মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, লেখক ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠজন মিয়া ফারুকী। ঘনিষ্ঠজন ছিলেন বলেই ’৭৪ সালে আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর নিযুক্ত হন মিয়া ফারুকী। শুধু তাই নয়, আজকের প্রধানমন্ত্রীর বিয়ের অনুষ্ঠানে মিয়া ফারুকী নিজেই সাক্ষী হন। ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা মিয়া ফারুকী সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ মিয়া ফারুকীকে শুধু রাজনীতিবিদ হিসেবে নয়, সহজে মানুষ চিনত তাঁর লেখা পত্রিকার অগণিত কালো অক্ষরের মাধ্যমে। যেসব অক্ষরে উঠে আসত সমাজের নানা প্রকারের অসঙ্গতির বার্তা। ওইসব বার্তাতে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজতে কোন অসুবিধা হতো না। আমরা দেখেছি ফারুকীর কলম সব সময় সোচ্চার থেকেছে যে কোন অন্যায়-অসঙ্গতির বিরুদ্ধে। তাঁর লেখাতে উঠে আসা অনেক কিছু অনুকরণ করতে পারতাম অনায়াসে। এ পর্যন্ত মিয়া ফারুকীর সাড়ে চার হাজারের ওপরে লেখা (সংরক্ষণ রয়েছে-পারিবারিক সূত্র) স্থানীয় ও জাতীয় দৈনিকগুলোতে প্রকাশিত হয়েছে।
মিয়া ফারুকীর দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী আগামীকাল (১ জুলাই) রবিবার। দীর্ঘদিন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে ২০১৬ সালের এই দিনে চট্টগ্রাম মহানগরীর জিইসি মোড়স্থ মেট্টোপলিটন হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। স্বাধীনচেতা, মুক্তচিন্তার আজীবন লড়াকু সৈনিকের মৃত্যুতে দেশ ও জাতির জন্য কত যে ক্ষতি হয়েছে তা সহজে অনুমেয়।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলেও রাজনীতি তাঁকে ছেড়ে দেয়নি। যার প্রমাণ ঘটে ১৯৮০ সালে। তখন মিয়া ফারুকী জন্ডিস ও ডায়াবেটিকসে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে জিল্লুর রহমান (প্রয়াত), জোহরা তাজউদ্দিন (প্রয়াত), সাজেদা চৌধুরী, মতিয়া চৌধুরী, মিয়া ফারুকীর গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়ায় এসে তাকে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করান। পরে চমেক হাসপাতালে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহাম্মদ, আবদুস সালাম আজাদ, ড. কামাল হোসেনসহ বহু নেতৃবৃন্দ মিয়া ফারুকীকে দেখতে আসেন। ১৯৭৩ সালে প্রফেসর নুরুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে নমিনেশন চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মিয়া ফারুকীকে নমিনেশন না দেয়া সত্ত্বেও তিনি প্রফেসর নুরুল ইসলাম চৌধুরীর সঙ্গে থেকে অবিভক্ত পটিয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা চালান।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলোকচিত্রী শোয়েব ফারুকী ও সঙ্গীতশিল্পী শহীদ ফারুকীর বাবা মিয়া ফারুকী ১৯৩৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের পটিয়ায় উপজেলার কচুয়াই ইউনিয়নের ফারুকীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। কিশোর বয়সে পটিয়ার রেলস্টেশনে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা পিসি ষোশী, বিপ্লবী কল্পনা দত্ত, চক্রশালার কংগ্রেসনেত্রী নেলী সেনগুপ্তা ও চট্টগ্রামের দামপাড়া পুলিশ লাইন মাঠে মুসলিম লীগ নেতা মোঃ আলী জিন্নাহর জনসভায় উপস্থিত থেকে বক্তব্য শোনার সুযোগ পান তিনি। ফলে তিনি রাজনীতে আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। শিক্ষা জীবন শেষে করে ১৯৪৯ সালে রাজনীতিতে যোগ দেন তিনি। তখন থেকে তিনি বিভিন্ন পর্যায়ে ইউনিয়ন, থানা ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করে মাঠে ময়দানে সংগ্রাম চালিয়ে যান। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ও জোরালো ভূমিকা পালন করেন। রাজীনীতির স্বার্থে তিনি ১৯৫৮ সালে প্রথম কারাবরণ করেন। তারপর বিভিন্ন সময়ে তাকে ৬-৭ বার কারাবরণ করতে হয়। এ সময় তিনি মওলানা ভাসানী, শহীদ সোহওরার্দী ও বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে থেকে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে সমাবেশসহ জনসেবার সুযোগ লাভ করেন। ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের প্রচার ও দফতর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৯-এর গণআন্দোলন, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আস্থা অর্জন করেন। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনী তাঁর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এ সময় পত্রিকায় বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাঁকে ধরতে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়। তখন তিনি ভারতে গিয়ে আশ্রয় নেন এবং সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেন।
১৯৭৪-৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কাউন্সিলর নিযুক্ত করেন। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন তাঁর বন্ধুর মতো। ঢাকায় গেলে ধানম-ির ৩২নং বাড়িতে উঠতেন তিনি। এমনকি ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের দিনও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আড্ডা দিয়ে হোটেলে ফিরেন তিনি। রাতেই ঘটে সেই হত্যাযজ্ঞ। সপরিবার বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পর মিয়া ফারুকী মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়েন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিয়ের সাক্ষী হয়েছিলেন। সেই দিনের কিশোরী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মমতাময়ী শেখ হাসিনার বিয়ের মঞ্চে ছিলেন এম এম নূরন্নবী, মিয়া ফারুকী, এম এ আজিজ, ড. ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা, আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী।
মিয়া ফারুকীর পত্রিকায় প্রকাশিত কয়েকটি কলাম পড়ার আমার সৌভাগ্য হয়েছে। এছাড়া তাঁর কয়েকটি লেখা এদেশের চিন্তাশীল মানুষের আজীবন পুঁজি হয়ে থাকবে। মানবিকতার বাতিঘর মিয়া ফারুকীকে নিয়ে আমাদের গৌরবের অন্ত নেই। সারা জীবন সত্য ও ন্যায়ের আরাধনা করতে গিয়ে তিনি মানবতাকে বিসর্জন দেননি। শেষ সময়ে মানুষের কাছে মানুষের নালিশ জানাতেন কলম ধরেছিলেন। তাঁর ভাবাদর্শকে অনুসরণ করে আমরা অন্যরা এগ্রিয়ে এলে সমাজের অনেক অসঙ্গতি দূর হবে। দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি এমনকী তাঁর রেখে যাওয়া স্মৃতির প্রতি রইল অশেষ শ্রদ্ধা। গভীর শ্রদ্ধায় তাঁর নামটি যেন বহুকাল ধরে উচ্চারণ করে এদেশের মানুষ এটাই প্রত্যাশা।