর্থবছরের মে মাসের সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫৭ শতাংশ। এপ্রিল ও মার্চে তা ছিল যথাক্রমে ৫ দশমিক ৬৩ ও ৫ দশমিক ৬৮ শতাংশ। বছরটিতে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ৫ দশমিক ৫ নির্ধারণ হলেও বছরের মাঝামাঝিতে এসে তা সংশোধন করে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ করা হয়। অর্থাৎ পণ্যের দাম বাড়ার কারণে মূল্যস্ফীতির পারদও বেড়েছে। সবদিক বিবেচনা করে নতুন অর্থবছরের বাজেটে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো হয়েছে। কোন মাসের মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৫ শতাংশের অর্থ হচ্ছে, চলতি বছরের নির্দিষ্ট ওই মাসে আগের বছরের একই মাসের তুলনায় কোন পণ্যের দাম ৫ দশমিক ৫ শতাংশ হারে বেড়েছে। সহজ করে বলতে গেলে, ২০১৮ সালের এপ্রিলের মূল্যস্ফীতি ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশের অর্থ হলো- যে পণ্যটি ২০১৭ সালের এপ্রিলে ১০০ টাকায় কেনা গেছে, সেই একই পণ্য ২০১৮ সালের এপ্রিলে এসে ১০৫ দশমিক ৬৩ টাকায় কিনতে হয়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরকে ভিত্তি ছিল ধরে বিবিএস মূল্যস্ফীতির হিসাব করে আসছে। বাংলাদেশ ট্রেডিং কর্পোরেশনের (টিসিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালের ১ জুন নাজিরশাইল বা মিনিকেট জাতীয় সাধারণ মানের চালের দাম ছিল ৪০ থেকে ৪৬ টাকা। ২০১৫ সালের একই দিনে এ ধরনের চালের দাম ছিল ৩৮ থেকে ৪৬, ২০১৬ সালে ৪৪ থেকে ৪৮ ও ২০১৭ সালে ৫২ থেকে ৫৪ টাকা। আর চলতি বছরে একই দিনে এ জাতীয় চালের দাম ছিল ৫৮ থেকে ৬২ টাকা। অর্থাৎ বছর ব্যবধানে চালের দাম বেড়েছেই। কোন কোনও ক্ষেত্রে আগের বছরের তুলনায় শতাংশের হিসাবও বেশি। এ জাতীয় চালের বার্ষিক মূল্যবৃদ্ধি ১৩ দশমিক ২১ শতাংশ। আবার, ২০১৪ সালের জুনের তুলনায় বর্তমানে ভোজ্যতেলের দাম কিছুটা কম। তখন বোতলজাতে সয়াবিন তেল লিটারে ১১২ থেকে ১১৬ টাকায় বিক্রি হলেও ২০১৮ সালের ১ জুন তা কেনা গেছে ১০৪ থেকে ১০৮ টাকায়। এ জাতীয় ভোজ্যতেলের বার্ষরিক মূল্য হ্রাসের পরিমাণ ৯ দশমিক ৯৯ শতাংশ। এদিকে, ২০১৪ সালের ১ জুন মসুর ডাল ৭৫ থেকে ১১৫ টাকা, পরের বছরের একই দিনে অর্থাৎ ২০১৫ সালে ৯০ থেকে ১২০ টাকা, ২০১৬ সালে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা, ২০১৭ সালে ৭৫ থেকে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হয়। আর চলতি বছরের ১ জুনে মসুর ডালের দাম ছিল ৫৫ থেকে ১১০ টাকা। মসুরের ডালের ক্ষেত্রে দেখা গেছে সার্বিকভাবে দাম কমেছে। একই সময়ে দেশি পেঁয়াজের দাম সর্বনিম্ন ৩০ থেকে সর্বোচ্চ ৪৫ টাকার মধ্যে ছিল। যা চলতি বছরের পহেলা জুনে বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়। অর্থাৎ দীর্ঘমেয়াদি এই সময়ে পেঁয়াজের দাম কিছুটা ঊর্ধ্বমুখী। চিনির ক্ষেত্রে দেখা গেছে, এর দাম ছিল সর্বনিম্ন ৪০ থেকে সর্বোচ্চ ৭৫ টাকা। আর এ বছরের পহেলা জুনে চিনি বিক্রি হয়েছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকায়। সময় ব্যবধানে চিনির দামও ঊর্ধ্বমুখী। ২০১৫ সালে গরুর মাংস ৩৫০ থেকে ৩৮০ টাকায় বিক্রি হলেও এবারের রোজায় তা ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। রোজার আগে ও পরে কোনো কোনো সময় এর দাম সাড়ে ৫৫০ টাকাও ছাড়িয়ে গেছে। অন্যান্য পণ্যের দামও কম বেশি বেড়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এই দাম আগের বছরের তুলনায় শতাংশের হারেও বেশি।
×